বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা ও শিক্ষকদের হারানো মর্যাদার খোঁজে
যেদিন থেকে শিক্ষকরা রাষ্ট্রের কাছে নিজের মর্যাদা দাবি করেছে, সেদিন থেকে তারা সমাজের কাছে মর্যাদা হারাতে শুরু করেছে। ব্রিটিশ শাসনের আগে বাংলায় শিক্ষক বা গুরুরা ছিলেন সমাজের সর্বোচ্চ মর্যাদার আসনে। অথচ, স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশে এখন সমাজে শিক্ষকের মর্যাদা তলানিতে।
কীভাবে আমরা এই জায়গায় এলাম? কীভাবে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা ধ্বংসের মুখে দাঁড়ালো? এর থেকে উত্তরণের উপায় কী?
এ নিয়েই কিছু কথা তুলে ধরতে চাই এই লেখায়।
কাজী কাদের নেওয়াজের 'শিক্ষকের মর্যাদা' কবিতা মনে থাকার কথা। বাদশা আলমগীর একদিন দেখেন, তার পুত্র শিক্ষকের পায়ে পানি ঢেলে দিচ্ছে আর শিক্ষক নিজের পা পরিষ্কার করছেন। শিক্ষক ভাবেন, এবার বুঝি তার প্রাণ যাবে রাজপুত্রকে দিয়ে পায়ে পানি ঢালানোর কারণে।
শিক্ষক কিছুক্ষণ ভেবে নিজের আত্মমর্যাদায় বলীয়ান হয়ে মনে মনে বললেন,
'শিক্ষক আমি শ্রেষ্ঠ সবার
দিল্লীর পতি সে তো কোন্ ছার,
ভয় করি না'ক, ধারি না'ক ধার, মনে আছে মোর বল,
বাদশাহ্ শুধালে শাস্ত্রের কথা শুনাব অনর্গল।
যায় যাবে প্রাণ তাহে,
প্রাণের চেয়েও মান বড়, আমি বোঝাব শাহানশাহে।'
পরে বাদশাহ স্বয়ং শিক্ষককে ডেকে বলছেন, আমি দেখলাম আমার পুত্র কেবল আপনার পায়ে পানি ঢালছে, আর আপনি নিজে হাতে পা পরিষ্কার করছেন। আমার পুত্র কেন আপনার পায়ের ধুলি পরিষ্কার করলো না?
এই কবিতার মাধ্যমে ফুটে উঠেছিল সমাজে একজন শিক্ষকের মর্যাদা ঠিক কতটা উপরে। পাশাপাশি শিক্ষাগুরুর আত্মমর্যাদা বোধ কতটা হওয়া দরকার সেটাও শিক্ষকদের বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছিল।
এই কবিতা পাঠ্যবইয়ে অন্তর্ভুক্ত করার মাধ্যমে শিক্ষার্থী ও শিক্ষক উভয়পক্ষকেই তাদের দায়িত্ব-কর্তব্য সম্পর্কে অবহিত করা হয়েছিল।
কবিতাটি আর পাঠ্যবইয়ে নেই।
যেদিন থেকে শিক্ষকতাকে আমরা আর দশটা পেশার মতো দেখতে শুরু করেছি রাষ্ট্র হিসেবে, সমাজ হিসেবে—সেদিন থেকে দেশের শিক্ষাব্যবস্থার মান নিম্নমুখী হতে শুরু করেছে। এই পতন আরও দ্রুত নিম্নমুখী হয়েছে যখন সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন সময়ে নানা আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো শিক্ষক নিয়োগ পদ্ধতি।
নব্বইয়ের দশক থেকে শুরু করে গত ৩০ বছরে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকতা পেশাটাকে আমরা এমন জায়গায় নিয়ে গিয়েছি যে মেধাবীরা আর প্রাথমিকের শিক্ষক হতে চায় না। আর ভালো শিক্ষক না পাওয়ায় প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষার মান উন্নয়নের সুযোগ আমাদের নষ্ট হয়ে গেছে।
অন্যদিকে নতুন শিক্ষাপদ্ধতি বা কারিকুলাম প্রণয়ন করার পর তা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
শিক্ষকরা যেদিন থেকে নিজেদেরকে সাধারণ চাকরিজীবী বা সরকারি কর্মচারী হিসেবে মনে করতে শুরু করেছেন, সেদিন থেকে রাষ্ট্রও তাদেরকে সেভাবেই ব্যবহার করতে শুরু করেছে।
স্বল্প বেতনে নিয়োগ পাওয়া শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের কিসে ভালো হবে তা না ভেবে, বরং নিজেদের ব্যক্তিগত সুবিধাদি পাওয়ার দিকে মনযোগ দিয়েছেন বেশি।
