এখনো গতি ফেরেনি পুলিশে

এখনো মনোবলের অভাবে ভুগছেন আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা।

গণঅভ্যুত্থানের মুখে শেখ হাসিনা নেতৃত্বাধীন সরকারের পতনের পর প্রায় এক মাস মোটামুটি অনুপস্থিত ছিল পুলিশ। এই বাহিনীর সদস্যদের মধ্যে এখনো রয়েছে প্রত্যাহার, বদলি, মামলা এমনকি গ্রেপ্তারের ভয়।

জবাবদিহিতা না থাকায় গত দেড় দশকে পুলিশ হয়ে ওঠে কর্তৃত্ববাদী বাহিনী। অনেকের কাছেই পুলিশ হয়ে উঠেছিল নিপীড়নের প্রতীক। শীর্ষ স্থানীয় পুলিশ কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এ ব্যাপারে পুলিশ সদস্যরা অবগত। এখনো জনরোষের ভয় কাটেনি। গত ৫ আগস্টের পরে অনেক কর্মকর্তা আত্মগোপনে চলে গেছেন।

স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী গতকাল জেলা পুলিশ সুপারদের আন্তরিকভাবে কাজ করার আহ্বান জানিয়েছেন।

অতীতের অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে নষ্ট হয়ে যাওয়া জনগণের আস্থা অর্জন করা পুলিশের দায়িত্ব।

সূত্র জানিয়েছে, এখনো ছুটি ছাড়া অনুপস্থিত রয়েছেন ৭০০-৮০০ কর্মকর্তা। তাদের মধ্যে কিছু ক্যাডার কর্মকর্তা রয়েছেন।

আওয়ামী লীগ সরকারের ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার আগে ও পরপরই বিক্ষোভকারীদের ওপর আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী প্রাণঘাতী অস্ত্রের ব্যবহার ও মাত্রাতিরিক্ত বলপ্রয়োগ করে। এর প্রতিবাদে জনগণ পুলিশের স্থাপনা, গাড়ি ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগ করে।

পুলিশ সূত্র জানিয়েছে, ৬৬৪টি থানার মধ্যে ৪৫০টির বেশি থানায় হামলা  হয়েছে। বিক্ষুব্ধ জনতা কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে।

পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য অনুসারে, লুট হয়েছে পাঁচ হাজার ৮২৯টি আগ্নেয়াস্ত্র ও ছয় লাখ ছয় হাজার ৭৪২ রাউন্ড গুলি। এর মধ্যে তিন হাজার ৭৬৩টি বন্দুক ও দুই লাখ ৮৬ হাজার ৮২ রাউন্ড গুলি উদ্ধার হয়েছে। বাকিগুলো এখনো পাওয়া যায়নি।

এই পরিস্থিতিতে সেনা সদস্যরা নিরাপত্তা নিশ্চিত করে। পুলিশের পরিষেবা মূলত অভিযোগ গ্রহণ এবং মামলা নিবন্ধনের মধ্যে সীমাবদ্ধ রয়েছে। জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯ হটলাইন গত ৯ আগস্ট সীমিত আকারে এবং ১২ আগস্ট পুরোপুরি কার্যক্রম শুরু করে।

কিন্তু থানাগুলোতে পর্যাপ্ত পুলিশ সদস্য ও লজিস্টিক সাপোর্ট না থাকায় ওই নম্বরে ফোন করেও মানুষ কাঙ্ক্ষিত সেবা পাচ্ছে না। এক সময় ৯৯৯-এ পুলিশের সহায়তা চেয়ে যত ফোন কল করা হয়েছে, তার সবগুলোই সশস্ত্র বাহিনীর কাছে পাঠানো হয়েছিল।

'আমার থানায় মামলার নথি, পরোয়ানা, গাড়ি সব কিছু পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে। অস্ত্র ও গুলি লুট হয়েছে। আমরা সীমিত আকারে টহল শুরু করেছি, তবে অনেক কার্যক্রম স্থগিত রয়েছে। রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সের পক্ষ থেকে দুটি গাড়ি দেওয়া হয়েছে। আমরা এখনো বের হয়ে সন্দেহভাজনদের গ্রেপ্তার শুরু করতে পারিনি,' বলেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রাজধানীর একটি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা।

পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) মইনুল ইসলাম এই সংকটের কথা স্বীকার করেন।

