অটোপাসের দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব

‘সম্প্রতি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দেওয়া এই অটোপাসের সিদ্ধান্তের ফলে সরকার নিজেদের দুর্বলতা প্রকাশ করেছে।’
এইচএসসি
ছবি: প্রবীর দাশ/স্টার

২০১৯ সালের পর থেকে উচ্চমাধ্যমিক (এইচএসসি) পরীক্ষাকে কেন্দ্র করে একের পর এক প্রশ্নবিদ্ধ সিদ্ধান্তের কারণে সার্বিক পাঠ্যক্রমের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। করোনা মহামারির কারণে ২০২০ সালের এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের জন্য অটোপাশের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ২০২১ সালে শুধুমাত্র ছয়টি বিষয়ের ওপর এইচএসসি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয় এবং প্রতিটি পরীক্ষা ছিল ৩২ নম্বরের। ২০২২ সালের এইচএসসি পরীক্ষায় প্রতি বিষয়ের জন্য নির্ধারিত ছিল ৪৫ নম্বর।

তবে এই দুই বছরই সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়েছিল। করোনা মহামারির পরেও এই ধারা অব্যাহত ছিল। ২০২৩ সালের এইচএসসি পরীক্ষাও অনুষ্ঠিত হয় সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে। সম্প্রতি ২০২৪ সালে এইচএসসি পরীক্ষা বাতিল করে অটোপাসের সিদ্ধান্ত আসার পর এইচএসসি নিয়ে আলোচনা সৃষ্টি হয়েছে।

ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ২০২৪ সালের এইচএসসি পরীক্ষার্থী নাজিফা আনজুমের মতে, এই সিদ্ধান্তের  দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ছাড়াও এটি এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের জন্যে বেশ দুঃখজনক। তিনি বলেন, 'আমি এই খবরটি শুনে অনেক ভেঙে পড়ি। কারণ আমার মনে হচ্ছিল, আমার ব্যাচের বেশিরভাগ শিক্ষার্থী কেবল নিজেদের কথাই  ভাবছে। দুই বছর ধরে একটি পরীক্ষার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করার পর সেই পরীক্ষা না দিতে পারা সত্যিই খুব কষ্টের। পুরো দেশ যখন অনেক রকম জটিল সমস্যা মোকাবিলায় ব্যস্ত, তখন জোরপূর্বক এই দাবি পূরণ করানো নৈতিকভাবে ঠিক নয় বলে আমি মনে করি।'

ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ২০২৪ সালের আরেক এইচএসসি পরীক্ষার্থী শার্লিন খান মনে করেন, অটোপাসের সিদ্ধান্ত দ্বারা পরীক্ষার্থীদের এতদিনের পরিশ্রমকে অবমূল্যায়ন করা হয়েছে। তিনি বলেন, 'অনিশ্চয়তা ও বারবার সিদ্ধান্ত বদল আমাদের মানসিক চাপ সৃষ্টি করে মানসিক সুস্থতার ওপর প্রভাব ফেলেছে। এই সিদ্ধান্তের সঙ্গে অ্যাকাডেমিক বিষয় ছাড়াও অনেক কিছু জড়িত। ভবিষ্যতে দেশের বাইরে পড়তে যাওয়ার সময় এই ব্যাপারটি সমস্যার কারণ হতে পারে। এইচএসসি পরীক্ষা বাতিলের সিদ্ধান্ত শিক্ষার্থীদের ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতিকে আরও জটিল করে তুলেছে।'

২০২৪ সালের এইচএসসি পরীক্ষার্থী নাহিনা আখতার নেহা বলেন, 'আমি ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতি নিয়ে বেশ কঠিন সময় পার করছি। কারণ এইচএসসি পরীক্ষা দিতে পারলে আমার আত্মবিশ্বাস এবং প্রস্তুতি দুটোই বৃদ্ধি পেত। এর ফলে এখন আমি দ্বিধায় ভুগছি যে, আমার কি একেবারে প্রথম থেকে শুরু করা উচিত নাকি কোচিং আর প্রাইভেট টিউশন নিয়ে ভর্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়া উচিত। এইচএসসি অনেকের জন্য একটি বাস্তবতা হিসেবে কাজ করে। যদি কারো এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফল আশানুরূপ না হয়, তাহলে সে ভর্তি পরীক্ষার মৌসুমে কঠোর পরিশ্রম করে ভালো জায়গায় ফিরে আসতে পারে। কিন্তু অটোপাসের সিদ্ধান্তের কারণে অনেক শিক্ষার্থী ভর্তি পরীক্ষার জন্য তাদের প্রস্তুতি যাচাই করতে পারবে না।'

'বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজি (বুয়েট) ও বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব টেক্সটাইলসের (বুটেক্স) মতো বেশ কয়েকটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা দেওয়ার জন্য নির্দিষ্ট নম্বর ও গ্রেডিং প্রয়োজন। যেহেতু এবার বেশিরভাগ বিষয়ের পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়নি, তাই যারা এসব জায়গায় ভর্তির জন্য কঠোর পরিশ্রম করছিল, তাদের জন্য সিদ্ধান্তটি যৌক্তিক নয়। যেসব শিক্ষার্থীরা অক্টোবর ও নভেম্বরে স্যাট পরীক্ষা দিতে চেয়েছিল, তারা একটি কঠিন পরিস্থিতিতে পড়েছে। আকস্মিক এই অটোপাসের সিদ্ধান্তের ফলে তারা প্রস্তুতির জন্য পর্যাপ্ত সময় পাচ্ছে না এবং এবারের ফল সেমিস্টারে দেশের বাইরের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যেতে পারবে কি না, তা নিয়ে দ্বিধায় আছে', বলেন নেহা।

নটরডেম কলেজের এইচএসসি পরীক্ষার্থী আবরার মাহিরের মতে, অটোপাসের সিদ্ধান্তের ফলে কিছু শিক্ষার্থীকে অনেক তাড়াহুড়ো করে ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতি শুরু করতে হয়েছে। 'আমি আশা করেছিলাম এইচএসসি স্থগিত হয়ে যাবে অথবা সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে সেপ্টেম্বরের দিকে অনুষ্ঠিত হবে। এজন্য আমি ভর্তির প্রস্তুতি শুরু করতে তৈরি ছিলাম না। কিন্তু এখন আমাকে আগের সব পরিকল্পনা বাদ দিয়ে দ্রুত ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতি শুরু করতে হবে। আগে প্রতিদিন অল্প করে রিভিশন দিতাম ও সিনিয়রদের থেকে পরামর্শ নিতাম। কিন্তু কোচিং ক্লাস শুরু হয়ে যাওয়ায় হঠাৎ করেই চাপ বেড়ে গেছে', বলেন তিনি।

বুয়েটের ছাত্রী নম্রতা মেহজাবীন ২০২০ সালের এইচএসসি পরীক্ষার্থী ছিলেন। তিনি মনে করেন, কলেজের একজন শিক্ষার্থীকে তার এসএসসি বা এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফল দিয়ে যাচাই করা যায় না। তিনি বলেন, 'অটোপাস একজন শিক্ষার্থীর কলেজ জীবনের সব প্রচেষ্টাকে ব্যর্থ করে দেয়। আমি আমার অনেক বন্ধুকে দেখেছি যারা স্কুলে অতটা মনোযোগী না হলেও কলেজে বেশ মনোযোগী হয়ে উঠেছিল। কিন্তু ২০২০ সালে অটোপাসের সিদ্ধান্ত দেওয়ার পর তাদের সব চেষ্টা বিফলে গেছে এবং তারা কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষাই দিতে পারেনি। সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে পরীক্ষার যে ধারা সৃষ্টি হয়েছে, এটিও ভীষণ ক্ষতিকর। আপনি যদি পুরো এইচএসসির সিলেবাসটি দেখেন, তাহলে লক্ষ্য করবেন যে প্রতিটি অধ্যায় একটি অপরটির সঙ্গে সম্পর্কিত। স্নাতকের কিছু কোর্সের বিষয়ের সঙ্গে মিল থাকায় একজন শিক্ষার্থীর বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনার জন্য প্রতিটি বিষয় সম্পর্কে ধারণা থাকা প্রয়োজন। কেউ যদি এই বিষয়গুলোর সঙ্গে পরিচিত না হয়, তাহলে তার এইচএসসি সার্টিফিকেট মূল্যহীন হয়ে পড়বে। আমি বুঝতে পারি যে কোভিড মহামারি পরিস্থিতির কারণে সংক্ষিপ্ত সিলেবাসের সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রয়োজন ছিল। তবে এই সিদ্ধান্ত বারবার চালিয়ে যাওয়া উচিত হয়নি।'

অন্যদিকে, নাজিফা আনজুম মনে করেন, সম্প্রতি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দেওয়া এই অটোপাসের সিদ্ধান্তের ফলে সরকার নিজেদের দুর্বলতা প্রকাশ করেছে।

