পায়রা সমুদ্রবন্দরে বাড়ছে পণ্য পরিবহন খরচ, ব্যবসায়ীদের অসন্তোষ

পায়রা সমুদ্রবন্দর
নাব্যতার অভাবে পায়রা সমুদ্রবন্দরের জেটিতে বড় জাহাজ ভিড়তে না পারায় ছোট জাহাজে পণ্য খালাস করা হচ্ছে। ছবি: সোহরাব হোসেন/স্টার

সাড়ে ছয় হাজার কোটি টাকা খরচে ক্যাপিটাল ড্রেজিংয়ের ছয় মাসের মধ্যেই পায়রা সমুদ্রবন্দরের রাবনাবাদ চ্যানেলে দেখা দিয়েছে নাব্যতা সংকট। এ বন্দরের মাধ্যমে দুটি বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য বিদেশ থেকে আসা কয়লাবাহী মাদার ভেসেল বা বড় জাহাজগুলো সরাসরি বন্দরে ভিড়তে পারছে না।

গভীর সমুদ্রবন্দর থেকে ছোট বা লাইটার জাহাজে কয়লা নিয়ে আসতে বাড়তি খরচ গুনতে হচ্ছে ব্যবসায়ীদের। বাড়তি খরচ যোগ হয় উৎপাদিত বিদ্যুতের হিসেবেও। এতে বিদ্যুৎ উৎপাদনের খরচ বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি ব্যবসায়ীদের অসন্তোষ বাড়ছে।

পায়রা সমুদ্রবন্দর ও ব্যবসায়ীদের সূত্রে জানা গেছে—পটুয়াখালীর কলাপাড়ায় রাবনাবাদ নদীর তীরে আছে তিনটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র। আল্ট্রাসুপার ক্রিটিক্যাল প্রযুক্তির এসব বিদ্যুৎকেন্দ্রের একটি এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতার পায়রা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের উৎপাদন শুরু হয় ২০২০ সালে।

নরিনকো ইন্টারন্যাশনাল পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেডের (আরএনপিএল) এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্রটি কমিশনিং পর্যায়ে আছে। আশুগঞ্জ বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মাণাধীন। প্রথম দুই বিদ্যুৎকেন্দ্রের জ্বালানি কয়লা আনা হয় ইন্দোনেশিয়া থেকে রাবনাবাদ চ্যানেল দিয়ে।

কয়লা ছাড়াও চুনা পাথর, স্পুন পাইল, সিমেন্ট ক্লিংকার, স্টোন চিপস, প্ল্যান্ট মেশিনারি/প্রজেক্ট কার্গো, বড় পাথর, ড্রেজিং সরঞ্জাম, চূর্ণ পাথর, পিএইচপি পাইপ পাইল, ওপিসি ক্লিংকার ও এলপিজি এ বন্দরের মাধ্যমে আমদানি হয়।

গভীর সমুদ্র থেকে মাদার ভেসেলগুলো পায়রা বন্দরের জেটিতে নিয়ে আসার জন্য রাবনাবাদ চ্যানেলের নাব্যতা সাড়ে ১০ মিটারে উন্নীত করতে সাড়ে ছয় হাজার কোটি টাকা খরচে বেলজিয়ামের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান 'জান ডি নুল'কে নিয়োগ করা হয়।

প্রতিষ্ঠানটি ২০২১ সালের জানুয়ারি রাবনাবাদ চ্যানেলে ক্যাপিটাল ড্রেজিং শুরু করে। গত ২৬ এপ্রিল পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষের কাছে খননকৃত চ্যানেলটি হস্তান্তর করা হয়।