সচিবালয়ে গণমাধ্যমকর্মীদের সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেন, 'আমরা কখনো পুলিশিং বন্ধ করিনি। কোথাও কোথাও থানা ভাঙচুর করা হয়েছে, ধ্বংসপ্রাপ্ত...(আমাদের) কোনো পরিবহন ছিল না: প্রায় ৩০০ যানবাহন ধ্বংস হয়ে গেছে বা পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। সেসব থানা মেরামত ও যানবাহন সরবরাহ করতে হবে।'

যেসব এলাকায় পুলিশের তৎপরতা ছিল না, সেখানে কর্মকর্তাদের বদলি করা হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'নতুন এসপি, রেঞ্জ ডিআইজি ও কমিশনাররা তাদের কর্মস্থলে যোগ দিয়েছেন, এখন কাজে গতি বাড়বে।'

জাতীয় জরুরি সেবার প্রধান অতিরিক্ত উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) মোহাম্মদ তবারক উল্লাহ ডেইলি স্টারকে বলেন, ন্যাশনাল হেল্পলাইন সার্ভিসের কর্মকর্তারা সীমিত জনবল ও লজিস্টিক নিয়ে মানুষকে সহায়তা দেওয়ার চেষ্টা করছেন।

আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকে রাজধানীতে ৯৪ জন পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে ২৭৮টি মামলা হয়েছে। আসামিদের মধ্যে পুলিশের সাবেক তিন মহাপরিদর্শকও রয়েছেন। কনস্টেবল থেকে শুরু করে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধেও অভিযোগ আনা হয়েছে।

আসামিদের মধ্যে আটজন অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক, সাতজন উপমহাপরিদর্শক, ১২ জন পুলিশ সুপার, ১৪ জন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার, ছয়জন সহকারী পুলিশ সুপার, ১২ জন ওসি, আটজন পরিদর্শক, ১০ জন উপপরিদর্শক ও একজন সহকারী উপপরিদর্শক রয়েছেন।

বেশির ভাগ মামলাই ছিল হত্যা কিংবা বিস্ফোরক দ্রব্য আইন ও অস্ত্র আইনে করা হয়েছে।

পুলিশের তথ্য অনুসারে—ঢাকা মহানগর পুলিশের সাবেক অতিরিক্ত উপকমিশনার মো. হারুন অর রশীদের বিরুদ্ধে ৩৮টি, সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনের বিরুদ্ধে ৩৬টি, ডিএমপির সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমানের বিরুদ্ধে ৩৩টি ও ডিএমপির সাবেক যুগ্ম কমিশনার বিপ্লব কুমার সরকারের বিরুদ্ধে এ পর্যন্ত ২৭টি মামলা হয়েছে।

এছাড়া, সারা দেশে পুলিশ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ডজনখানেক মামলা দায়ের হয়েছে।

এ পর্যন্ত নয়জন অতিরিক্ত আইজিপি, দুইজন অতিরিক্ত আইজিপি, পাঁচজন ডিআইজি ও একজন অতিরিক্ত ডিআইজিসহ ১৭ জন উচ্চপদস্থ পুলিশ কর্মকর্তাকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়েছে।

পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক এ কে এম শহীদুল হক ও চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন এবং ঢাকার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আব্দুল্লাহিল কাফী গ্রেপ্তার হয়েছেন।

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতায় আসার পরপরই নিরাপত্তা ও রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার না করার দাবিতে কর্মবিরতি পালন করেন কিছু পুলিশ সদস্য।

পুলিশ সদর দপ্তরের উপমহাপরিদর্শক কাজী জিয়া উদ্দিন বলেন, '৯৯ শতাংশের বেশি পুলিশ সদস্য কাজে যোগ দিয়েছেন।'

সদর দপ্তরের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, গত দুই সপ্তাহে ডিআইজি থেকে সহকারী পুলিশ সুপার পদমর্যাদার ৩০০ ক্যাডার কর্মকর্তাকে বদলি করা হয়েছে।

তাদের মধ্যে ৮০ জনেরও বেশি এসপি থেকে ডিআইজি পদমর্যাদার ছিলেন। নির্দিষ্ট কোনো কাজের দায়িত্ব না দিয়েই তাদের পুলিশের বিভিন্ন ইউনিটে সংযুক্ত করা হয়।

পুলিশের সংখ্যা প্রায় দুই লাখ ১৩ হাজার।

Comments

The Daily Star  | English
compensation for uprising martyrs families

Each martyr family to get Tk 30 lakh: Prof Yunus

Vows to rehabilitate them; govt to bear all expenses of uprising injured

5h ago