‘যোগ্যদের না দিয়ে নিজেদের মালিককে ঋণ দেয় ব্যাংক’
সাম্প্রতিক বছরগুলোয় দেশের ব্যাংকিং খাত সঠিকভাবে পরিচালিত হয়নি। বেশিরভাগই ব্যাংক যোগ্য ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে ঋণ না দিয়ে দিয়েছে তাদের মালিকদের। এর ফলে বেশ কয়েকটি ব্যাংক এখন আর্থিক সংকটে পড়েছে।
এ ছাড়াও, আগের সরকার কার্যকরভাবে টাকার বিনিময় হার নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি। শুধু তাই নয়, তারা প্রচলিত আর্থিক ব্যবস্থার বিপরীতে কাজ করেছিল।
বিগত সরকার টাকার নির্দিষ্ট বিনিময় হার নিয়ন্ত্রণের পথ বেছে নিয়েছিল। প্রতিবেশী ভারতে রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়া (আরবিআই) রুপির দাম কমানোর অনুমতি দিয়েছিল, যাতে এর প্রতিযোগিতামূলক বিনিময় হারে নেতিবাচকভাবে প্রভাব না পড়ে।
বিশ্বব্যাংকের দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের ভাইস প্রেসিডেন্ট মার্টিন রেইজার বলেন, 'এ কারণে বাংলাদেশে রিজার্ভের ক্ষতি হয়েছে। তারল্য কমে যাচ্ছে।'
তার মতে, বাংলাদেশ যদি পাঁচ-ছয় বছর আগে এ ধরনের নীতি গ্রহণ করত, তাহলে তারল্য সংকট দেখা দিত না।
গত সপ্তাহের শেষের দিকে ঢাকায় দ্য ডেইলি স্টারকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে মার্টিন রেইজার বলেন, 'বাংলাদেশ ব্যাংক বর্তমানে এসব নিয়ে কাজ করছে।'
'আমি মনে করি, তারা ভালো কাজ করছেন। তবে ব্যাংককে শক্তিশালী করতে এবং শেষ পর্যন্ত ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগে আরও ঋণ দেওয়ার জন্য আর্থিক খাতকে সংস্কারের অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু করা দরকার।'
গত মাসের দ্বিতীয়ার্ধে ঢাকা সফরে আসা মার্টিন রেইজার বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি, ক্রমাগত মূল্যস্ফীতির কারণ, কম পরিমাণে রাজস্ব আদায় ও রুগ্ন ব্যাংকিং খাতকে উদ্ধারে প্রয়োজনীয় সংস্কারের কথাও বলেছেন।
গত ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনার সরকারকে সরানোর পর অন্তর্বর্তী সরকারের অনুরোধে সাড়া দিয়ে বিশ্বব্যাংক সার্বিক সহায়তার কথা বিবেচনা করছে—এমন প্রশ্নের জবাবে বিশ্বব্যাংকের এই কর্মকর্তা বলেন, শুধু সাম্প্রতিক সময়ে নয়, বাংলাদেশ সত্যিই অনেক ভালো করেছে। স্বাধীনতার পর থেকে এর উন্নয়ন লক্ষণীয়।
'আমরা সব সময় বাংলাদেশকে সফলতার নজির হিসেবে বিবেচনা করে এসেছি।'
তার দৃষ্টিতে, করোনা মহামারি সব দেশের অর্থনীতিতেই বিরূপ প্রভাব পড়েছে। বাংলাদেশের ওপরও খারাপ প্রভাব পড়েছে। বৈশ্বিক মন্দার কারণে এ দেশ পুরোপুরি ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি।
'বাংলাদেশ আরও উন্নত হচ্ছে। শুধু তৈরি পোশাকের ওপর গুরুত্ব দেওয়া ঠিক হবে না। কেননা, উৎপাদনশীলতায় প্রবৃদ্ধির সীমাবদ্ধতা আছে। বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকটের পর থেকে বাংলাদেশ অর্থনীতিতে বৈচিত্র্যকরণ, আরও বেশি পরিমাণে বিদেশি বিনিয়োগ আনা, আরও প্রযুক্তি আনা ও নানান ক্ষেত্রে কর্মসংস্থান সৃষ্টির সুযোগ হারিয়েছে।'
সমতার প্রয়োজন
মার্টিন রেইজার জানান, তিনি পাঁচ-ছয়বার বাংলাদেশে এসেছেন। তিনি উদ্যোক্তাদের সামর্থ্য দেখেছেন।
