কেমন জীবন কাটান পোশাক শ্রমিকরা

ছবি: আকলাকুর রহমান আকাশ/ স্টার

ভোরের আবছা আলো। আলো তো নয় যেন আলো-আঁধারের লড়াই। রাজধানীর ঢাকার গা ঘেঁষে গড়ে উঠা শিল্পশহর আশুলিয়ার বাতাস প্রতিদিনের মতো বয়ে আনে নতুন দিনের আশা।

খানিক বাদেই সেলাই মেশিনের ছন্দময় শব্দে ভরে উঠবে এখানকার বাতাস। বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম পোশাক রপ্তানিকারক দেশে এটি আরেক দিনের সূচনা।

কিন্তু, কারখানার যন্ত্রগুলো গর্জে ওঠার আগেই শুরু অন্য লড়াই। হাজার হাজার পোশাক শ্রমিক দলবেঁধে বের হচ্ছেন ঘর থেকে। গন্তব্য—কারখানা।

ধোঁয়াশার দেয়াল ভেদ করে সূর্যের প্রথম আলো মাটি ছুঁতেই টিনের ছাউনি দেওয়া খুপরিঘর থেকে বের হলেন ৩০ বছর বয়সী পোশাক শ্রমিক রুবিয়া আক্তার।

ধুলোমাখা পথে দ্রুত পায়ে হাঁটছেন তিনি। পথ চলার ছন্দই যেন বুঝিয়ে দেয় সেলাই মেশিনের পেছনে তার কেটেছে অনেক বছর।

সূর্য দিগন্তরেখা স্পর্শ করার আগেই শুরু হয়ে যায় রুবিয়ার দিন। বিশ্বব্যাপী ফ্যাশনশিল্পের বিপুল চাহিদা মেটাতেই তার এত তাড়া।

রুবিয়া দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'কাজের প্রচণ্ড চাপে সারাদিন সন্তানদের একা ফেলে রাখি।'

দীর্ঘ সময় ধরে রুবিয়ার কাজ ও স্বল্প মজুরি এ দেশের লাখো মানুষের দুর্দশার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। বৈশ্বিক ফ্যাশন ব্র্যান্ডগুলোর চাহিদা আর এখানকার শ্রমিকের বাস্তবতা ভীষণ সাংঘর্ষিক।

রুবিয়ার পেছনে ছোট্ট টিনের চালায় তার সবচেয়ে অমূল্য সম্পদ পড়ে আছে—মেয়ে অমি (৬) ও এসএসসি পরীক্ষার্থী ছেলে রাকিব।

তাদের স্বপ্নে ভরে আছে এই এক কক্ষের ঘরটি। বিছানাও একটি। সেখানেই ঘুমায় বাচ্চারা। দেয়ালে ঝোলানো কাপড় যেন জীবনের রঙচটা ট্যাপেস্ট্রি। এতে লুকিয়ে আছে মায়ের যত্ন ও মাতৃগর্বের গল্প।

ঘরের কোণায় পুরোনো ফ্রিজ। কয়েক মাসের সঞ্চয় দিয়ে কেনা। তবে ভেতরের তাকগুলো খালি। পরিবারের আর্থিক অবস্থার স্পষ্ট চিহ্ন।

আবাসন সংকট ও নাগরিক সুবিধার অভাব জীবনের পরতে পরতে।

'আমাদের ১০ পরিবারের জন্য দুটি বাথরুম। প্রতিদিন সকালে লাইনে দাঁড়াতে হয়।'

আরও বলেন, 'সন্তানদের সুন্দর ভবিষ্যতের জন্য লেখাপড়া দরকার। কিন্তু, তা সহজে পাওয়া যায় না। বাচ্চারা হেঁটে স্কুলে যায়। এক ঘণ্টা লেগে যায়। সব স্কুল বাড়ি থেকে এক ঘণ্টা দূরে।'

ডাক্তার দেখাতেও সমস্যা। কম টাকায় কাছাকাছি চিকিৎসা পাওয়া যায় গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রে। তাও অত কাছে না। 'রাস্তায় প্রায় দুই ঘণ্টা লাগে। খরচ কম হওয়ায় আমরা সেখানেই যাই।'

