নজরদারির কাজে ১৬ বছরে সরকারের ব্যয় কত, শ্বেতপত্র প্রকাশের দাবি
রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার নামে টেলিফোনে আড়িপাতা, ফোনালাপ ফাঁস এবং ইন্টারনেট নজরদারির মতো ব্যক্তিগত গোপনীয়তা লঙ্ঘনের সব ঘটনাকে অসাংবিধানিক বলে অভিহিত করেছেন একটি নাগরিক সংলাপে অংশ নেওয়া বক্তারা। তারা বলেছেন, গত দেড় দশকে আওয়ামী লীগ সরকার বিরোধী রাজনীতিবিদসহ জনসাধারণের ওপর নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য এসব নজরদারির কাজে হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয় করেছে।
এ পর্যায়ে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান পরবর্তী নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতায় নজরদারি বাবদ আওয়ামী লীগ সরকার কোন খাতে কত টাকা ব্যয় করেছে, কারা কারা এর সঙ্গে জড়িত, কে এমন নজরদারির নির্দেশ দিয়েছেন—এমন সবকিছু শ্বেতপত্র আকারে প্রকাশের দাবি জানান তারা। সেইসঙ্গে টেলিফোনে আড়িপাতা সংস্থা ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টার (এনটিএমসি) এবং ইন্টারনেট শাটডাউন, কনটেন্ট ফিল্টারিং ও ওয়েবসাইট ব্লকিংয়ের কাজে নিয়োজিত সংস্থা ডিপার্টমেন্ট অব টেলিকমিউনিকেশনসের (ডিওটি) বিলুপ্তির দাবি জানিয়েছেন তারা।
আজ শনিবার রাজধানীর কারওয়ান বাজারের বিডিবিএল ভবনে 'নতুন বাংলাদেশে আড়িপাতা, গোপনীয়তার অধিকার ও বাক স্বাধীনতা' শীর্ষক এই নাগরিক সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়। এটি আয়োজন করে 'সিভিল রিফর্ম গ্রুপ—বাংলাদেশ ২.০' নামের একটি প্ল্যাটফর্ম ।
সংলাপে সাইবার বিশেষজ্ঞ সুমন আহমেদ সাব্বির বলেন, 'যেকোনো নাম্বার ট্যাপ করার সক্ষমতা তাদের (এনটিএমসি) আছে। কিন্তু একসঙ্গে প্রত্যেকের কল রেকর্ডের সক্ষমতা তাদের নেই। এখন আমাদের মোবাইল গ্রাহকের সংখ্যা যদি ১০ কোটি হয় আর তাদের মধ্যে এক শতাংশও যদি ট্যাপ করা হয় তাহলে সেই সংখ্যাটা কিন্তু অনেক বড়।'
এই সাইবার বিশেষজ্ঞ আরও বলেন, 'উন্নত দেশগুলোতে কারও ফোন ট্যাপ করতে গেলে অবশ্যই কোর্ট অর্ডার লাগে। সেই অর্ডার হাতে পেলে অপারেটর একটা অ্যাক্সেস দেয়। কিন্তু আমাদের দেশে অপারেটরগুলোকে একপ্রকার বাধ্য করা হয়।'
সংলাপে দ্য ডেইলি স্টার বাংলা সম্পাদক গোলাম মোর্তোজা বলেন, 'পেগাসাসসহ আমরা যে সমস্ত ইসরায়েলি প্রযুক্তি পেয়েছি এবং এগুলো কেনার সময় রাষ্ট্রীয়ভাবে আমরা যে সমস্ত বেআইনি কাজ করেছি, অপরাধমূলক কাজ করেছি সেগুলো কার নির্দেশে হয়েছে, কোন প্রক্রিয়াতে কেনা হয়েছে, টাকা কীভাবে পরিশোধ করা হয়েছে—এই তথ্যগুলো বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে সুনির্দিষ্ট করে জানতে চাই নাগরিক হিসেবে। জানতে চাই আমরা যতটুকু জানি ততটুকুই সত্য, না কি এই জানার বাইরে আরও সত্য আছে।'
গোলাম মোর্তোজা আরও বলেন, 'দেশের বাইরে এ সংক্রান্ত যতগুলো ডিল হয়েছে—কোনো কোনো ডিল হয়েছে লন্ডন থেকে, কোনো কোনো ডিল হয়েছে ওয়াশিংটন থেকে। এর সঙ্গে শেখ রেহানা কিংবা সজীব ওয়াজেদ জয়ের সম্পৃক্ততা কতটু্কু ছিল?'
