বন্যায় ভেসে গেছে প্রবাসফেরত তপনের স্বপ্ন

ফেনীতে সাম্প্রতিক আকস্মিক বন্যায় প্রবাসফেরত তপনের দোকানের সব মালামাল নষ্ট হয়ে গেছে। ছবি: আহমাদ ইশতিয়াক/স্টার

বিশ্বজুড়ে করোনা প্রকোপ শুরুর মাস দুয়েক দেশে এসেছিলেন তপন চন্দ্র শীল। কিন্তু বিধি বাম। করোনায় উড়োজাহাজ চলাচল বন্ধ হলে আটকা পড়ে যান। 

আর বিদেশে ফেরা হয়নি তার। দেশে ব্যবসার চেষ্টা করেন এই প্রবাসী। একের পর এক ব্যবসায় লোকসান হলেও চলতি বছর অনেকটা ঘুরে দাঁড়িয়েছিলেন। কিন্তু আকস্মিক বন্যায় সেই আশাও পানিতে ভেসে গেছে তপনের।

তপন চন্দ্র শীলের বাড়ি ফেনীর ফুলগাজী উপজেলার মুন্সিরহাট ইউনিয়নের উত্তর আনন্দপুর গ্রামে। সবশেষ একটি মুদি দোকান চালাচ্ছিলেন তিনি।

গতকাল সোমবার তার সঙ্গে দেখা হয় আনন্দপুর গ্রামে। সে সময় তিনি বন্যায় দোকানের জমে যাওয়া কাদাপানি পরিষ্কার করছিলেন। 

দোকানের একপাশে তখনো স্তূপাকারে পড়ে আছে বন্যার পানিতে নষ্ট হয়ে যাওয়া সারি সারি মুদি মালামাল। একপাশে পড়ে আছে পানি ঢুকে নষ্ট হয়ে যাওয়া দুটি ফ্রিজ।

চোখে মুখে তার রাজ্যের হতাশা আর চাপা কষ্ট। তপন জানান, ২০২০ সালের শুরুতে মালয়েশিয়া প্রবাসী ছিলেন। সেখানে সবকিছু ভালোই চলছিল। ওই বছরের জানুয়ারিতে ছুটি নিয়ে দেশে এসেছিলেন।

এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে মালয়েশিয়ায় ফেরার ফিরতি টিকিট কাটা ছিল তার। কিন্তু মার্চে করোনা প্রকোপ শুরু হলে উড়োজাহাজ চলাচল বন্ধ হয়ে যায় এবং তিনি দেশে আটকা পড়েন।

ফেনীতে সাম্প্রতিক আকস্মিক বন্যায় প্রবাসফেরত তপনের দোকানের সব মালামাল নষ্ট হয়ে গেছে। ছবি: আহমাদ ইশতিয়াক/স্টার

করোনা শেষ হলেও পরবর্তীতে আর মালয়েশিয়ায় ফিরে যাননি তপন। জমানো টাকা দিয়ে সাংসারিক ব্যয় নির্বাহ করতে পারলেও, একপর্যায়ে আর্থিক সংকটে পড়েন। তখন বিভিন্ন জায়গায় চেষ্টা করেও কাজ পাননি। 

আত্মীয়-স্বজনদের কাছ থেকে টাকা ধার নিয়ে এবং জমি বিক্রি করে কয়েক দফা ব্যবসায়ের চেষ্টা করেন। গত বছরের অক্টোবরে আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে তিন লাখ টাকা ধার নিয়ে ও নিজের কাছে থাকা কিছু টাকা দিয়ে বাড়ির সামনে মুদি দোকান চালু করেন।

ব্যবসা ভালোই যাচ্ছিল। দোকান থেকে লাভ হচ্ছিল, ধারদেনাও কিছু কিছু করে শোধ হচ্ছিল। কিন্তু ২০ আগস্ট রাতে শুরু হওয়া আকস্মিক বন্যার পানি প্রবেশ করে তপনের দোকানে। আর তাতেই সর্বস্বান্ত হয়ে পড়েন তিনি।

