চিকিৎসার জন্য আহত মানুষকে রাস্তায় নামতে হবে কেন?
রাজধানীর আগারগাঁও এলাকায় পঙ্গু হাসপাতাল এবং তার উল্টো দিকে জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের সামনের রাস্তায় ১৩ নভেম্বর দুপুর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত বিক্ষোভ করেছেন জুলাই-আগস্ট আন্দোলনে আহতরা। দাবি দুটি—আহতদের সুচিকিৎসা এবং অন্তর্বর্তী সরকারের স্বাস্থ্য উপদেষ্টার পদত্যাগ।
সুচিকিৎসার দাবিটি ন্যায়সঙ্গত। কিন্তু স্বাস্থ্য উপদেষ্টার পদত্যাগ দাবি কেন?
বিক্ষোভকারীদের অভিযোগ, বুধবার সকালে আহতদের দেখতে পঙ্গু হাসপাতালে যান স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নূরজাহান বেগম। তিনি সেখানে চিকিৎসাধীন আহত কয়েকজনের খোঁজখবর নিয়ে হাসপাতালের পরিচালক ও চিকিৎসকদের সঙ্গে বৈঠক করে বেরিয়ে যাচ্ছিলেন। এ সময় হাসপাতাল ভবনের সামনে তিনি চিকিৎসাধীন আহত ব্যক্তিদের ক্ষোভের মুখে পড়েন। উপদেষ্টা সবার সঙ্গে দেখা করেননি অভিযোগ তুলে তারা বিক্ষোভ শুরু করেন।
দৃশ্যটা কল্পনা করুন। কারও হাতে, কারও পায়ে ব্যান্ডেজ লাগানো, কেউ ক্রাচে ভর দিয়ে আছেন, কেউ হুইলচেয়ারে। তারা মন্ত্রী পদমর্যাদার একজন উপদেষ্টার পথ আটকে দাঁড়ালেন তাদের কথা শোনানোর জন্য, চিকিৎসার ত্রুটি নিয়ে তাদের ক্ষোভ জানানোর জন্য, তাদের দুঃখ-দুর্দশার চিত্রটি দেখানোর জন্য। এমনকি অনেকে উপদেষ্টার গাড়ির সামনেও শুয়ে পড়লেন। দুয়েকজন গাড়ির ওপরে উঠে গেলেন। এরকম পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্য উপদেষ্টা অন্য একটি গাড়িতে চড়ে চলে যান। এ সময় তার সঙ্গে ছিলেন যুক্তরাজ্যের হাইকমিশনারও। তিনিও অন্য একটি গাড়িতে হাসপাতাল ছাড়েন।
বাংলাদেশের ইতিহাসে এমন ঘটনা আগে ঘটেছে কি না সন্দেহ। চিকিৎসার দাবিতে আহতরা স্বাস্থ্য উপদেষ্টার পথ রোধ করে দাঁড়ালেন এবং তারপরও তিনি চলে গেলেন বলে সেই মানুষেরা হাসপাতালের বিছানা ছেড়ে রাস্তায় নেমে এলেন, উপদেষ্টার পদত্যাগ দাবিতে স্লোগান দিলেন। অথচ এই মানুষগুলো জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রাস্তায় নেমেছিলেন শেখ হাসিনা সরকারের পদত্যাগের দাবিতে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গুলি অথবা অন্য কোনো অস্ত্রের আঘাতে আহত হয়ে, পঙ্গু হয়ে, দৃষ্টিশক্তি প্রায় হারিয়ে তারা চিকিৎসা নিচ্ছেন জনগণের অর্থে পরিচালিত দুটি হাসপাতালে। অথচ জীবনের ঝুঁকি নেওয়া সেই মানুষগুলোকেই সুচিকিৎসার দাবিতে স্বাস্থ্য উপদেষ্টার পথ আটকাতে হলো!
বাস্তবতা হলো, শত শত শিক্ষার্থী, রাজনৈতিক কর্মী ও সাধারণ মানুষ প্রাণ না দিলে তিনি হয়তো কোনোদিন সরকারের মন্ত্রী বা এই পদমর্যাদায় অন্য কোনো পদে অধিষ্ঠিত হতে পারতেন না। হয়তো দেশের মানুষ তার নামটিও জানতো না। অস্বীকার করার সুযোগ নেই, এই ঘটনাটি সরকারকে বিব্রত করলো। সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের দায়িত্ব, কর্তব্য ও কাজের প্রতি তাদের আন্তরিকতা দারুণভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করলো।
প্রশ্ন হলো, একজন রোগী কিংবা দুর্ঘটনা বা সহিংসতায় আহত কোনো মানুষকে চিকিৎসার জন্য কেন রাস্তায় নামতে হবে? কেন তাকে চিৎকার করে বলতে হবে, হে রাষ্ট্র আমার চিকিৎসা করুন; আমার হাত ভেঙে গেছে, এটা জোড়া লগিয়ে দিন; আমি দেখতে পারছি না, আমার দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে দিন; আমার মাথায় এখনও বুলেট, অস্ত্রোপচার করে এটা বের করুন; হে রাষ্ট্র, আমাকে সুস্থ করে তুলতে ব্যবস্থা নিন। কেন একজন নাগরিককে এ কথা বলতে হবে? কেন হাসপাতালের বিছানা ছেড়ে তাকে রাস্তায় নেমে আসতে হবে? হুইল চেয়ারে বসে কেন তাকে স্বাস্থ্য উপদেষ্টার পদত্যাগ চাই বলে স্লোগান দিতে হবে? কেন এই মানুষগুলোকে এটা মনে করিয়ে দিতে হলো, তাদের আত্মত্যাগের ফলেই আজকে আপনি উপদেষ্টা এবং এই অভ্যুত্থানের ফলেই আপনি এখন জনগণের ট্যাক্সের পয়সায় কেনা দামি গাড়িতে চড়েন।
প্রশ্ন হলো, জনগণের ট্যাক্সের পয়সায় পরিচালিত সরকারি হাসপাতালেই কেন সুচিকিৎসা নিশ্চিত করা যাচ্ছে না? সরকারের টাকার অভাব, চিকিৎসক সংকট, চিকিৎসা সরঞ্জামের ঘাটতি, নাকি চিকিৎসকদের আন্তরিকতার অভাব?
