জলে গেছে ৫২৩ কোটি টাকা, ৮৫ মিলিমিটার বৃষ্টিতে আবার থই থই খুলনা

খুলনা নগরের বেশিরভাগ জায়গার চিত্র এখন এমনই। ছবি: স্টার

শহরের জলাবদ্ধতা নিরসনে বাস্তবায়িত বিভিন্ন প্রকল্পে গত ছয় বছরে খুলনা সিটি করপোরেশন (কেসিসি) খরচ করেছে ৫২৩ কোটি টাকা। এ সময়ের মধ্যে পুনর্নির্মিত হয়েছে ১০৪টি ড্রেন। সংস্কার চলছে আরও ৪২টির। পুনঃখনন করা হয়েছে ময়ূর নদসহ সাতটি খাল। কিন্তু এত বিপুল অর্থ খরচ ও কর্মযজ্ঞের পরেও পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হয়নি।

তাই বরাবরের ধারাবাহিকতায় এবারও ভারী বৃষ্টির পানিতে থই থই হয়ে পড়েছে শহরের দুই-তৃতীয়াংশ এলাকা ও নিম্নাঞ্চল।

গতকাল শুক্রবার বিকেল ৪টা থেকে শুরু হওয়া এ বৃষ্টি একনাগাড়ে চলে আজ শনিবার সকাল ১১টা পর্যন্ত। আবহাওয়া অফিসের দেওয়া তথ্য বলছে এ সময়ের মধ্যে খুলনায় মোট বৃষ্টিপাত হয়েছে ৮৫ মিলিমিটার।

গতকাল বিকেলের বৃষ্টিতেই শহরের নিচু এলাকাগুলো আগেভাগে ডুবে যায়। রাতের বৃষ্টিতে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হয়ে ওঠে।

আজ সকাল ১১টা পর্যন্ত নগরের রয়েল মোড়, কে ডি এ অ্যাভিনিউ, বয়রা বাজার, মুজগুন্নী পার্ক, বাস্তহারা, রুপসা স্ট্যান্ড রোড ও চানমারি বাজার এলাকার প্রায় পুরোটাই ডুবে ছিল।

খুলনা আবহাওয়া অফিসের জ্যৈষ্ঠ আবহাওয়াবিদ আমিরুল আজাদ দ্য ডেইলি স্টারকে জানান, আজও খুলনায় সারাদিন বৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা আছে।

এ ভোগান্তি বহুদিনের। ছবি: স্টার

কেসিসি এলাকার মধ্যে মোট সড়ক আছে ১ হাজার ২১৫টি। সকাল থেকে দেখা যায়, টানা বৃষ্টিতে নেভি চেকপোস্ট, রায়েরমহল, বয়রা বাজার, গল্লামারি, ময়লাপোতা, টুটপাড়া জোড়া কল বাজার, মহির বাড়ির খালপাড়, নতুন বাজার, ফুলবাড়ী গেট, রেলিগেট, মহেশ্বরপাশা, দৌলতপুর, নতুন রাস্তা মোড়, আলমনগরসহ খুলনা শহরের বেশিরভাগ এলাকার সড়ক এখনো পানির নিচে।

এছাড়া বাইতিপাড়া, কে ডি এভিনিউ, ডাকবাংলা ও রায়ের মহলের কোথাও কোথাও কোমরসমান পানি। কেউ কেউ সড়কের ওপরেই মাছ ধরছেস।

খুলনা নগরীর আহসান আহমেদ রোডের বাসিন্দা এনামুল হক ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এই রোডে আগে সামান্য বৃষ্টি হলেই পানি জমত। এজন্য ৪ কোটি ৫৮ লাখ টাকা খরচ করে সড়কের দুইপাশে নতুন ড্রেন নির্মাণ করা হয় এক বছর আগে। প্রায় আড়াই কোটি টাকা ব্যয় করে সংস্কার হয় সড়ক। এরপরও পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি।'

এনামুল হক আরও বলেন, 'আমাদের বাড়ির ভেতরের পানি কোনোভাবেই সড়কের ড্রেনে আসার উপায় নেই। কারণ সিটি করপোরেশন যে ড্রেন বানিয়েছে তা আমাদের বাড়ি থেকে দুই ফুট উঁচুতে। এতে বাড়ির ভেতর জমে থাকার পানি কোনোভাবেই ড্রেনে যায় না। বরং সড়কের পানি আমাদের বাড়ি ভাসিয়ে দেয়।'

এছাড়া নতুন করে বানানো ড্রেনগুলো পরিষ্কার করার আধুনিক কোনো ব্যবস্থা নেই বলেও মন্তব্য করেন এনামুল।

