অভ্যুত্থান পরবর্তী প্রজন্মের সামনে যে বাস্তবতা

প্রতিটি গণঅভ্যুত্থানের পরে ছাত্রজনতার প্রত্যাশা অনেক থাকে। যা পূরণ না হওয়ায় তাদেরকে সর্বস্ব হারানোর মতোই হতাশায় নিমজ্জিত হতে দেখা যায়। মনে পড়ে ৯০ দশকের শেষ দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি তখনও ক্যাম্পাসে অনেক বড় ভাইদের সাথে সাক্ষাত হতো যারা। ৯০ এর গণঅভ্যুত্থানে জড়িত ছিল। তাঁদের কথা বলার সময় চোখ দিয়ে স্ফুলিঙ্গ বের হতো এবং কখনো আনন্দে গর্ব অনুভব করতো। কিন্তু গল্প শেষে কিছুটা ম্রিয়মাণ হয়ে বসে থাকতো। কারণ তখনও কোনো পেশায় প্রবেশ করতে পারেনি।

বিশেষ করে ৯০ এর আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিল তারা সেশনজটে পড়েছিল কিংবা পড়াশোনার বয়স পেরিয়েছিল। এর মধ্যে হয়তো শতকরা ১ ভাগ রাজনৈতিক নেতা, ১ ভাগ কোনো ব্যবসা বা ঠিকাদারির, ১ ভাগ বিদেশে পাড়ি দিয়েছে, ১ ভাগ হয়তো আর্টিস্ট বা লেখক হয়েছে, ১ ভাগ হয়তো এক্টিভিস্ট বা বুদ্ধিজীবী হিসেবে পরিচিত, শতকরা ২০ ভাগ যারা পড়াশোনায় মনোযোগী ছিল নিজের চেষ্টায় চাকুরি নিয়েছে।

অবশিষ্ট প্রায় ৭০ ভাগ কোনো চাকুরি বা পেশায় যেতে পারে নি। এই ৭০ ভাগ শিক্ষার্থীদের অনেকেই তখন দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে ঘুরতো, আর বেকারত্বের অভিশাপে বিষাদের জীবন পার করতো।
২০২৪ সালের অভ্যুত্থান অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীদেরও এমন হতাশার মুখোমুখি হতে হবে যদি না তারা সময়ানুগ সিদ্ধান্ত নেয় ও কর্মে প্রবেশের প্রচেষ্টা না করে। কারণ এমনিতে নিরাপদ সড়ক আন্দোলন, কোটাবিরোধী আন্দোলন, করোনা মহামারী ইত্যাদি কারণে পড়াশোনায় পিছিয়েছে। সর্বশেষ অভ্যুত্থানে মিছিল, মিটিং, অ্যাক্টিভিটি করতে করতে পড়াশোনার টেবিলে বসার সময় পায় নি। ফলাফলও আশানুরূপ হয়নি।

বিশেষ করে ৯০ এর অভ্যুত্থানের অগ্রজদের জীবন থেকে শিক্ষা নিয়ে এখনই পড়াশোনায় বা স্কিলে বা কর্মযজ্ঞে নেমে পড়া উচিত। সময় নষ্ট করার মতো সময় তরুণদের হাতে নেই। তাদেরকে এখনই ঠিক করতে হবে তারা কী হতে চায়। দেশ ও সমাজের ভবিষ্যতের পাশাপাশি নিজেদের ভবিষ্যতও ঠিক করে স্বপ্ন নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে।

এখন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, প্রজন্ম নিজেই নিজের কর্মপথ নির্ধারণ, পরিকল্পনা ও পরিশ্রম করে আদায় করে নিতে হবে অবস্থান। পেটে ভাত না থাকলে, কেবল কথা দিয়ে জীবন চলবে না। যে আন্দোলন করে তারা ইতিহাসের গর্বিত ইতিহাসের অংশ হয়েছে, সেরকম মনোযোগ, পরিশ্রম দিয়ে নিজ নিজ পেশা বা ব্যবসায় বা পড়াশোনায় জীবনে উন্নতি লাভ করতে হবে। অন্যথায় হতাশায় নিমজ্জিত হতে হবে।

অস্বীকার করার সুযোগ নেই জুলাই গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে ছাত্র জনতা অসাধ্যকে সাধন করেছে। তারা একটি সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক সমাজ, গণতান্ত্রিক দেশ ও সংবিধান, অন্যায় ও অবিচারমুক্ত ন্যায়বিচারের বাংলাদেশ গড়ার ভিত দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। গণমানুষের ভোটাধিকার ফিরিয়ে দিয়েছে বা সংস্কারের পথপরিক্রমা এনে দিয়েছে। এজন্য জাতি তাদের কাছে কৃতজ্ঞ থাকবেই।