ওই রাতের কথা বলতে গিয়ে তপন নিজেকে সামলাতে পারছিলেন না। কান্নাভেজা গলায় তপন বলেন, 'বৃষ্টি থাকায় মঙ্গলবার রাতে আমি আগে আগেই বাড়িতে চলে গেছিলাম। রাতের বেলা ঢলের সঙ্গে দোকানে পানি ঢোকে। সকালে দোকান খোলা তো দূরের কথা, বাড়ির সামনেই এক তলা সমান পানি। পাশেই একটা পাকা বাড়িতে গিয়ে উঠি।'

'পানির স্রোতের কারণে তিনদিন বাড়ি থেকে বের হতে পারিনি। এরপরও দোকানে বুক সমান পানি ছিল। এ সপ্তাহে রোববার পানি কমলেও দোকানে ঢোকার সাহস পাইনি। বুঝে গিয়েছিলাম গিয়ে কী দেখব,' বলেন তিনি।

তপন জানান, দোকানে প্রায় সাড়ে তিন লাখ টাকার মূল্যের মুদি পণ্য ছিল তার। কিন্তু এর মধ্যে কিছুই বাঁচাতে পারেননি তিনি।

তপনের সঙ্গে যখন কথা হয় তখন দুপুর গড়িয়ে বিকেল। তিনি বলেন, 'সকাল থেকে এতক্ষণ কাদা আর জল সাফ করছি।  সবমিলিয়ে ২০ হাজার টাকার মালও টেকেনি। কাদা আর জলে দুইটা ফ্রিজই নষ্ট হয়ে গেছে। সকাল থেকে যাই ধরছি সব ফেলে দিতে হয়েছে। সব পচে গেছে।' 

ভিজে নষ্ট হয়ে গেছে দোকানের বাকি বিক্রির হিসেব খাতাও। ফলে সেই টাকা আদায়ের সম্ভাবনা ক্ষীণ বলে জানান তপন।

হতাশা ও আক্ষেপের স্বরে বলেন, 'নিজের মাথার ঘাম পায়ে ফেলে তিল তিল করে দোকানটা তুলেছিলাম। বিক্রি ভালো হওয়ায় সকাল ছয়টা থেকে রাত ১০-১১টা পর্যন্ত দোকান খোলা রাখতাম। পানি ঢোকার আগের দিনও ৮৮ হাজার টাকার মুদি মালামাল দোকানে তুলেছিলাম। দোকানে আইসক্রিম ভালো বিক্রি হওয়ায় ১৫ হাজার টাকা আইসক্রিম সেদিন ফ্রিজে এনে রাখি। সব নষ্ট হয়ে গেছে।'

আক্ষেপের স্বরে তপন বলেন, 'ওই দিন যদি মালামাল আর আইসক্রিমটা না কিনতাম, তাও অন্তত ঘুরে দাঁড়ানো যেত। কিন্তু আমার এখন তো সব শেষ হয়ে গেল। সব মিলিয়ে ৫ হাজার টাকাও আমার হাতে ক্যাশ নাই।'

একইসঙ্গে করোনার আগে মালয়েশিয়া থেকে ছুটিতে এসে না ফেরার আক্ষেপের কথাও ঘুরেফিরে বলেন তপন। 'আমার কপালই খারাপ। মালয়েশিয়া থেকে আসাই আমার কাল হয়েছিল। ওখানে থেকে গেলেই ভালো থাকতাম।'

কীভাবে ধারের টাকা শোধ করবেন সেই চিন্তাও পেয়ে বসেছে তাকে। বলেন, 'দোকানটাই আমার শেষ আশ্রয় ছিল। দোকানের বিক্রি থেকেই ধারদেনা শোধ করছিলাম। এখন কীভাবে যে আত্মীয়-স্বজনের বাকি ধারদেনা শোধ করব, আর কীভাবে সংসার চালাব জানিনা।'

Comments

The Daily Star  | English
The Indian media and Bangladesh-India relations

The Indian media and Bangladesh-India relations

The bilateral relationship must be based on a "win-win" policy, rooted in mutual respect, non-hegemony, and the pursuit of shared prosperity and deeper understanding.

3h ago