বেঁচে থাকার কঠিন লড়াই

কারখানার পথে রুবিয়া হাঁটলেও তার মনের মধ্যে ঝড় তোলে জীবনের হিসাব-নিকাশ।

দীর্ঘ সময় কাজ করে পাওয়া ১২ হাজার ৮০০ টাকা বেতন চোখের সামনেই উবে যায়।

সংসারের হিসাবগুলো মাথায় ঘুরপাক খায়। বাড়ি ভাড়া সাড়ে তিন হাজার টাকা, বিদ্যুৎ ৫০০ টাকা, খাবার ও বাজারের জন্য ছয় হাজার টাকা।

বাকি দুই হাজার ৮০০ টাকায় যেভাবেই হোক সন্তানদের লেখাপড়ার খরচ মেটাতে হয়। অমির স্কুলের বেতন ও রাকিবের এসএসসি পরীক্ষার প্রস্তুতি।

বিমর্ষ কণ্ঠে রুবিয়া বলেন, 'মাঝেমধ্যে বাচ্চাদের স্কুলের বেতন দিতে পারি না। বারবার টাকা ধার করতে হয়। এই অবস্থা থেকে বের হতে পারছি না।'

আশুলিয়ার কাঁচাবাজারে এক হালি ডিমের দাম ৬৫ টাকা, ব্রয়লার মুরগি ২০০ টাকা, গরুর মাংস ৭৫০ টাকা, পেঁয়াজ ১২০ টাকা ও কাঁচা মরিচ ৭০ টাকা।

তার ভাষ্য, 'গরুর মাংস কেনার সামর্থ্য নাই। বাচ্চাদের জন্য ছোট তেলাপিয়া রান্না করেছি। একটা সময় ছিল যখন প্রতিদিন ডিম কেনার চেষ্টা করতাম। দাম বেড়ে যাওয়ায় এখন তা পারি না।'

পোশাক শ্রমিকদের জীবনযাত্রার মান সম্পর্কে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিলস) নির্বাহী পরিচালক সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহম্মেদ ডেইলি স্টারকে বলেন, 'ক্রমাগত মূল্যস্ফীতির কারণে শ্রমিকের প্রকৃত মজুরি খুব বেশি বাড়েনি।'

বাংলাদেশ ব্যাংকসহ কয়েকটি সরকারি প্রতিষ্ঠানের জীবনযাত্রার ব্যয় সূচক অনুসারে তৈরি পোশাকের ন্যূনতম মজুরি সাড়ে ১২ হাজার টাকায় জীবন চালানো সম্ভব নয়।

সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহম্মেদ আরও বলেন, 'সরকার দীর্ঘদিন ধরে শ্রমিকের কল্যাণে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। স্কুল, হাসপাতাল, বাজার, আবাসন বা পরিবহন ব্যবস্থা দিয়ে শিল্পাঞ্চলের উন্নয়নের উদ্যোগ নেই। শ্রমিকদের নাগরিক সুবিধা ও সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। কারখানা পর্যায়ে শ্রমিকদের মত প্রকাশের সুযোগ থাকে না। তাই, তাদের প্রয়োজনের কথাও জানা যায় না।'

জীবন সংগ্রামের গল্প

রুবিয়ার মতো অন্য শ্রমিকদের জীবনও এমনই। আশুলিয়ায় ৪০৭টিরও বেশি পোশাক কারখানা। সেখানকার সরু গলি ও জনাকীর্ণ বাড়িঘরজুড়ে একই কষ্টের কাহিনী।

সকাল ৮টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত অপারেটরের কাজ করেন ৩৭ বছর বয়সী শাহিদা খান। তার মেয়ে পড়েন বিশ্ববিদ্যালয়ে। সংসার চালাতে হয় সাড়ে ১২ হাজার টাকা বেতনে।

ওভারটাইমসহ তার আয় সর্বোচ্চ ১৬ হাজার টাকা।

শাহিদা ডেইলি স্টারকে বলেন, 'মেয়ে ঢাকায় থাকে। তার সেমিস্টার ফি তিন হাজার টাকা। সাবলেটে থাকে। তার ভবিষ্যতের জন্য টাকা জমাতে পারি না।'

কাজ ও সংসার নিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন পলাশ মাহমুদ ও জেসমিন আক্তার। জামালপুরে তাদের চার বছরের ছেলে আত্মীয়দের সঙ্গে থাকে। এ এক হৃদয়বিদারক সিদ্ধান্ত।

পলাশ ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আগে আমিই কাজ করতাম। সংসারের প্রয়োজনে এখন স্ত্রীকেও কাজ করতে হয়।'