এখন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, প্রজন্ম নিজেই নিজের কর্মপথ নির্ধারণ, পরিকল্পনা ও পরিশ্রম করে আদায় করে নিতে হবে অবস্থান। পেটে ভাত না থাকলে, কেবল কথা দিয়ে জীবন চলবে না। যে আন্দোলন করে তারা ইতিহাসের গর্বিত ইতিহাসের অংশ হয়েছে, সেরকম মনোযোগ, পরিশ্রম দিয়ে নিজ নিজ পেশা বা ব্যবসায় বা পড়াশোনায় জীবনে উন্নতি লাভ করতে হবে। অন্যথায় হতাশায় নিমজ্জিত হতে হবে।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আশা-আকাঙ্ক্ষা ও বাস্তবতার মধ্যে বিরাট পার্থক্য থাকলে তা থেকে হতাশার জন্ম নিতে পারে এবং হতাশা থেকে ক্ষোভ ও বিদ্রোহের জন্ম হতে পারে। ইতিমধ্যে কিছু কিছু মহলে হতাশার সুর শোনা যাচ্ছে। এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের যারা ফেল করেছে তারাও আন্দোলন করে অটো গ্রেড চাচ্ছে। আন্দোলন করে অটো গ্রেড অটো চাকুরী হয়তো পাওয়া যাবে, কিন্তু পড়াশোনার ভিত্তি না থাকলে কর্মক্ষেত্রে ভালো করা যায় না। শ্রমজীবী কাজ হয়তো সম্ভব, কিন্তু মেধা ও দক্ষতা যেসব কাজে লাগে সেসব গুরুত্বপূর্ণ পদে তারা যেতে সক্ষম হবে না। এই জন্য বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বাস্তব চরিত্র ও তৎপরবর্তী আশা-আকাঙ্ক্ষা অনুধাবন জরুরি।

অবশ্যই সংস্কার কমিটি থেকে প্রাপ্ত সুপারিশের আলোকে বাস্তবায়িত হলে নিশ্চয়ই দেশে গণতন্ত্র যেমন বিরাজ করবে, তেমনি উন্নয়নের পথও সুসংহত হবে। সেটা হলে আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত ছাত্র-জনতা ও তরুণ প্রজন্ম গর্ব বোধ করবে। জাতীয় জীবনে ভূমিকা রাখতে পারা ও গণমানুষের ভাগ্য পরিবর্তন করতে পারার অংশ হওয়ার মধ্যে আত্মসন্তুষ্টি আর কিছুই হতে পারে না। তবে এর সাথে সাথে নিজের ভাগ্যও একটু শান্তির ও স্বস্তির হওয়া জরুরি। জাতীয় পর্যায়ের এ পরিবর্তনগুলো হতে সময় লাগবে।

মঙ্গলবার (৯জুলাই) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় লাইব্রেরির সামনে সারাদেশে সকাল-সন্ধ্যা ‘বাংলা ব্লকেড’ ঘোষণা দেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত

অভ্যুত্থানের পরবর্তী সময়ে তরুণ প্রজন্ম রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সামাজিক চাপের সম্মুখীন হতে পারে। মানসিক চাপ বা হতাশা তাদের ক্যারিয়ার বিকাশে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। ফলে তাদের নিয়ে রাষ্ট্র যেমন চিন্তা করতে হবে, তেমনি তরুণদেরকেও সচেতন হয়ে নিজের ক্যারিয়ার নিয়ে ভাবতে হবে।

প্রথমত অভ্যুত্থানের সময় এবং পরবর্তী পরিস্থিতিতে শিক্ষাব্যবস্থায় স্থবিরতা দেখা দিয়েছিল তা থেকে বের হতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শ্রেণিকার্যক্রম ফলপ্রসূভাবে তরান্বিত করে শিক্ষক ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রশাসনের আন্তরিকতায় শিক্ষার্থীদের পড়াশোনায় মনোযোগী করাতে হবে ও পাঠক্রম শেষ করতে হবে। সেশন জট নিরসন করে পরীক্ষা সম্পন্ন করে ছাত্রদেরকে যথাসময়ে গ্রাজুয়েট করার কাজটি করতে হবে। স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষাকেন্দ্রও এ বিষয়ে উদ্যোগী হবে হবে। পাশাপাশি রাখতে হবে সাহিত্য সংস্কৃতির চর্চা।

দ্বিতীয়ত সরকারের সকল সরকারি, আধাসরকারী, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের সকল শূন্যপথে নিয়োগের কার্যক্রম শুরু করে তা দ্রুত নিয়োগের কাজ শেষ করতে হবে, যেন কিশোর-তরুণ শিক্ষার্থীরা সরকারি সেক্টরে নিজেদের নিয়োগের সুযোগ পায়।

