গুম হওয়া রানার চোখে ডিজিএফআইয়ের ‘আয়নাঘর’

জোরপূর্বক গুমের শিকার অন্য ভুক্তভোগীদের চেয়ে এইচ এম রানার অভিজ্ঞতার পার্থক্য হলো, তিনি জানতেন যে ঢাকা সেনানিবাসের ভেতর তাকে ঠিক কোথায় রাখা হয়েছিল।

এমন বন্দিশালা থেকে যারা জীবিত ফিরে এসেছেন তাদের প্রায় প্রত্যেকেই বলেছেন- তুলে নেওয়া থেকে সেল কিংবা জিজ্ঞাসাবাদ কক্ষের ভেতর না নেওয়া  পর্যন্ত  পুরোটা সময় তাদের চোখ বেঁধে রাখা হয়েছিল। একইভাবে চোখ বাঁধা অবস্থাতেই তাদের অজানা-অচেনা জায়গায় ফেলে যাওয়া হয়।

কিন্তু ক্লোজআপ-১ খ্যাত সংগীতশিল্পী রানাকে সেভাবে তুলে নেওয়ার ঘটনা ঘটেনি।  মধ্যরাতে কালো জানলার রেজিস্ট্রেশন নাম্বারবিহীন মাইক্রোবাসে সাদা পোশাকের কেউ তাকে তুলে নিতে আসেননি।

রানার চাচা বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে কর্মরত ছিলেন। সে কারণেই কি না, চলতে বছরের ১৪ ফেব্রুয়ারি রানাকে ওই গোপন বন্দিশালায় নিয়ে যান একজন সামরিক কর্মকর্তা।

সেটা ছিল রানার বিবাহোত্তর সংবর্ধনার দিন।

সেদিনের অভিজ্ঞতার কথা বর্ণনা করে রানা বলেন, 'আমাকে পোস্ট অফিসের উল্টোপাশে সিএসডি টেস রেস্তোরাঁর বাম দিকে চকলেট ও বাদামী রঙের গেটওয়ালা একটি  দোতলা ভবনে নিয়ে যাওয়া হয়। ভবনের সামনে অনেক পুরোনো গাড়ি দাঁড় করানো ছিল।'

রানা ওই ভবনের একটি ছবি দ্য ডেইলি স্টারকে দিয়েছেন।

পর পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহের বর্ণনায় রানা বলেন, 'আমি যখন ভেতরে ঢুকি, তখন বিমানবন্দরে যে ধরনের মেটাল ডিটেক্টর আর্চ দেখা যায়, সেরকম একটি  আর্চের ভেতর দিয়ে আমাকে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে একটি অভ্যর্থনা কক্ষ ছিল এবং ডেস্কের পেছনে 'ডিরেক্টরেট জেনারেল অফ ফোর্সেস ইন্টেলিজেন্স' লেখা একটি ফলক ছিল। সেখানে থাকা লগবুকটির পাতাগুলো ছিল নীল ও লাল কালিতে লেখা নামে ভর্তি। দেখলাম রিপোর্টিং টাইমের সঙ্গে আমার নামটিও সেখানে আছে- রানা, সকাল ৮টা।'

পরবর্তীতে রানাকে যে কক্ষটিতে নিয়ে যাওয়া হয় সেখানে সোফা রাখা ছিল। রানা বলতে থাকেন, 'স্যুট পরা একজন কক্ষটিতে ঢুকলেন। পেছনে ছিলেন আরেকজন। তাদের পোশাকের গায়ে থাকা ব্যাজে লেখা ছিল ডিজিএফআই।'

এরপরই শুরু হয় টানা ৪৮ ঘণ্টার জিজ্ঞাসাবাদ।

এক পর্যায়ে ওই কক্ষে থাকা ব্যক্তিরা নির্যাতনের বিভিন্ন সরঞ্জাম এনে সামনে একটি টেবিলে বিছিয়ে রাখেন। এগুলোর ভেতর ছিল প্লায়ার্স ও লোহার কাঁটাযুক্ত অনেকগুলো রড। এক ব্যক্তি তারযুক্ত একটি যন্ত্র নিয়ে আসেন, যা দিয়ে বৈদ্যুতিক শক দেওয়া যায়।

জিজ্ঞাসাবাদ চলার মধ্যেই ওই তার এগিয়ে রানাকে হুমকি দেন তারা। রানা বলেন, 'তারা শক ডিভাইসটি মাথা বরাবর এগিয়ে এনে আমার চুল ধরে ঝাঁকুনি দেন। প্লায়ার্স ধরে রাখা একজন আমার জিভ টেনে ছিঁড়ে ফেলার হুমকি দেন।'

এক পর্যায়ে একটি ভিডিও ক্যামেরা এনে জিজ্ঞাসাবাদকারীরা রানাকে নগ্ন হতে বলেন। কিন্তু কাপড় খুলতে শুরু করার সময় এক নারী কর্মকর্তা এসে রানাকে থামিয়ে দেন।