কিন্তু রক্ষণাবেক্ষণ ড্রেজিং না থাকায় নাব্যতা সংকটে চ্যানেলটি। বর্তমানে এর গভীরতা জোয়ারের সময় সাড়ে ছয় মিটার ও ভাটার সময় পাঁচ দশমিক নয় মিটারের কম থাকে। এই চ্যানেল দিয়ে মাদার ভেসেলগুলো জেটিতে ভিড়তে পারে না। ফলে লাইটার জাহাজের মাধ্যমে কয়লা খালাস করতে গিয়ে বন্দর ব্যবহারকারীদের বাড়তি খরচ হচ্ছে।

এই মুহূর্তে পায়রা বন্দরের সবচেয়ে বড় ব্যবহারকারী পায়রা এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াট তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র বিসিপিসিএল। এই কেন্দ্রের প্রকল্প ব্যবস্থাপক প্রকৌশলী শাহ আব্দুল মাওলা দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'পায়রা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য ইন্দোনেশিয়া থেকে মাদার ভেসেলে আসা কয়লা পায়রা বন্দরের মাধ্যমে খালাস করি। নাব্যতা কম থাকায় মাদার ভেসেল সরাসরি জেটিতে নিয়ে আসতে পারে না। বহির্নোঙ্গর থেকে ছোট জাহাজে কয়লা খালাস করতে হয়। প্রতি টন কয়লায় ১০ থেকে ১২ ডলার বাড়তি খরচ হচ্ছে। এ বাড়তি খরচ বিদ্যুতের উৎপাদনের খরচের সঙ্গে যোগ হচ্ছে।'

'ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে রাবনাবাদ চ্যানেলের নাব্যতা বজায় রাখা না গেলে পণ্য পরিবহনের খরচ বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি দুর্ভোগও বাড়বে,' বলে মন্তব্য করেন তিনি।

বিদ্যুৎকেন্দ্রটির তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী জোবায়ের আহমেদ ডেইলি স্টারকে জানান, পায়রা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের উৎপাদিত বিদ্যুৎ দেশের মোট চাহিদার ১০ শতাংশ পূরণ করছে। এর জন্য প্রতি মাসে তিন লাখ টনের বেশি কয়লা পোড়ানো হয়।

তিনি বলেন, 'কয়লাবাহী জাহাজ সরাসরি জেটিতে ভিড়তে পারলে পরিবহন খরচ কম হতো। রাবনাবাদ চ্যানেলের নাব্যতা কমছে। শীতে নাব্যতা পাঁচ মিটারের নিচে নেমে যাওয়ার আশঙ্কা আছে। পরিবহন খরচ আরও বেড়ে যেতে পারে।'

বন্দরের অপর ব্যবহারকারী আরএনপিসিএল'র ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) প্রকৌশলী সেলিম ভূঁইয়া ডেইলি স্টারকে বলেন, 'চ্যানেলের গভীরতা কমে যাওয়ায় কয়লাবাহী বড় জাহাজ জেটিতে আনা যাচ্ছে না। ছোট জাহাজ ব্যবহার করতে হচ্ছে। বিষয়টি জানিয়ে আরএনপিএল থেকে পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। তারা নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয় ও বিদ্যুৎ বিভাগের সঙ্গে উচ্চ পর্যায়ে বৈঠক করে সমস্যা সমাধানের আশ্বাস দিয়েছেন।'

বন্দর ব্যবহারকারী রেডিয়েন্ট শিপিং এজেন্ট আবু সাঈদ ডেইলি স্টারকে বলেন, 'ক্যাপিটাল ড্রেজিং শেষ না হতেই রাবনাবাদ চ্যানেল পলি জমে ভরাট হচ্ছে। নাব্যতা কমে যাওয়ায় ছোট জাহাজে করে পণ্য খালাস করতে বাড়তি টাকা ও সময় লাগছে। এভাবে চলতে থাকলে পায়রা বন্দর ব্যবহার নিয়ে বিকল্প ভাবতে হবে। বন্দরটির সুফল নিশ্চিত করতে রাবনাবাদ চ্যানেলের নাব্যতা বজায় রাখা দরকার।'