কঠোর জীবন সংগ্রামের কারণে সন্তানকে বড় করতে গিয়ে অনেক চাওয়া-পাওয়া বিসর্জন দিতে হয়েছে।

পলাশ আরও বলেন, 'ছেলেকে গ্রামে পাঠিয়েছি। তার যত্ন নেওয়ার জন্য পর্যাপ্ত সময় বা টাকা নেই। প্রতি মাসে দুই হাজার টাকা বাড়িতে পাঠাই। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই আমাকে কর্জ করে সংসার চালাতে হয়। চিকিৎসা ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় খরচের টাকা হাতে থাকে না।'

পলাশ ও তার স্ত্রী চার হাজার টাকায় ছোট ঘর ভাড়া নিয়েছেন। 'এখানকার পরিবেশ খুবই খারাপ। বৃষ্টি হলেই পানি জমে। যাতায়াত খরচ বাঁচাতে আমরা এখানেই থাকি।'

পাঁচ বছরের বেশি সময় ধরে মিরপুরের এক পোশাক কারখানায় কাজ করছেন এক সন্তানের মা হোসনা আক্তার। সিনিয়র অপারেটর হিসেবে পান ১৩ হাজার ৫৫০ টাকা।

পাঁচ বছর চাকরির পর তার স্বামী মান্না আয় করছেন ১৩ হাজার ৮০০ টাকা।

এই দম্পতির প্রতি মাসে খরচের মধ্যে আছে বাড়ি ভাড়া ছয় হাজার টাকা, বিদ্যুৎ খরচ ৪০০ টাকা, ইন্টারনেট ৫০০ টাকা ও সংসারের খরচ আট হাজার টাকা। এটি তাদের যৌথ আয়ের ৫৪ শতাংশের বেশি। তারপর যা থাকে তা দিয়ে সন্তানের খরচ চালাতে হয়।

চরম হতাশা থেকে হোসনা ও মান্না সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যে তারা গ্রামে চলে যাবেন।

অল্প বেতনে সংসার চালানো সম্ভব না হওয়ায় মিরপুরের অপর শ্রমিক শান্তা মধ্যপ্রাচ্যে শ্রমিক হিসেবে কাজ করতে যাওয়ার চিন্তা করছেন।

চাপে পোশাকশিল্প

বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) তথ্য অনুসারে, পোশাক কারখানায় ৩৩ লাখ শ্রমিকের ৫২ দশমিক ২৮ শতাংশ নারী।

যদিও এই শিল্পখাত অনেকের কাজের সুযোগ করে দিয়েছে তবুও একে যেন চলতে হয় চিকন সুতার ওপর দিয়ে। উৎপাদন খরচ কম রাখার জন্য বিশ্বব্যাপী ব্র্যান্ডগুলোর চাপে কারখানা মালিকরা প্রায়ই কাজের পরিবেশ উন্নত করতে বা উল্লেখযোগ্যভাবে মজুরি বাড়াতে হিমশিম খান।

বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি ড. রুবানা হক ডেইলি স্টারকে বলেন, 'সাড়ে ১২ হাজার টাকা খুব বেশি বেতন না। তবে বিদেশিদের কাছ থেকে পণ্যের যথাযথ দাম না পাওয়ায় এবং পোশাকের দাম ও পরিমাণ কমে যাওয়ায় এর বেশি টাকা দেওয়ার সুযোগ কম। পরিবহন, আবাসন ও খাবারের মতো সুবিধাগুলোর নিয়ে চিন্তা করা দরকার। সরকারকে অবশ্যই বিবেচনা নিতে হবে। মালিকদেরও এগিয়ে আসতে হবে।'

শ্রমিকদের শিক্ষা ও স্বাস্থ্য সুবিধা দিতে হবে বলেও মনে করেন তিনি।

গত বছর শ্রমিকদের ন্যূনতম বেতন ২৫ হাজার টাকা করার দাবিতে শ্রমিকরা আন্দোলন করেছিলেন। আলোচনার পর সরকার পোশাক খাতে নতুন শ্রমিকদের বেতন সাড়ে ১২ হাজার টাকা নির্ধারণ করে। আগে ছিল আট হাজার টাকা। তবে এখনো তা শ্রমিকদের মানসম্মত জীবনযাপনের জন্য যথেষ্ট না।

