গণমাধ্যম কমিশন যেন সেন্সরশিপের বাহন না হয়: জাতিসংঘের বিশেষ র্যাপোর্টিয়ার আইরিন খান
'মুক্ত গণমাধ্যম গণতান্ত্রিক সমাজের একটি স্তম্ভ। কিন্তু বিশ্বের অনেক জায়গায় গণমাধ্যমের স্বাধীনতা হুমকির মুখে রয়েছে।'
দ্য ডেইলি স্টারকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এই কথা বলেছেন জাতিসংঘের মুক্তচিন্তা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার বিকাশ ও সুরক্ষাবিষয়ক বিশেষ র্যাপোর্টিয়ার আইরিন খান।
শেখ হাসিনার শাসনামলে বাংলাদেশে গণমাধ্যমকে ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে উল্লেখ করে আইরিন খান বলেন, 'এই খাতকে পুরোপুরি করায়ত্তের মাধ্যমে অধীনস্থ করে রাখা হয়েছিল। এতে অনেক সাংবাদিক হতাশ হয়ে পেশাই ছেড়ে দিয়েছেন। অল্প কিছু সংবাদমাধ্যম রাষ্ট্রক্ষমতার সামনে সত্য বলার সাহস রাখত।'
মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের সাবেক এই প্রধান বলেন, মত প্রকাশের স্বাধীনতা একটি মৌলিক মানবাধিকার, যা আন্তর্জাতিক আইন দ্বারা সুরক্ষিত। শুধুমাত্র অল্পসংখ্যক পরিস্থিতিতে ও সুনির্দিষ্ট আইনি ব্যাখ্যা ছাড়া এই অধিকার সীমাবদ্ধ করা যাবে না। কিন্তু হাসিনা সরকার গণমাধ্যমের কণ্ঠরোধ করতে এমন সব আইন করেছে, যা আন্তর্জাতিক আইন কোনোভাবেই সমর্থন করে না।
গণমাধ্যমের স্বাধীনতার সুরক্ষা ও একে আরও শক্তিশালী করতে অন্তর্বর্তী সরকারের উচিত এই খাতের সংস্কার করা। সেই সঙ্গে বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে গণমাধ্যমেরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আনতে হবে বলে মনে করেন তিনি।
আইরিন খান বলেন, 'মানুষ গণমাধ্যমকে বিশ্বাস করে না। বেশিরভাগ গণমাধ্যম বিনা দ্বিধায় পূর্ববর্তী সরকারের মিথ্যাচার প্রচার করেছে। তাদের সাংবাদিকতাও খুব নিচু মানের। ফ্যাক্ট-চেকিং ছাড়াই ভুয়া সংবাদ প্রচার করা হয়েছে।'
তিনি আরও বলেন, ক্ষমতাবানদের জবাবদিহি ও অন্যায়ের কথা জনগণের সামনে প্রকাশ করার ক্ষেত্রে সাংবাদিকতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কিন্তু এই ধরনের জনসেবামূলক সাংবাদিকতার জন্য সাংবাদিকদের কিছু নীতি ও পেশাগত মান মেনে চলতে হয় এবং সর্বোপরি সত্য প্রকাশে দ্ব্যর্থহীন অঙ্গীকার থাকতে হয়।
'বাংলাদেশের গণমাধ্যমের ক্ষেত্রে সেই দায়িত্বশীল নিয়ন্ত্রণ বা নিজেকে তদারকি করার বিষয়টি অনুপস্থিত', বলেন আইরিন খান।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের গণমাধ্যম সংস্কার কমিশন গঠনের ভাবনা সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এই কমিশন কী করবে, তা এখনো পরিষ্কার নয়। গণমাধ্যমের ওপর কঠোর রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় যাতে কমিশনকে ব্যবহার না করা হয়, সেই বিষয়ে তিনি সরকারকে সতর্ক করেছেন।
'যেসব দেশে গণমাধ্যমের ওপর রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ বেশি, যেমন: ইরান বা চীন, তাদের গণমাধ্যমের স্বাধীনতা কিংবা তথ্যের ওপর জনগণের আস্থা—কোনোটিই নেই।'
একটি গণতান্ত্রিক দেশে গণমাধ্যমের ওপর রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ এমনই সাধারণ হওয়া উচিত যাতে নানা উৎস থেকে আসা বিভিন্ন ধারণা, তথ্য ও দৃষ্টিভঙ্গি অবাধে প্রবাহিত হতে পারে। গণমাধ্যম কমিশন যেন সেন্সরশিপের বাহন না হয়।