পায়রা বন্দরের হাবার মাস্টার ক্যাপ্টেন এস এম শরিফুর রহমান ডেইলি স্টারকে বলেন, 'ক্যাপিটাল ড্রেজিংয়ের পর সাড়ে ১০ মিটার ড্রাফটের কমপক্ষে ২০০ মাদার ভেসেল সরাসরি জেটিতে ভিড়তে পারতো। নাব্যতা কমতে থাকায় বড় জাহাজ থেকে ছোট জাহাজে পণ্য খালাস করতে হচ্ছে।'

জোয়ার-ভাটার তথ্যে জানা গেছে, গত ২৬ এপ্রিল ক্যাপিটাল ড্রেজিং শেষ হওয়ার পরই কমতে শুরু করে নাব্যতা। গত ১ মে নাব্যতা ছিল নয় দশমিক তিন মিটার ও ১ জুন ছিল সাত দশমিক সাত মিটার। গত ১১ সেপ্টেম্বর তা সাত মিটারে নেমে আসে।

গত ২০ নভেম্বর দুপুর সোয়া ২টায় নাব্যতা দেখানো হয়েছে ছয় মিটার।

পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল আবদুল্লাহ আল মামুন চৌধুরী ডেইলি স্টারকে বলেন, 'রাবনাবাদ চ্যানেলের ক্যাপিটাল ড্রেজিংয়ের পর সাড়ে ১০ মিটারের বেশি ড্রাফটের জাহাজ বন্দরে এসেছে। চ্যানেলটি রক্ষণাবেক্ষণ ড্রেজিং চুক্তির মেয়াদ গত ৩০ এপ্রিল শেষ হয়। এরপরও চ্যানেলটির নাব্যতা বজায় রাখতে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের অনুমতি নিয়ে আরও দুই মাসের জন্য জরুরি রক্ষণাবেক্ষণ ড্রেজিং গত ১৪ আগস্ট শেষ হয়।'

'রাবনাবাদ চ্যানেলটি পলিপ্রবণ হওয়ায় এর নাব্যতা ধরে রাখা কঠিন। এ জন্য সারা বছর ড্রেজিং দরকার। বিগত সরকারের আমলে রক্ষণাবেক্ষণ ড্রেজিং আরও দুই বছর চলমান রাখার বিষয়ে নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। বর্তমানে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এই রক্ষণাবেক্ষণ ড্রেজিং চলমান থাকবে কিনা সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়নি। এ ছাড়াও, নিজস্ব ড্রেজিং সক্ষমতা অর্জনের জন্য হপার ড্রেজার কেনার উদ্যোগও নেওয়া হয়েছে। নৌ মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পরবর্তী উদ্যোগ নেওয়া হবে।'

সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও পায়রা বন্দরের কার্যক্রম দিন দিন বাড়ছে। ২০১৩ সালের ১৯ নভেম্বর স্থাপিত পায়রা বন্দরের আনুষ্ঠানিক পরিচালন কার্যক্রম শুরু হয় ২০১৬ সালের ১৩ আগস্ট। জাহাজ থেকে জাহাজে পণ্য নেওয়ার পদ্ধতিতে বন্দরটি চালু হলে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ১০টি জাহাজ বন্দরে আসে।

২০২৩-২৪ অর্থবছরে এ বন্দরে আসা জাহাজের সংখ্যা ছিল এক হাজার ৪০টি। গত ২৮ অক্টোবর পর্যন্ত ৪৮৪ বিদেশি বাণিজ্যিক জাহাজসহ তিন হাজার ১৬০ দেশি-বিদেশি জাহাজ এখানে পণ্য উঠা-নামা করে। সরকারের আয় হয়ে প্রায় এক হাজার ৫৭৬ কোটি টাকা।

Comments

The Daily Star  | English
Debunking myths about air pollution in Bangladesh

Debunking myths about air pollution in Bangladesh

Discover the myths surrounding air pollution in Bangladesh and its real health impacts.

5h ago