অভ্যুত্থানে আহত কী পরিমাণ মানুষ এখনও হাসপাতালে চিকিৎসাধীন, তার সঠিক পরিসংখ্যান কি সরকারের কাছে আছে? যদি থাকে, তাহলে ঢাকা শহরে সরকারি আরও যেসব বড় হাসপাতাল আছে, এমনকি সেনানিবাসের ভেতরে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল এবং বেসরকারি হাসপাতালগুলোতেও সরকারের নিবিড় তত্ত্বাবধানে কেন তাদের চিকিৎসা নিশ্চিত করা যাচ্ছে না? এটি খুব জটিল বা কঠিন কাজ নয়। কিন্তু কাজটি হচ্ছে না। কেন হচ্ছে না? এই মানুষগুলোর চিকিৎসার বিষয়টি সরকারের অগ্রাধিকারে নেই?
অভ্যুত্থানে আহত বলেই নয়, একজন সাধারণ মানুষ, যার এই অভ্যুত্থানে কোনো ভূমিকা ছিল না, হয়তো তিনি কোনো দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত কিংবা কোনো দুর্ঘটনায় আহত—তাকেই বা কেন চিকিৎসার জন্য রাস্তায় নামতে হবে? নাগরিকের চিকিৎসা নিশ্চিত করার দায়িত্ব কি রাষ্ট্রের নয়?
খারাপ শোনালেও এটি সত্য যে, কোন বিবেচনায় কাদেরকে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা করা হলো—এই প্রশ্ন এখন শুধু বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনই নয়, বরং সাধারণ মানুষেরও। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে যেমন একটি নির্দিষ্ট জেলার লোকদের অগ্রাধিকার দেওয়া হতো, অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা তথা রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে একইভাবে একটি জেলার এবং একটি নির্দিষ্ট কোরামের লোকদের বিবেচনায় নেওয়া হচ্ছে বলেও সমালোচনা আছে। অথচ জুলাই-আগস্টের অভ্যুত্থানের মূলেই ছিল বৈষম্যের অবসান; সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার। সুতরাং কোটা সংস্কারের দাবিতে গড়ে ওঠা যে আন্দোলনটি অবশেষে সরকার পতনের এক দফা আন্দোলনে রূপ নিলো এবং যে আন্দোলনের সফলতার পথ ধরেই অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে একটি অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হলো, সেই সরকারের বিরুদ্ধেও যদি কোটায় নিয়োগের অভিযোগ ওঠে, সেটি দুঃখজনক।
সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে যাদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, তাদের অনেকেরই যোগ্যতা ও দক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। বাংলাদেশের মতো একটি জটিল রাষ্ট্র চালানো যে খুব সহজ কাজ নয়, বরং এখানে ব্যক্তির দেশপ্রেম, আর্থিক ও নৈতিক সততার সঙ্গে সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কাজে তার দক্ষতাও যে অনেক বেশি জরুরি—সেটি বুঝতে না পারলে দেশ আরও বড় বিপদে পড়বে।
পরিশেষে, এই সরকারের বয়স মাত্র তিন মাস। ফলে এখনই তাদের কাজের মূল্যায়ন করা ঠিক কি না, সেই প্রশ্ন থাকলেও উপদেষ্টা পরিষদ ঢেলে সাজানো তথা সত্যিকারের দক্ষ ও যোগ্য লোকদের নিয়োগ দেওয়া এখন সময়ের দাবি। তা না হলে কিছুদিন পরপর একেকটি ঘটনা ঘটবে এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন, রাজনৈতিক দল এমনকি সাধারণ মানুষও বিক্ষুব্ধ হয়ে রাস্তায় নেমে আসবে। তখন তারা এই প্রশ্নও তুলবে যে, যারা অভ্যুত্থানে আহত মানুষদেরই সুচিকিৎসা নিশ্চিত করতে পারে না, তারা কী করে রাষ্ট্রের সংস্কার করবে?
আমীন আল রশীদ: সাংবাদিক ও লেখক
Comments