এছাড়া যে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার নাম করে ব্যক্তিপরিসরে এমন নজরদারি চালানো হয়েছে, সেখান থেকে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার কোনো ধরনের বিঘ্ন আজ অবধি হয়েছে কি না সে সংক্রান্ত তথ্যও জানতে চান তিনি।
গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি বলেন, 'এই ফ্যাসিস্ট রেজিমে আমরা যেভাবে আমাদের জীবন কাটিয়েছি তার মধ্যে একটা বড় ঘটনা ছিল মানুষের ব্যক্তিগত গোপনীয়তার অধিকারের চরম লঙ্ঘন। সেটা পুরো রাষ্ট্র দিয়ে, যন্ত্র দিয়ে, প্রতিষ্ঠানগুলো দিয়ে করানো হয়েছে।
'সুতরাং এখন আমাদের আলাপের বিষয় হওয়া উচিত কীভাবে রাষ্ট্রীয় কাঠামো দিয়ে ব্যক্তির সমস্ত অধিকারগুলোকে আগের সরকার তার হাতের বিষয়ে পরিণত করেছিল, তার ইচ্ছা-অনিচ্ছার বিষয়ে পরিণত করেছিল। এমনকি তার দয়াদাক্ষিণে পরিণত করেছিল এবং লেনদেনের বিষয়ে পরিণত করেছিল।'
এই রাজনৈতিক নেতার ভাষ্য, গত ১৬ বছরে বিশেষ যে সংস্থাগুলো আড়ি পাতার কাজ করেছে, তাদের শ্বেতপত্র প্রকাশ করা দরকার। যা যা হয়েছে তা জানা দরকার এবং এর সঙ্গে জড়িতদের জবাবদিহি ও বিচারের আওতায় আনা দরকার।
লেখক ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব বলেন, 'আমাদের ছাত্ররা সারা জীবন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তাদের ডেটা দেয়। সেটা কে, কারা, কীভাবে ব্যবহার করে? যে ডিজিটাল লেনদেনগুলো হচ্ছে সেখানে অনেক প্রাইভেট ডেটা থাকে। আমরা এয়ারপোর্ট থেকে শুরু করে মোবাইল কোম্পানিসহ বিভিন্ন জায়গায় যে প্রাইভেট ডেটাগুলো দেই এগুলো কে কোথায় কীভাবে ব্যবহার করে সে বিষয়গুলো নিয়ে কথা বলার সময় হয়েছে।'
সাংবাদিক আশরাফ কায়সার বলেন, 'আমরা এনটিএমসি ও ডিওটির মতো প্রতিষ্ঠানগুলোর বিলুপ্তি চাই এবং সেই টাকা আমরা শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় করতে চাই। জানতে চাই, গত ১৫-১৬ বছরে আড়ি পাতার জন্য কোন কোন যন্ত্র কিংবা সফটওয়্যার কেনা হয়েছে? আমার ট্যাক্সের টাকায় পেগাসাসের মতো আর কোন যন্ত্র কেনা হয়েছে? এর গ্লোবাল প্রাইস কত এবং বাংলাদেশ তা কত দামে কিনেছে?'