'রিকশাচালক থেকে শুরু করে ছোট উদ্যোক্তা, ফ্যাশন ডিজাইনার থেকে শুরু করে গিগ অর্থনীতি পর্যন্ত অনেকে বিনিয়োগ করতে, ব্যস্ত থাকতে ও জীবনযাত্রারমান উন্নতি করতে প্রস্তুত। ঋণের সুযোগ পেলে এটি আরও বাড়তে পারে। এটি আরও বেশি কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে পারে।'
'তবে সমতার অভাবে সবাই সব সুবিধা পাচ্ছেন না। সুতরাং, এই জায়গাগুলোয় বাংলাদেশ সম্প্রতি খুব ভালো করতে পারেনি। আরও ভালো করতে পারত।'
'গত প্রশাসন অবকাঠামো খাতে প্রচুর বিনিয়োগ করেছিল। এটা ভালো কাজ ছিল। এর ফলে যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত হয়েছে। কিছু ইতিবাচক দিক আছে যার ওপর ভিত্তি করে বাংলাদেশকে গড়ে তোলা যেতে পারে এবং তা করা উচিত।'
সামগ্রিক ঋণ প্রায় সাড়ে তিন বিলিয়ন ডলার হবে
মার্টিন রেইজার জানিয়েছেন, অন্তর্বর্তী সরকার জ্বালানি ও ব্যাংকিং খাতে সংস্কারের জন্য বাজেট সহায়তার অনুরোধ করেছে।
নতুন ঋণের পরিমাণ প্রায় দুই দশমিক দুই বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে এক বিলিয়ন ডলারেরও বেশি পুনঃতফসিলি করা ঋণ আছে। সামগ্রিক ঋণ প্রায় সাড়ে তিন বিলিয়ন ডলার হবে।
এই বিশ্বব্যাংক কর্মকর্তা আরও বলেন, জ্বালানি ও সামাজিক সহায়তার জন্য ব্যাংকিং, কর সংস্কার, সুশাসন ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে কী করা যায় তা নিয়ে বিশ্বব্যাংক ও সরকার আলোচনা করছে।
'এর মধ্যে কিছু আলোচনা সাম্প্রতিক পরিবর্তনের আগের। কিছু আলোচনা নতুন।'
ব্যাংকিং খাতে স্বচ্ছতা প্রয়োজন
বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে আরও স্বচ্ছতা দেখতে চায় বলে জানান মার্টিন রেইজার।
তিনি বলেন, 'যারা ব্যাংকে টাকা রাখেন তাদের জানা উচিত ব্যাংকগুলোর সুবিধাভোগী মালিক কারা। ব্যাংক কর্মকর্তারা যখন ঋণ দেন, তখন তাদের জানা উচিত যে এর সুবিধাভোগী মালিক কারা এবং কাকে টাকা দেওয়া হচ্ছে।'
'আমি বলতে চাচ্ছি, নিজেদের লোকদের ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে ব্যাংক সাধারণত কঠোর নীতি মেনে চলে। আপনি যদি ব্যাংকের মালিক হন, তাহলে সেই ব্যাংককে আপনার মালিকানাধীন ব্যবসার জন্য ব্যবহার করতে পারবেন না।'
বিশ্বব্যাংকের ভাইস প্রেসিডেন্ট আরও বলেন, 'কেউ সময়মতো ঋণ পরিশোধ করতে না পারলে তার সম্পদ শ্রেণিবদ্ধ হয়ে যায়। ঋণ শ্রেণিবদ্ধ হয়ে গেলে ব্যাংককে ভিন্ন নিয়ম রাখতে হয়। তাদের মূলধন সরিয়ে নিতে হয়।'
'এটা ব্যাংকের জন্য ব্যয়বহুল। তাই ব্যাংকগুলো এটি পছন্দ করে না। তবে তাদেরকে বাধ্য করতে হবে। কারণ যদি ব্যাংকের পর্যাপ্ত মূলধন না থাকে তবে এক পর্যায়ে আমানতকারীরা তাদের টাকা ফেরত নাও পেতে পারেন।'
'বাংলাদেশে আরও ভালো ঋণ শ্রেণিবদ্ধকরণ ব্যবস্থা থাকতে হবে' বলেও মনে করেন তিনি।
তার ভাষ্য, আমানতকারীদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা এবং যারা ব্যাংককে ভুল পথে পরিচালিত করেন তাদের জবাবদিহিতার আওতায় আনার ব্যবস্থা নিতে হবে।
বিষয়টিকে আধুনিক ও সুষ্ঠুভাবে কার্যকর ব্যাংকিং ব্যবস্থার মূল উপাদান হিসেবে আখ্যা দিয়ে তিনি বলেন, 'দেউলিয়া আইন ও ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদ ব্যবস্থাপনায় আরও ভালো নিয়ম থাকা উচিত।'
