দুবলার চরের শুটকি বাণিজ্য

দুবলার চর
পাখির চোখে দুবলার চর। ছবি: হাবিবুর রহমান/স্টার

পাখির চোখে দেখা এই দৃশ্য দুবলার চরের। বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবনের শেষ সীমায় বঙ্গোপসাগরের কোল ঘেঁষা এই চরে গড়ে উঠেছে শুটকি পল্লী।

ঐতিহ্যবাহী রাস উৎসবের পাশাপাশি এই চরের খ্যাতি দেশের সবচেয়ে বড় শুটকির বাজার হিসেবেও। এখান থেকে প্রায় ৩০০ কোটি টাকার শুটকি যায় সারাদেশে।

বন বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, জেলেরা প্রতি বছর অক্টোবর থেকে মার্চ পর্যন্ত অর্থাৎ ছয় মাস এখানে ব্যবসার অনুমতি পান। এই চরে কাজ করেন ৩৫ হাজারের বেশি মানুষ।

সুন্দরবনের পূর্ব বন বিভাগের শরণখোলা রেঞ্জের দুবলার চরের মূলত আলোরকোল, মাঝেরকেল্লা, নারকেল বাড়ীয়া, শেলারচর ও মেহেরআলীর চরে হয় মাছ শুকানোর কাজ।

যেসব জেলেদের তিন থেকে পাঁচটি নিজস্ব মাছ ধরার ট্রলার আছে তাদেরকে ডাকা হয় 'মহাজন' বলে। যাদের ট্রলারের সংখ্যা আরও বেশি তাদেরকে ডাকা হয় 'বহরদার'। শুটকির কাজে নিযুক্ত জেলেরা এসব 'মহাজন' ও 'বহরদার'দের হয়ে কাজ করেন।

দুবলার চর
সাগর থেকে মাছ ধরে এনে রাখা হচ্ছে বাছাইয়ের জন্য। ছবি: হাবিবুর রহমান/স্টার

কয়েকজন 'বহরদার' ও 'মহাজন'র সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে—সাধারণত লইট্টা, তেলফ্যাসা, ছুরি, বৈরাগী, চাকা চিংড়ি, রূপচাঁদা শুঁটকি করা হয়। কাঁচা মাছ শুকাতে সময় লাগে তিন থেকে পাঁচ দিন। পাইকারদের কাছে গড়ে প্রতি কেজি শুটকি বিক্রি করা হয় ৫০০-৫৫০ টাকায়। এখান থেকেই পাইকাররা শুঁটকি কিনে নিয়ে যান।

সম্প্রতি সরেজমিনে দেখা যায়—কয়েক হাজার শ্রমিক শুঁটকি পল্লীতে কাজ করছেন। কেউ রোদে মাছ শুকাচ্ছেন, কেউ আবার ট্রলার নিয়ে সাগরে যাচ্ছেন মাছ ধরতে।

জেলেরা মাছ নিয়ে এসেই শুরু করেন বাছাইয়ের কাজ। প্রজাতি অনুযায়ী মাছ আলাদা করা হয়। এরপর নানান প্রক্রিয়া শেষে শুকাতে দেন সেসব মাছ।

জেলে মিরাজ শেখ দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'সাধারণত তেলা, ফ্যাইসাসহ অন্যান্য ছোট মাছ চাতালে ও লম্বাটে লইট্টা, ছুরি মাছগুলোকে বাঁশের আড়ায় ঝুলিয়ে শুকাতে দেওয়া হয়।'

প্রায় ৩০ বছর ধরে এই চরে মহাজনের কাজ করা ইসমাইল হোসেন ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এখান থেকে শুঁটকি নেওয়ার জন্য ১০-১২টি পরিবহন ব্যবস্থা আছে। তারা রংপুর, সৈয়দপুর, চট্টগ্রাম ও ঢাকায় শুঁটকি পাঠিয়ে দেয়। দেশের শুঁটকির বড় অংশ যায় দুবলার চর থেকে।'

দুবলার চর
আলাদাভাবে শুকানো হচ্ছে নানান প্রজাতির মাছ। ছবি: হাবিবুর রহমান/স্টার

তার মতে, সরকারিভাবে ব্যবস্থা নেওয়া হলে এই চরের শুঁটকি রপ্তানি করে প্রতি বছর হাজার হাজার ডলার আয় করা যেত।

সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে দুবলার চর থেকে শুঁটকি পাওয়া গিয়েছিল চার হাজার ১০৫ টন। বন বিভাগের আয় হয়েছিল দুই কোটি ৬৮ লাখ টাকা। ২০২২-২৩ অর্থবছরে পাঁচ হাজার ১০০ টন শুটকি থেকে আয় হয়েছিল ছয় কোটি ৬৮ লাখ টাকা।