এর মধ্যে মূল বেতন ছয় হাজার ৭০০ টাকা, বাড়িভাড়া তিন হাজার ৩৫০ টাকা, চিকিৎসা ভাতা ৭৫০ টাকা, যাতায়াত ৪৫০ টাকা ও খোরাকি ভাতা এক হাজার ২৫০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে।

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য বলছে—গত অর্থবছরের জুলাই থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত পোশাক রপ্তানি তিন হাজার ২৮৬ কোটি ডলারে পৌঁছেছে। এটি আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় চার দশমিক ৭৭ শতাংশ বেশি।

ইপিবি বলছে, চলতি বছরের প্রথম দুই মাসে পোশাক রপ্তানির পরিমাণ ৯৪৭ কোটি ডলার। এটি আগের বছরের একই বছরের তুলনায় ১৩ দশমিক ১৫ শতাংশ বেশি।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম ডেইলি স্টারকে বলেন, 'ন্যূনতম মজুরির কাঠামো ত্রুটিপূর্ণ। আবাসন ও চিকিৎসা খরচ বাবদ বরাদ্দ প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। আরও কিছু খরচ জরুরি। যেমন—সন্তানের পড়ালেখা, যোগাযোগ খরচ, বিনোদন ও ইন্টারনেট বিল। এগুলো বেতন কাঠামোয় পড়ে না।'

তার মতে, শ্রমিকরা আরও ভালো মজুরি ও কাজের পরিবেশের জন্য দরকষাকষির ক্ষেত্রে সমান পর্যায়ে প্রতিযোগিতা করেন না।

খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম আরও বলেন, 'মজুরি আলোচনা সরকার, শ্রমিক ও মালিকদের নিয়ে ত্রিপক্ষীয় হওয়া উচিত। বাস্তবে সিদ্ধান্ত আসে দ্বিপক্ষীয়ভাবে। শুধু সরকার ও মালিকপক্ষ থেকে।'

'শ্রমিকদের আশঙ্কা—আলোচনায় অংশ নিলে তারা চাকরি হারাতে পারেন। মালিকরা যুক্তি দেখান, বেশি মজুরি দিলে খরচ বেড়ে যাবে। প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে যাবে। যদিও এর পক্ষে প্রমাণ কম।'

'বাংলাদেশ শ্রম আইন অনুযায়ী মজুরি নিয়ে দরকষাকষির জন্য ১২টি সূচক থাকলেও ব্যবহার করা হয় দুই থেকে তিনটি। দেশে মজুরি আলোচনা তথ্যভিত্তিক নয়। মালিকরা এগুলো এড়িয়ে চলেন।'

ফাস্ট ফ্যাশনের দায় মেটাচ্ছে সাধারণ মানুষ

সূর্য যখন আরেকটি দিন শেষে বিদায় নেয় তখন রুবিয়া বাড়ির পথ ধরে। তার আঙুলে ব্যথা, পিঠে ব্যথা, তবু সংকল্প অটুট। আগামীকাল হয়ত তাকে আবার এসবের ভেতর দিয়েই যেতে হবে।

রুবিয়া, শাহিদা, পলাশ, জেসমিন, হোসনা, মান্না, শান্তা ও এমন আরও অগণিত মানুষের জীবনসংগ্রাম আলো ঝলমল দোকানগুলোয় সুন্দর করে সাজিয়ে রাখা পোশাকের ট্যাগে দেখা যায় না।

শ্রমিকদের অবস্থার উন্নতি না হলে কেউ কেউ এই কাজ ছেড়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করছেন। অনেকে ভাবছেন গ্রামের বাড়িতে ফিরে যাওয়াই ভালো।

রাত নামার সঙ্গে সঙ্গে কারখানাগুলোয় নীরবতা নেমে আসে। অসংখ্য ছোট ছোট ঘরে নিবু নিবু করে জ্বলতে থাকে আশা-প্রত্যাশা। যারা আমাদের জন্য কাপড় বানান এবং তা বানাতে গিয়ে নিজেদের স্বপ্ন বুনেন তাদের জীবনের গল্প যেন ঢাকা পড়ে আছে সুতা আর রঙের আড়ালে!

Comments

The Daily Star  | English
Bangladesh-India relations

The Indian media and Bangladesh-India relations

The bilateral relationship must be based on a "win-win" policy, rooted in mutual respect, non-hegemony, and the pursuit of shared prosperity and deeper understanding.

16h ago