স্কুলে শেখানোর চেয়ে প্রাইভেট পড়িয়ে শেখানোতে বেশি উৎসাহী হওয়ার জন্য এবং ক্ষেত্র বিশেষে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের প্রাইভেট পড়াতে বাধ্য করায় সমাজে এখন শিক্ষকদের মর্যাদা তলানিতে। আর এভাবেই গত কয়েক দশকে বাংলাদেশে শিক্ষকদের সামাজিক মর্যাদা কমে এসেছে।
ঘুষখোর সরকারি কর্মচারী, দুর্নীতিগ্রস্ত পুলিশ আর নীতিহীন শিক্ষকদের দুর্ভাগ্যজনকভাবে সমাজ এখন একই কাতারে বিচার করা শুরু করেছে।
শিক্ষকদের সামাজিক মর্যাদা লোপের সঙ্গে দেশের শিক্ষাব্যবস্থার হাল সরাসরি যুক্ত। একটা দেশের শিক্ষার মান উন্নয়নের ভিত্তির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধাপ হচ্ছে প্রাথমিক পর্যায়। প্রাথমিক পর্যায়কে ঠিক না করে পরবর্তী ধাপগুলোতে যতই পরিবর্তন আনা হোক, সেখান থেকে ভালো ফল আসবে না। যে শিক্ষার্থীর প্রাথমিক ভিত্তিই ঠিক হবে না, তাকে নিয়ে বেশি দূর আগানো যাবে না।
শিক্ষার আধুনিকায়ন ও মান উন্নয়নের কথা বলে দেশের শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে গত দুই দশক ধরে নানারকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা হচ্ছে। কিন্তু একটা জিনিস আমরা ভুলে যাচ্ছি, একটা দেশের শিক্ষাব্যবস্থা ততটাই উন্নত, যতটা উন্নত সেই দেশের শিক্ষকদের মান। তাই শিক্ষকদের বাদ দিয়ে শিক্ষাব্যবস্থার উন্নতির চিন্তা করা নিতান্তই হাস্যকর।
ইংরেজি মাধ্যম থেকে কওমি মাদ্রাসা, বাংলা মাধ্যম থেকে কিন্ডারগার্টেন—যেকোনো পদ্ধতির শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মেরুদণ্ড শিক্ষক। একজন মেধাবী, উদ্যমী ও দক্ষ শিক্ষক গাছতলায় বসেও শিক্ষার্থীদের শিখতে উদ্বুদ্ধ করতে পারেন।
অন্যদিকে, এসি ক্লাসরুমে ইন্টারনেট সংযোগওয়ালা মাল্টিমিডিয়া ব্যবস্থা থাকার পরও শিক্ষার্থীরা শেখার উৎসাহ পাবে না, যদি শিক্ষক সঠিক মানসিকতা ও দক্ষতাসম্পন্ন না হন।
আফসোসের কথা হচ্ছে সরকারের উচ্চমহল থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভবন, মাল্টিমিডিয়া, কম্পিউটার ল্যাব করার জন্য যতটা উৎসাহী, তার ছিটেফোঁটাও দেখা যায় না শিক্ষকদের মূল সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে। যেহেতু সেই সমস্যা সমাধান করায় কোনো তৎপরতা নেই, তাই আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থারও কোনো উন্নতি নেই।
শিক্ষকসহ শিক্ষা সংশ্লিষ্ট প্রায় সবাই মনে করেন, শিক্ষকদের মূল সমস্যা তাদের বেতন কাঠামোতে। তাদের বেতন স্কেল কম থাকায় শিক্ষকদের মধ্যে কাজ করায় উৎসাহ কম এবং মেধাবীরাও আসছেন না শিক্ষকতায়।
মেধাবীদের মধ্যে কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হতে উৎসাহের কমতি নেই। এর কারণ হলো, শুধু বেতন কাঠামো নয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের একটা আলাদা সামাজিক মর্যাদা আছে।
প্রাথমিক বা মাধ্যমিকের শিক্ষকদের বেতন-ভাতা বাড়ানো হলেই শিক্ষাদানের মান বেড়ে যাবে, শিক্ষকরা দারুণ উৎসাহিত হয়ে প্রাইভেট টিউশন ছেড়ে দিয়ে ক্লাসরুমে শিক্ষার্থীদের পড়াতে ও শেখাতে মনোযোগী হবেন—এমনটা ভাবার কোনো কারণ নেই।
সরকারি বেতন স্কেল কয়েক দফায় বাড়ানো হয়েছিল এই বলে যে এতে দুর্নীতি কমবে, সরকারি কর্মীরা সেবাদানে উৎসাহিত হবেন। কিন্তু আদতে তা হয়নি, বরং দুর্নীতি আরও বেড়েছে এবং সেবার মান আরও কমেছে।
সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরাও প্রজাতন্ত্রের চাকরিজীবী। তাদের বেতন বাড়ালে এখন শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পেতে যে পরিমাণ ঘুষ দিতে হয়, তার পরিমাণটাই শুধু বাড়বে। কিন্তু শিক্ষার মান ও শিক্ষকের মান কোনোটাই বাড়বে না।