সাগরের যে কোনো ঝড় সবার আগে আঘাত হানে দুবলার চরে। এ কারণে দুবলার চরে কাজ করা অধিকাংশ মানুষের দাবি—সাইক্লোন আশ্রয়কেন্দ্র। এখানে কয়েকটি আশ্রয়কেন্দ্র ছিল, কিন্তু বর্তমানে সেগুলো ব্যবহারের অনুপযোগী।

এই চরে খাবার পানির তীব্র সংকট কাটাতে কয়েকটি পাতকুয়া করা হয়েছে। বর্ষায় সেখানে পানি জমে। ওই পানি জীবাণুমুক্ত নয়। তবুও ওই পানিই ভরসা পল্লীবাসীদের।

দুবলার চর
শুকাতে দেওয়া মাছের পরিচর্যা করছেন জেলেরা। ছবি: হাবিবুর রহমান/স্টার

চরটিতে আধুনিক চিকিৎসার ব্যবস্থা নেই। ছয় মাসের জন্য আসা মানুষগুলোর চিকিৎসা হয় না।

চরের নিউমার্কেট এলাকায় কয়েকটি ওষুধের দোকান আছে। দোকানদাররা অসুস্থতার ধরন শুনে জেলেদের চিকিৎসা দেন।

সেখানে চিকিৎসা সেবা দেওয়া গ্রাম্য চিকিৎসক তারিকুল ইসলাম ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এই দুর্গম চরে চিকিৎসা দেওয়ার সরকারি উদ্যোগ নাই। অধিকাংশ রোগী আসেন পেটের ব্যথা ও গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা নিয়ে। আমরা তাদের চাহিদামত শুধু ওষুধ বিক্রি করি।'

চরের আলোরকোলের পূর্ব দিকে গড়ে উঠেছে বাজার। খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাটসহ অন্যান্য এলাকার মানুষ দোকান দিয়েছেন ওই বাজারে। এখানে আছে সেলুন, লেদ মেশিন, খাবারের হোটেল, কসমেটিকস, মুদি ও কাপড়ের দোকান। আছে মোবাইল সার্ভিসিংয়ের দোকানও।

জেলেরা এই বাজারের নাম দিয়েছেন 'নিউমার্কেট'। এসব দোকান থেকে ছয় মাসের প্রয়োজনীয় চাহিদা মেটান জেলেরা।

বাজারটি দেখে বোঝার উপায় নেই কয়েক মাসের জন্য সেখানে দোকানগুলো বসানো হয়েছে।

চরে মাছ ধরার কাজে আছে শত শত ট্রলার। এসব ট্রলার মেরামতের জন্য আছে কারখানা। নিজস্ব জেনারেটর ব্যবস্থায় কারখানাগুলো চালানো হয়। কেন্দ্রীয়ভাবে জেনারেটরের মাধ্যমে স্বল্প সময়ের জন্য বিদ্যুতের ব্যবস্থা আছে ওই চরে।

দুবলার চর
শুকানো মাছ বাছাই করা হচ্ছে বিক্রির জন্য। ছবি: হাবিবুর রহমান/স্টার

রাস উৎসব

দুবলার চরটি দক্ষিণবঙ্গসহ দেশের মানুষের কাছে সবচেয়ে বেশি পরিচিতি পেয়েছে ঐতিহ্যবাহী রাস উৎসবের কারণে। প্রায় দেড় শ বছর ধরে দুবলার চরের আলোরকোলে অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে রাস পূজা ও পুণ্যস্নান। পূজা উপলক্ষে এখানে প্রায় ৫০ হাজার মানুষ আসেন বলে জানিয়েছেন আয়োজকরা।

দুবলার চর ফিশারম্যান গ্রুপের সভাপতি কামাল উদ্দিন আহমেদ ডেইলি স্টারকে বলেন, 'সমুদ্রসম্পদ ব্যবহার করে দুবলার চর থেকে কোটি কোটি টাকার রাজস্ব পায় সরকার। দেশের মাছের চাহিদার একটি বড় অংশ পূরণ করে চরটি। ওই কাজে যারা সহযোগিতা করেন তাদের ন্যূনতম সুযোগ-সুবিধা নেই। জেলেদের উন্নয়ন ও নিরাপত্তায় সরকারি ব্যবস্থা থাকা দরকার।'

পরিবেশবাদীরা বলছেন, সংরক্ষিত বনে এত বিপুল সংখ্যক মানুষের আনাগোনায় সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্যসহ পরিবেশের নানা ধরনের ক্ষতি হচ্ছে। মাছ ধরার অজুহাতে অনেকে হরিণ শিকারসহ নানা অপকর্ম জড়িয়ে পড়েন। সরকারের উচিত পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রেখে পল্লীর সার্বিক উন্নয়ন করা।

Comments

The Daily Star  | English

Will protect investments of new entrepreneurs: Yunus

Yunus held a meeting with young entrepreneurs at the state guest house Jamuna where15 male and female entrepreneurs participated

5h ago