সাংবাদিক জুলকারনাইন সায়ের খান সামির ভাষ্য, 'কেবল বাংলাদেশ না। যুক্তরাজ্য, যুক্তরাজ্যসহ পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই আড়িপাতা হয়। এসব জায়গায় সরকার যেখানে যেভাবে প্রয়োজন বোধ করে সেভাবে আড়ি পাতে। কিন্তু নাগরিকদের জীবনে ব্যাঘাত ঘটার মতো কিছু তারা করে না। আড়ি পেতে অনেক রকমের তথ্য তারা সংগ্রহ করে। কিন্তু আমাদের দেশে এটা অনেক নিকৃষ্টভাবে হয়েছে।'
সামি আরও বলেন, 'শেখ হাসিনা গণভবন থেকে বের হওয়ার পর সেখান থেকে অনেকগুলো সিডি উদ্ধার করা হয়েছে। এর কপিও আমার কাছে এসেছে। এগুলোর রেকর্ড এতই ভয়াবহ যে এগুলো যদি বাইরে প্রকাশ হয় অনেক পলিটিশিয়ানের ক্যারিয়ার নষ্ট হয়ে যেতে পারে। এমন ভয়ঙ্কর রকমের তথ্য উনি ওনার নিজের কাছে রাখতেন। তাতে বোঝা যায়, এ ধরনের তথ্য নিজের কাছে রেখে উনি তাদের ম্যানিপুলেট করতেন।'
এনটিএমসি প্রসঙ্গে মুঠোফোন গ্রাহক অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, 'মূলত এই প্রতিষ্ঠানটি করা হয়েছিল তারেক জিয়াকে মনিটরিং করার জন্য, তার তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করার জন্য। যদিও বলা হয়েছিল এটি আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সহযোগী হিসেবে কাজ করবে এরা।'
মহিউদ্দিন আহমেদ বলছেন, নজরদারির কাজে আওয়ামী লীগ সরকার গত ১৬ বছরে দুই থেকে আড়াই হাজার কোটি টাকা ব্যয় করেছে।
সংলাপে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, 'এনটিএমসির প্রয়োজন নেই। ডিওটির প্রয়োজন নেই। রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার জন্য গোয়েন্দা সংস্থার তথ্য সংগ্রহের প্রয়োজন আছে। কিন্তু রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা আর সরকারের বহুমত দমনের হাতিয়ার এক ব্যাপার নয়।
'অন্তর্বর্তী সরকারকে এমন একটা কাঠামো তৈরি করতে হবে তাতে ভবিষ্যতে যারা ক্ষমতায় আসবেন তারা যেন একই সংস্কৃতির কাছে জিম্মি না হন।'
তথ্যপ্রযুক্তিবিদ জাকারিয়া স্বপন বলেন, 'আড়িপাতা থাকবেই। কিন্তু এটা দিয়ে কাউকে ধরব, ব্ল্যাকমেইল করব এটা তো হতে পারে না।'
সংলাপে সবার শেষে বক্তব্য দেন সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী সারা হোসেন। তিনি নজরদারির পাশাপাশি গত সরকারের আমলে প্রবর্তিত ডিএসএ, সিএসএসহ বিভিন্ন নিবর্তনমূলক আইনের ব্যাপারে আলোচনা করেন। এসময় উপস্থিত সাংবিদকদের উদ্দেশ্য করে তিনি বলেন, 'নতুন এই সময়ে এখনো পুলিশসহ রাষ্ট্রীয় বাহিনী যা বলছে সেটাই আপনার ছেপে দিচ্ছেন। এটা ঠিক না।'
আরও বক্তব্য রাখেন টেক গ্লোবাল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক সাবহানাজ রশীদ, আইনজীবী মিতি সানজানা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ বি এম মইনুল হোসেন।
সংলাপটি সঞ্চালনা করেন বেসিসের সাবেক সভাপতি ও বিডিজবসের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ফাহিম মাশরুর।
Comments