বাংলাদেশ প্রাথমিক সহকারী শিক্ষক সমাজ গত ২২ আগস্ট প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা বরাবর বেশ কিছু প্রস্তাবনা ও সুপারিশ দিয়েছে প্রাথমিক শিক্ষা ক্ষেত্রে বিদ্যমান সমস্যা সমাধানে। সেখানেও শিক্ষকদের জীবনমান উন্নয়নে কিছু প্রস্তাব রাখা হয়েছে। জানি না সেই প্রস্তাবগুলোর কয়টা সুপারিশ আমলে আনা হবে, কিংবা বাস্তবায়ন হবে।
এটা নিশ্চিত যে আমাদের দেশের স্কুল-কলেজের শিক্ষকতায় তরুণ মেধাবীদের না আনতে পারলে দেশের শিক্ষাব্যবস্থার কোনো উন্নতি হবে না। অন্যদিকে বর্তমানে যেসব মেধাবী ও উদ্যমী শিক্ষকরা আছেন, তাদের বড় পরিসরে কাজ করার সুযোগ না দিলে তারাও উদ্যমহীন হয়ে পড়বেন। একজন মেধাবী ও উদ্যমী মানুষ নিজের কাজের পরিধি বাড়াতে চান, সমাজ পরিবর্তনে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে চান। সেই সুযোগটা কি আমাদের শিক্ষকদের ক্যারিয়ার গ্রাফে আছে?
একজন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক বড় জোর প্রধান শিক্ষক হতে পারেন। ক্ষেত্রবিশেষে উপজেলা শিক্ষা অফিসার হতে পারেন। কিন্তু সেটাও ২০২১ সালে নিয়োগবিধিমালা পরিবর্তন করে শুধু প্রধান শিক্ষকদের জন্য সুযোগ রাখা হয়। সহকারী শিক্ষকদের উপজেলা পর্যায়ে যাওয়ার রাস্তাও বন্ধ।
তাহলে কেন দেশের সেরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করা মেধাবী শিক্ষার্থীরা স্কুলশিক্ষক হতে চাইবে? সরকার যদি আগামীকালই একটা আইন করে যে একজন শিক্ষক তার মেধা ও পরিশ্রম দিয়ে ধীরে ধীরে সচিবালয় পর্যন্ত যেতে পারবে, তাহলেই পুরো সমীকরণ বদলে দেওয়া সম্ভব। শিক্ষকদের ক্যারিয়ার সচিবালয় পর্যন্ত না হোক, অন্তত জেলা শিক্ষা অফিসার হওয়া পর্যন্তও যদি বর্ধিত করা যায়, তাহলেও খুব ভালো ফল পাওয়া যেতে পারে।
রাজনৈতিকভাবে কিংবা আমলাতান্ত্রিক কারণে এ ধরনের উদ্যোগ কোনো রাজনৈতিক দলের পক্ষে হয়তো নেওয়া সম্ভব না। কিন্তু বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার চাইলেই এই অজনপ্রিয় কিন্তু অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তটি নিতে পারে। তাই সহকারী শিক্ষকদের অনেকগুলো সুপারিশ মানা সম্ভব না হলেও এই একটা সিদ্ধান্ত আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার অনেক সমস্যার সমাধান এনে দিতে পারে।
এমন সিদ্ধান্ত হলে তরুণদের কাছে সামাজিকভাবে ও ক্যারিয়ার বিবেচনায় শিক্ষকতা পেশা হয়ে উঠবে আরও আকর্ষণীয়। নতুন যোগদানকারী মেধাবী ও উদ্যমী তরুণরা ধীরে ধীরে স্কুলে শিক্ষার মান ফিরিয়ে আনতে পারবে। শিক্ষকদের মধ্যে মেধাবী ও দক্ষরা ক্যারিয়ারের সেরা সাফল্য পেতে এবং শিক্ষাখাতে বড় পরিসরে অবদান রাখার জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করবেন।
গত দশকে অন্তত কয়েক হাজার শিক্ষকের সঙ্গে সরাসরি কথা বলার সুযোগ পেয়েছি। তাদের কষ্ট, অভিমান সম্পর্কে জেনেছি। তাদের অনেকেই সুযোগ পেলে সরকারি কর্মচারী থেকে আবার শিক্ষাগুরু হয়ে উঠতে চান।
এখন দেখার বিষয় হচ্ছে, বর্তমান শিক্ষা উপদেষ্টা ও উপদেষ্টামন্ডলীর সদস্যরা শিক্ষার মান উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু অজনপ্রিয় সিদ্ধান্তগুলো নেবেন কিনা?
ওয়ালিউল্লাহ ভূঁইয়া; লেখক, প্রকাশক ও শিক্ষাউদ্যোক্তা
bhuiyan.waliullah@gmail.com
Comments