এ সময় সেখানে উপস্থিত একজনকে রানাকে উদ্দেশ্য করে বলতে শোনা যায়, 'আপনি তো জানেন, শরীরের কোনো অংশে ক্যানসার হলে কী করতে হয়? সেটা কেটে ফেলতে হয়। আপনি সেই জায়গায় এসেছেন যেখানে আমরা সমাজের ক্যানসার কেটে ফেলি।'

রানা বলেন, 'আমি আগে কল্পিত সেই আয়নাঘরের কথা শুনেছিলাম। এখানে এসে পুরোপুরি নিশ্চিত হলাম যে এটা সেই জায়গাগুলো একটি।'

গভীর রাতে রানা যখন দুইজন গার্ডের সঙ্গে ছিলেন, তখন তিনি তাদের জিজ্ঞেস করেন যে এখানে আরও লোক বন্দি আছেন কি না। গার্ড দুজন জানান যে, 'আছে'।

রানা জানান, এখানে আসার আগে ডিজিএফআই কর্মকর্তার পরিচয় দিয়ে তাকে প্রতিদিন অনেকবার ফোন করা হতো।

এই সংগীতশিল্পী বলেন, 'এটা খুব অদ্ভুত একটা ব্যাপার ছিল। তারা আমাকে বার বার নিজে নিজেই এখানে আসতে বলতেন। যদি নিজ থেকে না আসি, আর যদি তারা আসতে বাধ্য হন, তাহলে তা আমার জন্য ভালো হবে না বলেও হুমকি দেন।'

রানা জানান, তুলে নেওয়ার পরদিন ১৫ ফেব্রুয়ারি তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়। তিনি বলেন, 'আমরা আয়োজন করে বিয়ে করার সুযোগ পাইনি। তাই ফেব্রুয়ারি আমাদের বিবাহবার্ষিকীতে একটা রিসেপশনের আয়োজন করেছিলাম। স্ত্রীকে উপহার দিয়েছিলাম তার স্বপ্নের লাল রঙের বিয়ের জামা। সেদিন সকাল ৮টায় আমাকে ডিজিএফাইয়ের সেই বন্দিশালায় নিয়ে যাওয়ার পর থেকে পুরোটা সময় আমার পরিবারের সদস্যরা ভেবেছিল যে আমি ফিরে আসব। কিন্তু আমার আসা হয়নি। এ অবস্থায় অতিথিরা এসে হতভম্ব হয়ে ফিরে যান।'

কিন্তু রানাকে কেন সেখানে যেতে হয়েছিল তা তিনি এখনো জানতে পারেননি।

চলতি মাসের শুরুর দিকে  গুম হওয়া ব্যক্তিদের স্বজনদের প্ল্যাটফর্ম 'মায়ের ডাক'র নেতৃত্বে মানবাধিকারকর্মীদের একটি প্রতিনিধি দল ডিজিএফআই সদর দপ্তরে যান ভিকটিমদের অবস্থান সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করতে।

ওই প্রতিনিধিদলকে জানানো হয়, ডিজিএফআইয়ের এমন ২৩টি জায়গা আছে। কিন্তু বন্দিশালাগুলোর অবস্থান কোথায়, কোনো বন্দিকে ওই জায়গাগুলোতে রাখা হয়েছে কি না, সে বিষয়ে আজ পর‌্যন্ত কোনো তথ্য তাদের দেওয়া হয়নি।

এ ব্যাপারে ডিজিএফআইয়ের কোনো বক্তব্য জানতে পারেনি ডেইলি স্টার।

গুম হয়ে ফিরে আসা অন্য ব্যক্তিরাও প্রায়ই অভিযোগ করেন যে তাদের ডিজিএফআইয়ের বন্দিশালায় আটক রাখা হয়েছিল। কিন্তু মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের দেওয়া তথ্য বলছে, ডিজিএফআই ছাড়াও আরও অনেক সংস্থা এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে।

২০০৯ থেকে ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত গুম হওয়া ৭০৯ জনের একটি তালিকা করেছে অধিকার। ওই তালিকা অনুসারে ভুক্তভোগীদের মধ্যে ২০৬ জনকে র ্যাব, ২৪০ জনকে পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ ও ১০৪ জনকে পুলিশ তুলে নিয়ে গেছে।

আর মাত্র নয় জনকে তুলে নেওয়ার ক্ষেত্রে ডিজিএফআইয়ের জড়িত থাকার অভিযোগ উঠেছে। বাকি ১২৯ জনকে কারা তুলে নিয়ে গেছে, তা শনাক্ত করা যায়নি।

তবে অভিযোগ আছে, এদের তুলে নেওয়ার ঘটনায় পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি), আনসার ও শিল্প পুলিশ জড়িত।

Comments