হারিয়ে যাওয়া সোনার মানুষ

হাবিবুর রহমান। আমাদের হাবিব ভাই। ১৯৫৩ সালের ফাল্গুন মাসে মানিকগঞ্জে জন্মে ছিলেন। ১৯৭১ সালে সত্যি সত্যিই হাবিব ভাইয়ের জীবনে আঠারো বছর বয়স নেমে এসেছিল।

"আঠারো বছর বয়সেই অহরহ

বিরাট দুঃসাহসেরা দেয় যে উঁকি।

আঠারো বছর বয়সের নেই ভয়

পদাঘাতে চায় ভাংতে পাথর বাধা,

এ বয়সে কেউ মাথা নোয়াবার নয়-

আঠারো বছর বয়স জানে না কাঁদা।"

হাবিব ভাই মুক্তিযুদ্ধ করেছেন। স্বাধীনতা যুদ্ধে বিজয়ী হয়ে নিজেকে জড়িয়েছেন সমাজের বৈপ্লবিক পরিবর্তনের বিবিধ লড়াইয়ে। সেই থেকে নানান রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে, সংগঠন গড়ে তোলায় উৎসর্গ করেছেন জীবনের প্রতিটি দিন। ২০১৬ সাল থেকে আমৃত্য ছিলেন রাষ্ট্রনৈতিক জার্নাল 'রাষ্ট্রচিন্তা'র সম্পাদক। পাশাপাশি চিন্তামূলক ও বুদ্ধিবৃত্তিক সংগঠন হিসেবে 'রাষ্ট্রচিন্তা'কে গড়ে তুলতে ভূমিকা রেখেছেন উদ্যোক্তা সংগঠকের।     

গত বছেরর হাবিব ভাই মারা যাওয়ার ১১-১২ দিন আগে, ৫ অক্টোবর বৃহস্পতিবার; ধানমণ্ডির বেঙ্গল বুকে শেষ সামনাসামনি বসে কথা হয় আমার। সেদিন থেমে থেমে ঝুম ঝুম বৃষ্টি হচ্ছিল। আমাদের পল্টনের দিকে দেখা করার কথা ছিল। কিন্তু বেশ বৃষ্টি থাকায় মিরপুর থেকে বের হতে চাইছিলাম না। হাবিব ভাই বললেন, আপনি বাসায় থাকলে, আমি আসি। আমি বাধ্য হলাম, বেঙ্গল বুকে আসতে।

কাজের কথা তখন শেষ। তাও বসে আছি দু'জন। হঠাৎ কী মনে করে জিজ্ঞেস করলাম: হাবিব ভাই, এই দেশ রাজনীতির বাইরে, আপনার সবচে ভালো লাগের অনুভূতি কী? হাবিব ভাইয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে আছি আমি- মুখটা সম্ভবত একটু উজ্জ্বল হয়ে উঠলো- আমি উনাকে ঠিক ঠিক উদ্ধৃত করতে পারব না- তবে যা বললেন তা হলো:

আমার ছেলেটা সলিমুল্লাহ মেডিকেলে চান্স পাবে- এইটা আমি ভাবিনি। একেবারে নিজের চেষ্টায়, নিজের মেধায় মেডিকেলে চান্স পাইছিল। আমি কিছুটা মজা করেই বললাম, আর মেয়েটাকে তো পাচার করে দিছেন ইউরোপে। হাবিব ভাই, হেসে দিলেন, তাঁর সেই নির্মল হাসি। বললেন: আমি কিছুই করিনি, যা করার সব ও নিজে নিজে করছে। আমি কথা চালিয়ে নিতে বা হয়তো খুব সাধারণভাবে কথার পিঠে জিজ্ঞেস করলাম, কিন্তু আপনি যদি কিছু না করেন তাইলে সবাই এতো দূর এলো কীভাবে? ভাই, এবার যেন শোনা যায় না এমন স্বরে, আত্মগতভাবে, কিছুটা যেন অপরাধ বা অপারগতার রেশ মিলিয়ে বললেন, যা কিছু করছে সব ওদের মা। তবে গ্রামে না থেকে ঢাকায় থাকার সিদ্ধান্তটা সঠিক ছিল।