খুলনার বয়রা এলাকার বাসিন্দা কবীর হোসেন বলেন, বয়রার রায়েরমহল, মস্তর মোড় ও বিল পাবলা এলাকা আগে অনেক নিচু ছিল। তাতে বৃষ্টির পানি বিভিন্ন পথ দিয়ে বেরিয়ে যেত। সেই পানি পড়ত নগরীর পশ্চিম পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া বিভিন্ন খাল ও নদী বেয়ে বটিয়াঘাটা এবং ডুমুরিয়ার উপজেলার সালতা ও শোলমারী নদীতে পড়ত। এখন আবাসন ব্যবসায়ীদের বিভিন্ন প্রকল্পের কারণে খালগুলো বন্ধ হয়ে পানি প্রবাহ একেবারে বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে শহরের পানি কোনোভাবিই পশ্চিম দিকের নিচু জায়গায় যেতে পারছে না।

এমন পরিস্থিতিতে ময়ূর নদসহ খুলনা নগরী ও এর আশেপাশের ২২টি খাল খনন ও পুরোপুরি দখলমুক্ত করার কোনো উদ্যোগ না নিলে এই জলাবদ্ধতা সমস্যার নিরসন হবে না বলে মন্তব্য করেন কবীর হোসেন।

থই থই পরিস্থিতি। ছবি: স্টার

খুলনার ৯ নম্বর ওয়ার্ড এলাকার বাসিন্দা আসলাম শেখেরও ভাষ্য, সামান্য বৃষ্টিতেই এই ওয়ার্ডের বেশিরভাগ এলাকা পানির নিচে ডুবে যায়। এই ওয়ার্ডের মাঝ বরাবর চলে গেছে মুজগুন্নি মহাসড়ক। এই মহাসড়কের দুই পাশে ৩১ কোটি টাকা খরচ করে ড্রেন তৈরি করা হয়েছে। কিন্তু সেই ড্রেন এত সরু যে রাস্তাসহ আশেপাশের বাড়ির পানি ধারণ করতে পারে না।

কেসিসির একটি সূত্র জানায়, খুলনা শহরের জলাবদ্ধতা দূরীকরণে ড্রেনেজ ব্যবস্থার উন্নয়ন' নামে একটি প্রকল্প একনেকে অনুমোদন হয় ২০১৮ সালের জুলাইয়ে। প্রকল্প ব্যয় ছিল ৮২৩ কোটি টাকা। প্রকল্পের প্রথম ধাপের কাজ শুরু হয় ২০২০ সালের অক্টোবরে। মেয়াদ নির্ধারণ করা হয় ২০২৫ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত। প্রকল্পে ড্রেন নির্মাণ, খাল খনন, স্লুইসগেট, পাম্প হাউজ নির্মাণসহ ১৭৭টি কাজ করার কথা ছিল।

ওই সূত্রের বক্তব্য, নতুন প্রকল্পের ড্রেনগুলোর সবগুলোতে কাভার দেওয়া। এতে বাসিন্দারা ময়লা ফেলে ড্রেন অপরিষ্কার করতে না পারলেও স্বাভাবিকভাবে ড্রেনে যে ময়লা জমে, তা পরিষ্কারের জন্য আধুনিক যন্ত্র সিটি করপোরেশনের নেই। ফলে এটা নতুন একটা সমস্যা তৈরি করেছে। জলাবদ্ধতা বাড়ছে। পানি সরতে বেশি সময় লাগছে।

বৃহত্তর খুলনা উন্নয়ন সংগ্রাম সমন্বয় কমিটির সভাপতি শেখ আশরাফুজ্জামানও বলছেন, 'শুধু ড্রেন নির্মাণ করলেই হবে না এগুলো নিয়মিত পরিষ্কার করতে হবে। বর্জ্য পড়ে অধিকাংশ নতুন ড্রেন ভরাট হয়ে গেছে। এ বিষয়ে কেসিসির নজরদারি কম। সঠিকভাবে তদারকির অভাবে বিপুল অর্থব্যয় কাজে আসছে না।

জানতে চাইলে কেসিসির প্রধান কনজারভেন্সি কর্মকর্তা আনিসুর রহমান ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমরা নিয়মিত ড্রেন পরিষ্কার করি। এছাড়া ড্রেনেজ ব্যবস্থার উন্নয়নে যে প্রকল্পগুলো চলছে, সেগুলো এবং খাল খননের কাজ শেষ হলে এই জলাবদ্ধতার সমস্যা আর থাকবে না।'

Comments

The Daily Star  | English

Yunus meets Chinese ambassador to review China visit, outline next steps

Both sides expressed a shared commitment to transforming discussions into actionable projects across a range of sectors

2h ago