'আপনি জনগণকে রক্ষা করতে চান, কিন্তু আপনি প্রতিটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে রক্ষা করতে চান না। যদি এটি কাজ না করে তবে মূলধনের উৎসগুলোর দিকে নজর দিন, ঋণ নিন এবং এটি অন্য কোথাও রাখুন যেখানে এর সাফল্যের ভালো সম্ভাবনা আছে।'
'পুনর্গঠনের প্রক্রিয়া ও আরও প্রতিযোগিতা তৈরি করা ব্যাংকিং সংস্কারের পরিপূরক। তবে এতে আরও সময় লাগবে।'
সংস্কারের বিষয়ে তার মত—জনগণের প্রত্যাশাকে অন্তর্বর্তী সরকারের অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত।
'একটি বিষয় আমি খুব জোরেশোরে শুনেছি। তা হলো—আরও জবাবদিহিতা, স্বচ্ছতা ও সুশাসন। এটি এমন কিছু যা তারা করতে চান এবং তাদের করা উচিত। জনগণ এটিই প্রত্যাশা করে।'
তিনি আরও বলেন, 'অন্তর্বর্তী সরকার অবশ্যই রাজনৈতিক ও বিচার ব্যবস্থা এবং আইনশৃঙ্খলায় সমন্বয় করতে চায়। এটা বিশ্বব্যাংকের বিষয় নয়। আমাদের বিষয় হচ্ছে অর্থনীতির ব্যবস্থাপনা।'
আরও রাজস্ব সংগ্রহ মূল অগ্রাধিকার
মার্টিন রেইজার বলেন, বিশ্বব্যাংক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার উন্নয়নে সহায়তা করতে পারে। রাজস্ব ব্যবস্থাপনা এমন একটি ক্ষেত্র যেখানে বাংলাদেশের কাজ করা উচিত।
'রাজস্ব কর্তৃপক্ষ কম পরিমাণে কর আদায় করছে। এর জনসম্পদ সীমিত।'
শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবায় সরকারকে আরও বেশি খরচ করতে হবে।
'আমি মনে করি আরও রাজস্ব সংগ্রহ করা গুরুত্বপূর্ণ অগ্রাধিকার। আমরা কর প্রশাসন ও করনীতির ক্ষেত্রে সহায়তা করতে পারি।'
'একটা উদাহরণ দিই, বাংলাদেশে অনেক ছাড় পাওয়া যায়। কিছু ছাড় বিশেষ প্রতিষ্ঠানকে দেওয়া হয়। এটা ভালো করনীতি না।'
আরও ভালো সরকারি ব্যবস্থাপনা ও সরকারি ক্রয় প্রক্রিয়ার ওপর জোর দিয়ে তিনি প্রশ্ন রাখেন, 'কোন ব্যবস্থায় প্রকল্প অনুমোদন হয়? এর পেছনে কারণ কী? প্রক্রিয়াটি কতটা কার্যকর?'
বলেন, 'মধ্যমেয়াদে ব্যবসার পরিবেশ উন্নত করা, প্রতিষ্ঠানগুলোকে বিনিয়োগের অনুমতি ও কারখানার জন্য সহজে জমি পাওয়ার ব্যবস্থা করা জরুরি। সরকারকে পরিবেশগত বিধিবিধান উন্নত করতে হবে। সেগুলোর প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে।'
'একটি দেশের পরিবেশ দূষিত করে প্রতিযোগিতামূলক হওয়ার চেষ্টা দীর্ঘমেয়াদে লাভ হয় না। শেষ পর্যন্ত জনগণকেই এর খেসারত দিতে হয়।'
মূল্যস্ফীতি কমবে
প্রতিবেশী ভারত যখন মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনতে পেরেছে, তখন বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতি কেন বেশি?—জবাবে বিশ্বব্যাংকের এই কর্মকর্তা বলেন, 'গত জুলাই ও আগস্টে পণ্য সরবরাহ ব্যবস্থায় বড় ধরনের বিঘ্ন ঘটেছিল। এটি মূল্যস্ফীতি বাড়িয়ে দিয়েছে।'
'কিছুদিন আগেও মুদ্রানীতিও তুলনামূলকভাবে ঢিলেঢালা ছিল।'
'প্রকৃত সুদের হার নেতিবাচক ছিল। এসব কারণ মিলে সম্ভবত এমন একটি পরিস্থিতির দিকে গিয়েছে যেখানে পণ্য সরবরাহ সীমিত ছিল। চাহিদা এখনো থাকায় মূল্যস্ফীতি বেড়েছে।'
'আমি মনে করি, নতুন সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। মূল্যস্ফীতি কমার সম্ভাবনা আছে।'
'এটা তাৎক্ষণিকভাবে নাও হতে পারে। যথাযথ পদ্ধতি মেনে কাজ করতে কিছুটা সময় লাগে।'
Comments