আমি দুষ্টামির স্বরে বললাম, হুম ঢাকায় না থাকলে মেয়েটারে ইউরোপে পাচার করা সম্ভবত সহজ হইতো না। আমরা যারা টাকা পাচার করতে পারি না তারা তো ছেলেমেয়েদের পাচার করার জন্যই রেডি করি। হাবিব ভাইয়ের কণ্ঠে এবার একটা হতাশার সুর- দেশটা স্বাধীন হয়ে হলো কি বলেন তো? মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলেমেয়েরা যদি সব বাইরে চলে যায়, তাহলে এই দেশের ভবিষ্যত কী? দুষ্টামি ধরে রেখেই উত্তর দেই, ভবিষ্যৎ পরিষ্কার বলে দিতে পারি। এক্কেবারে অন্ধকার। ভাই এবার মাথা নাড়িয়ে প্রতিবাদ করে উঠলেন- না না তা না। আমি অনেক সম্ভবনা দেখি। আপনি বুঝতেছেন না। দেশটা পরিবর্তনের জন্য তৈরি। আমি কইলাম, আপনি এই সম্ভবনা দেখেন বলেই তো আমারে ঘোর বৃষ্টির মধ্যে আসতে হইলো। ভাই, হঠাৎ তাড়াবোধ করলেন, বললেন এই নিয়ে আরেক দিন কথা হবে, আমার আর একটা জায়গায় যাওয়ার কথা। বৃষ্টি তখনও ঝরছে, হাবিব ভাই চলে গেলেন, আমার কাছে থেকে শেষ বারের মতো।

শনিবার, সাত তারিখ টেলিফোনে আবার কথা হয় হাবিব ভাইয়ের সঙ্গে। প্রসঙ্গ অবশ্যই রাষ্ট্রচিন্তা। গত কয়েকটা বছরে পরিবারের বাইরে হাবিব ভাই ছাড়া আর দ্বিতীয় কেউ নাই যার সাথে আমার এতো কথা হয়েছে। অনুমান করতে পারি, রাষ্ট্রচিন্তার সাথে সংশ্লিষ্ট আরো অনেকেই বলবেন, বিগত দিনগুলোতে হাবিব ভাইয়ের সাথেই তার সবচে বেশি কথা হয়েছে। কারণ, রাষ্ট্রচিন্তার জন্য নিবেদিত প্রাণ এই মানুষটা রাষ্ট্রচিন্তাকে দাঁড় করাতে করতে হয় বা করা যায় এমন হেন উদ্যোগ নাই যা নিতে পিছপা হতেন। হাবিবভাই, রাষ্ট্রচিন্তাকে সম্ভবত তাঁর জীবনের অংশ করে নিয়েছিলেন।

আমাদের এই অঞ্চলে কিছু মানুষকে "ঈশ্বর" সম্বোধন করা হয়। রাম থেকে শচীন- এমন অনেকেই এই "ঈশ্বর" উপাধি পেয়েছেন। এই "ঈশ্বর" উপাধি পাওয়া মানুষদের মধ্যে সাধারণ যে বৈশিষ্ট্য রয়েছে তা হলো: নিজের দুঃখ-কষ্ট-যন্ত্রণা-বেদনা পাত্তা না দিয়ে, পরিবার-পরিজনের প্রয়োজন-চাওয়া-পাওয়া উপেক্ষা করে যে কাজের জন্য তারা নিজেদের একবার নিয়োজিত করেছেন সেই কাজ তাঁরা করে গেছেন অটল-অবিচলভাবে। রাষ্ট্রচিন্তা নিত্য যে কাজগুলো করে, দেশের বিবেচনায় তা হয়তো খুবই সামান্য, খুবই ছোট ছোট কাজ। কিন্তু নিত্য দিনের সেই কাজগুলো হাবিব ভাই নিজের, নিজের পরিবারের সকল চাওয়াপাওয়াকে অতিক্রম করে এমন পরম নিষ্ঠার সাথে, যত্নশীল চেষ্টা দিয়ে করে গেছেন যে এই নিত্যকর্ম হাবিবভাইকে করে তুলেছিল রাষ্ট্রচিন্তার "ঈশ্বর"।

আমরা, রাষ্ট্রচিন্তা; গত ১৬ অক্টোবর, আমাদের এই নিত্যকর্মের ঈশ্বরকে নিত্যদিনের ব্যবহার্য্যতায় হারিয়েছি। কিন্তু আমি নিশ্চিত, রাষ্ট্রচিন্তার আকাশ বলে যদি কিছু কল্পনা করে নেই, তবে সেই আকাশে হাবিব ভাই নিত্যকর্মে ঈশ্বর হয়েই থাকবেন, জ্বলজ্বলে এক তারার মতো আমরা আকাশে খুঁজে পাব তাঁকে।

Comments

The Daily Star  | English

Economic expectations: Did govt fall short?

When an interim government was sworn into office following the ouster of the Awami League regime just 100 days ago, there was an air of expectation that the Prof Muhammad Yunus-led administration would take steps to salvage a scam-ridden financial sector and rescue an ailing economy.

6h ago