তৃতীয়ত কর্পোরেট সেক্টরের সকল শিল্প কারখানা, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, সকল সেক্টরাল ইন্ডাস্ট্রিগুলোতে কাজের পরিবেশ বিদ্যমান রাখা ও শূন্যপদে নিয়োগ সম্পন্ন করানো এবং নতুন নতুন সেক্টর সৃষ্টির মাধ্যমে কর্মসৃজনের পন্থা বের করতে হবে। এক্ষেত্রে সরকারের সহযোগিতার পাশাপাশি কর্পোরেট সেক্টরের সকল মালিক, উদ্যোক্তা ও নেতৃত্বদের দায়িত্ব পালন করতে হবে।

চতুর্থ বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ ছাড়াও যেসব কারিগরি ও বিশেষ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রশিক্ষণ ও দক্ষতা বৃদ্ধির কাজ করে থাকে তারা তরুণ শিক্ষার্থীদের একটি বড় অংশকে স্কিল দেওয়া ও প্রশিক্ষণ প্রদান করে জব মার্কেটের জন্য প্রস্তুত করতে পারে। বিশেষ করে জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ ও যুব অধিদপ্তর এ বিষয়ে বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারে।

পঞ্চম শিক্ষার্থী যারা দেশের ক্রান্তিলগ্নে স্বৈরাচার হটাতে ও বাকস্বাধীনতা ও গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনতে জীবন বাজি রেখে ৭১ এর মতো ঝাঁপিয়ে পড়তে পেরেছে, তারা একটু মনোযোগী হয়ে চেষ্টা করলে যে কোনো ব্যবসায়, পেশায় সফল হতে পারবে। সরকার ও কর্পোরেট সেক্টরের পাশাপাশি তরুণ শিক্ষার্থীদেরকেও স্বপ্ন দেখতে হবে। তবেই তারা কর্মক্ষেত্রে নিজের জীবন সুন্দর রাখার পাশাপাশি দেশ গঠনেও ভূমিকা রাখতে পারবে।

ষষ্ঠ দেশের অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা দূর করে ব্যাংক ও ব্যবসা বাণিজ্যকে শক্ত ভিতে দাঁড় করাতে হবে। চাকুরি ও বিনিয়োগের সুযোগ বৃদ্ধি করে তরুণ ও নতুন উদ্যোক্তাদেরকে সুযোগ সৃষ্টি করে দিতে হবে। তরুণদের উদ্ভাবন ও সৃজনশীল চিন্তার প্রতি উৎসাহিত করতে হবে। উদ্যোক্তা হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করে দেওয়া যেতে পারে যাতে তারা নিজ নিজ ক্ষেত্রে উন্নতি করতে পারে এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত করতে পারে।

সপ্তম গণঅভ্যুত্থান পরবর্তীতে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় কাঠামোর পরিবর্তন ঘটছে বা ঘটবে। অনেক ক্ষেত্রে নতুন অর্থনৈতিক সুযোগ ও চাহিদা তৈরি হতে পারে। তরুণদের উচিত সেই অনুযায়ী নতুন দক্ষতা অর্জন করা। টেকনোলজিক্যাল স্কিল যথা সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট, ডেটা সায়েন্স, ডিজিটাল মার্কেটিং, ই-কমার্স ইত্যাদি দক্ষতা অর্জন করা; কৃষিভিত্তিক দক্ষতা যথা কৃষি বা গ্রামীণ অর্থনীতি মজবুত হবে এমন কৃষি প্রযুক্তি সম্পর্কিত জ্ঞান অর্জন করা; ফ্রিল্যান্সিং যথা ফ্রিল্যান্সিং প্ল্যাটফর্মে কাজ করে আয়ের সুযোগের সম্ভাবনা বাড়ানো যায়।

অষ্টম তরুণ শিক্ষার্থীদের যারা রাজনীতিক হতে আগ্রহী তারা রাজনৈতিক সংগঠনে যুক্ত হতে পারে। গণঅভ্যুত্থানের ফলাফল যেন তরুণদের রাজনৈতিকভাবে সম্পৃক্ত করে সেরকম পথ বের করতে হবে। তারা রাজনীতিতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করলে ভবিষ্যতে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো মজবুত হবে এবং জনগণের চাহিদা পূরণে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারবে।

মানুষের আশাবাদী হওয়াই পরম লক্ষ্য৷ আশাবাদী না হলে মানুষ বাঁচতে পারে না, টিকে থাকতে পারে না৷ আমরা আশা করছি নতুন সরকার সব পরিস্থিতি সামলে নিয়ে একটা নতুন নির্দেশনা জাতির সামনে শিগগিরই তুলে ধরবে৷ আর প্রতিটি পরিবার ও সমাজের সকল অনুষঙ্গও নতুন প্রজন্মকে ভবিষ্যৎ গড়তে আন্তরিক হবে।

Comments

The Daily Star  | English

Plane with 64 abroad collides with helicopter near Washington airport, 2 bodies recovered so far

The regional passenger plane from Kansas crashed into Potomac River after the mid-air collision

1h ago