'যেহেতু আমাদের ব্যাচের কিছু শিক্ষার্থী অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে এই সিদ্ধান্ত দিতে কিছুটা বাধ্য করেছে, তাই ভবিষ্যতেও দেখা যাবে পরবর্তী ব্যাচের এইচএসসি পরীক্ষার্থীরা নিজেদের স্বার্থের জন্য পরীক্ষা পেছানো বা অটোপাসকে তাদের যেকোনো সমস্যার সমাধান মনে করবে', বলেন তিনি।

কীভাবে অটোপাসের সিদ্ধান্ত যোগ্য প্রার্থীদের জন্য ঠিক নয়, তা ব্যাখ্যা করে আবরার বলেন, 'এসএসসিতে ভালো ফলাফল না করায় যারা কলেজে সত্যিই খুব মনোযোগী হয়ে উঠেছিল, তাদের জন্য এই সিদ্ধান্ত শাস্তিস্বরূপ। যেমন: আমি নিজেই এটি শুনে বিমর্ষ হয়ে পড়েছিলাম। কলেজে দুই বছরে প্রতি সপ্তাহে অসংখ্য কুইজ আর প্র্যাকটিক্যাল পরীক্ষার দেওয়ার পর এই অটোপাস কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। আমার মনে হয়, যেসব শিক্ষার্থীরা অটোপাসের জন্য আন্দোলন করেছে, তারা কেবল সার্টিফিকেটের কথা চিন্তা করেছে, এইচএসসি পরীক্ষার দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব সম্পর্কে চিন্তা করেনি।'

বর্তমান শিক্ষার্থীদের জন্য এই অটোপাসের সিদ্ধান্তের পর সামনের দিকে অগ্রসর হওয়ার জন্য কী পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে?

শারলিন খান মনে করেন, আগামী ব্যাচের জন্য কর্তৃপক্ষকে নিশ্চিত করতে হবে যেন এইচএসসি পরীক্ষা একজন শিক্ষার্থীর যোগ্যতার সঠিক প্রতিফলন ঘটাতে সাহায্য করে। তিনি আরও বলেন, 'ভবিষ্যতে যতই প্রতিকূল পরিস্থিতি আসুক, কর্তৃপক্ষকে নিশ্চিত করতে হবে শিক্ষার্থীদের যেন সঠিকভাবে মূল্যায়ন করা হয়। পাশাপাশি কোনো উদ্ভূত পরিস্থিতিতে দেশের বাইরের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকেও শিক্ষার্থীদের সমস্যা বিবেচনা করে ভর্তি প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রে নমনীয় হতে হবে। এ ধরনের বাস্তব সমাধান এই প্রতিকূল সময়ে শিক্ষার্থীদের চাপ কমিয়ে তাদের স্বস্তি দিতে পারে।'

নাজিফা আনজুমের মতে, ২০২৪ সালের এইচএসসির ফলাফল তাদের অংশগ্রহণ করা সাতটি পরীক্ষার ভিত্তিতে হওয়া উচিত। তিনি বলেন, 'যেই মেধাভিত্তিক ব্যবস্থার জন্য শিক্ষার্থীরা লড়াই করেছেন, সেখানে অটোপাস মেধাভিত্তিক ব্যবস্থার অপমান। একটি ব্যাচের শিক্ষার্থীরা যতই আন্দোলন করুক না কেন, সরকারের এত সহজে হাল ছেড়ে দেওয়া উচিত না। যদি ভবিষ্যতে আর কোনো বোর্ড পরীক্ষা এভাবে বাতিল হয়ে যায়, তাহলে মেধাভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থা হুমকির মুখে পড়বে। আমাদের ব্যাচের জন্য আমি বলব, যেসব পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়েছে তার ভিত্তিতেই ফলাফল দেওয়া উচিত। যেহেতু অনেক বিশ্ববিদ্যালয় ইংরেজি ও পদার্থবিজ্ঞান এই দুইটি বিষয়ের নম্বরকে বেশি গুরুত্ব দেয়, তাই যেসব পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়েছে, সেগুলোর ভিত্তিতে ফলাফল দেওয়াটাই যৌক্তিক।'

অনুবাদ করেছেন সৈয়দা সুবাহ আলম

Comments

The Daily Star  | English

Six state banks asked to cancel contractual appointments of MDs

The Financial Institutions Division (FID) of the finance ministry has recommended that the boards of directors of six state-run banks cancel the contractual appointment of their managing directors and CEOs..The six state-run banks are Sonali Bank, Janata Bank, Agrani Bank, Rupali Bank, BAS

36m ago