আইরিন খান মনে করেন, গণমাধ্যম প্রতিনিধি, আইন বিশেষজ্ঞ ও সুশীল সমাজের সমন্বয়ে গঠিত একটি মিডিয়া কমিশন সাংবাদিকতার মান ও নৈতিকতা প্রণয়ন, দক্ষতা ও সক্ষমতা উন্নয়নকে উৎসাহিত করা এবং গণমাধ্যম খাতে যথাযথ চর্চার প্রচারে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। 'বিশ্বাসযোগ্য ও কার্যকর হতে হলে এ ধরনের কমিশন হতে হবে স্বাধীন ও রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত হতে।'
গণমাধ্যম কমিশন গণমাধ্যম সম্পর্কে জনগণের কাছ থেকে অভিযোগ গ্রহণ, তদন্ত এবং সেসবের সমাধান করতে পারে। 'এক্ষেত্রে আরেকটি বিকল্প হতে পারে ন্যাশনাল মিডিয়া অমবাডসম্যান।'
গণমাধ্যমের স্বাধীনতার প্রধান হুমকিগুলো সম্পর্কে জানতে চাইলে আইরিন খান সাংবাদিকদের ওপর হামলা, হামলাকারীরা শাস্তির মুখোমুখি না হওয়া, সাংবাদিকদের আইনি হয়রানি করা এবং গণমাধ্যম পরিচালনায় মালিকদের অস্বচ্ছতার কথা উল্লেখ করেন।
২০১৬ সালে ধারাবাহিক হত্যাকাণ্ড, ২০১২ সালে সাংবাদিক দম্পতির নৃশংস হত্যাকাণ্ড এবং সাংবাদিকদের ওপর সাম্প্রতিক হামলা ও হুমকির কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'দেশে ব্লগারদের হত্যা করা হয়েছে। সাগর-রুনির হত্যার বিষয়টিও অমীমাংসিত। অতীতে স্থানীয় সাংবাদিকদের ওপর হামলা হয়েছে এবং এখনো অনেকে হামলার শিকার হচ্ছেন।'
এসব পরিস্থিতির ব্যাখ্যাস্বরূপ তিনি বলেন, একজন সাংবাদিককে হত্যা করলে অনেকেই আর গলা তোলেন না। এর মাধ্যমে চারদিকে যেন একটা চাপা আশঙ্কা তৈরি হয়। এ জন্য সাংবাদিকদের সুরক্ষা নিশ্চিত এবং অভিযুক্তরা যাতে কোনোভাবেই দায়মুক্তি না পায়, সে বিষয়ে সরকারের করণীয়কে অনেকখানি গুরুত্বপূর্ণ করে তোলে।
আইনি হয়রানির বিষয়ে আইরিন খান বলেন, হাসিনা সরকারের ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন এবং সাইবার নিরাপত্তা আইনকে ব্যবহার করে 'অনলাইন জগৎ নিয়ন্ত্রণ' করার কথা উল্লেখ করেন। তিনি আরও উল্লেখ করেছেন, মানহানির অপরাধকে পূর্ববর্তী সরকার সাংবাদিক ও সম্পাদকদের বিচারের জন্য ব্যবহার করেছিল।
তিনি বলেন, 'গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে এমন নিপীড়নমূলক আইনের কোনো স্থান নেই। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উচিত এগুলো বাতিল করা এবং সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে বিচারাধীন মামলাগুলো অনতিবিলম্বে খারিজ করা।'
'মালিকানা বা আর্থিক প্রণোদনার কারণে গণমাধ্যমের ওপর যথেষ্ট রাজনৈতিক প্রভাব রয়েছে'। বড় ব্যবসায়ী বা প্রভাবশালী রাজনীতিবিদরা বাংলাদেশের প্রায় সব গণমাধ্যমের মালিক। পূর্ববর্তী সরকারও সংবাদমাধ্যমকে পুরস্কৃত বা শাস্তি দেওয়ার জন্য রাষ্ট্রীয় বিজ্ঞাপন বাজেটকে কাজে লাগিয়েছে।
আইরিন খান বলেন, গণমাধ্যমের মালিকানা যাতে গুটিকয়েক ক্ষমতাশালী ব্যক্তির হাতে কেন্দ্রীভূত না হয়, তা নিশ্চিত করতে সরকারের উচিত বিধি প্রণয়ন করা। গণমাধ্যমের স্বচ্ছতা ও সুশাসনকে উৎসাহিত করতে হবে, যাতে সম্পাদককে গণমাধ্যমের নীতিমালার স্বাধীনতার সঙ্গে আপস করতে না হয়। এ ধরনের সংস্কার জনমনে আস্থা তৈরিতে সহায়তা করবে।
'জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট সাংবাদিকতা একটি জনকল্যাণমূলক কাজ। সরকারকে অবশ্যই মত প্রকাশের স্বাধীনতার পাশাপাশি এটি সুরক্ষা করতে হবে।'
Comments