বন্যা শুধু পানি ব্যবস্থাপনা না, বাংলাদেশের নিরাপত্তার দৃষ্টিতে দেখার সময় এসেছে

বিশেষজ্ঞদের মত, কেবলমাত্র ভারী বৃষ্টি বন্যার একমাত্র কারণ না। ভারত ব্যারেজ খুলে দেওয়ায় উজান থেকে নেমে আসা পানি বাংলাদেশের অন্তত আটটি জেলা ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।
ফেনীর বন্যার চিত্র | ছবি: রাজীব রায়হান/স্টার

একাধিক সংস্থা ও আবহাওয়াবিদরা গত জুলাইয়ে আশঙ্কা করেছিলেন আগস্টে বন্যা হতে পারে। সক্রিয় মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে চলতি মাসের শুরু থেকেই দেশের উপকূলীয় এলাকায় বাড়ে বৃষ্টিপাতের প্রবণতা। এর মধ্যে পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকায় একটি লঘুচাপের সৃষ্টি হয়। এর প্রভাবে জমতে শুরু করে মেঘ। সেই মেঘ ভূখণ্ডে ঢুকে বাড়ায় বৃষ্টির পরিমাণ।

তবে বিশেষজ্ঞদের মত, কেবলমাত্র ভারী বৃষ্টি বন্যার একমাত্র কারণ না। ভারত ব্যারেজ খুলে দেওয়ায় উজান থেকে নেমে আসা পানি বাংলাদেশের অন্তত আটটি জেলা ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।

আজ বৃহস্পতিবার দ্য ডেইলি স্টারের সঙ্গে আলাপকালে জলবায়ু বিশেষজ্ঞ ও ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির ইমেরিটাস অধ্যাপক আইনুন নিশাত, নদী ও ব-দ্বীপ গবেষণা কেন্দ্রের (আরডিআরসি) চেয়ারম্যান ও নদী বিশেষজ্ঞ মোহাম্মদ আজাজ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ গওহার নঈম ওয়ারা এই বন্যা নিয়ে তাদের পর্যবেক্ষণ জানিয়েছেন।

মোহাম্মদ আজাজ বলেন, 'নিশ্চিতভাবেই অতিবৃষ্টি এখানে বন্যার একটি বড় কারণ। বাংলাদেশে এখন বর্ষায় প্রচুর বৃষ্টি হয় এবং এই অঞ্চল থেকে মেঘালয় পর্যন্ত বৃষ্টিপাত হয়। আমাদের দেশে যত বন্যা হয়, সেটি মূলত উজান থেকে নেমে আসা পানিতে বন্যা হয়। উজানের পানি ভাটিতে নামবে, এটা স্বাভাবিক ব্যাপার। ফেনী, নোয়াখালী ও কুমিল্লার একটি অঞ্চলে রাতারাতি যে পানির স্রোত, এটা স্বাভাবিক না।

'এটা দেখলেই বোঝা যায়, কোথাও না কোথাও পানিটা ধরে রেখে তারপর হঠাৎ করে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। পরে আমরা অনুসন্ধান করে দেখেছি, গোমতী নদীর ঠিক উপরেই একটি ছোট্ট হাইড্রো প্রোজেক্ট আছে তিন মেগাওয়াটের। সেই গেটগুলো কিন্তু খোলা। আরও কিছু ছোট ছোট ব্যারেজ আছে,' বলেন তিনি।

আজাজ বলেন, 'প্রশ্ন উঠতে পারে দায় কার? আমাদের আন্তঃসীমান্ত নদীগুলো দেখাশোনা করার জন্য একটি জয়েন্ট রিভার কমিশন আছে। এই কমিশনের কাজ হলো, শুষ্ক মৌসুমে আমরা আমাদের অধিকার অনুযায়ী পানি পাচ্ছি কি না দেখা এবং বাংলাদেশের পক্ষে নেগোশিয়েট করা। সেটা গত ১৫ বছরে সিস্টেমেটিক্যালি অকেজো করে দেওয়া হয়েছে, যেন কথা না বলতে পারে।

'এই কমিশনের আরেকটি কাজ হলো বর্ষায় যখন প্রচুর বৃষ্টি হবে, তখন বন্যার পূর্বাভাস দেওয়া। যেহেতু পানি সব সময় আসবেই, আমরা জানি। ভাটিতে পানি আসার আগে পূর্বাভাস দিলে আমরা প্রস্তুতি নিতে পারি। সেটা কিন্তু হয়নি। ভারতের পক্ষ থেকে বন্যার কোনো পূর্বাভাস আমরা পাইনি। বাংলাদেশও সেটা নিয়ে সম্পূর্ণ নির্বাক। এই যে চর্চা, ইচ্ছা হলেই আমরা পানি ছেড়ে দিচ্ছি, পানির ঢল নেমে আসছে বাংলাদেশে—এই চর্চা গত ১৫ বছরে আমরা অনেক বেশি দেখতে পাই,' যোগ করেন তিনি।

এই নদী বিশেষজ্ঞ বলেন, 'আজকে গোমতী ও ফেনী নদীতে যেটা ঘটলো, একই ঘটনা বারবার তিস্তায় হয়। তিস্তায় এখন বছরে তিনবার বন্যা হয়! সিলেটেও হয়। এর বড় কারণ হলো, উজানে প্রতিটি নদীর ওপর ড্যাম প্রোজেক্ট আছে। ছোট ছোট অনেক হাইড্রো ড্যাম আছে। এই ড্যামগুলোর যদি আমরা ভারতের ইকোনোমিক ভ্যালু দেখি, গোমতী নদীর ওপর যে ড্যামটি আছে মাত্র তিন মেগাওয়াট। এই বিদ্যুতে একটি ছোট গ্রামও আলোকিত করা যায় না কিন্তু তিন মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্র যে পরিমাণ পানি ধরতে পারে, সেটি পাশের যে কোনো ধরনের এলাকাকে ক্ষতিগ্রস্ত (নুইসেন্স) করতে পারে। এটি অস্ত্র—বিদ্যুৎ প্রকল্প না।'

তিনি বলেন, 'গত ৫৩ বছরে ৫৪টি আন্তঃসীমান্ত নদীতে ৩০ থেকে ৪০ হাইড্রো ড্যাম কমিশন হয়েছে। আন্তঃসীমান্ত নদীতে কোনো ধরনের প্রকল্প বাংলাদেশের অনুমতি ছাড়া ভারত করতেই পারে না। গত ৫০ বছরে কোনো সরকারের আমলে আমরা রাষ্ট্রীয়ভাবে উদ্বেগ প্রকাশ করতে দেখিনি। যে কারণে ড্যাম তারা করে ফেলেছে। এখন তারা এটা অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে।

'আমি মনে করি, বন্যা শুধুমাত্র পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনার দৃষ্টিতে না দেখে, আমাদের নিরাপত্তার দৃষ্টিতে দেখার সময় এসেছে। আগেই দেখা উচিত ছিল, আমরা দেখতে পারিনি। তিস্তার বন্যা, সিলেটের বন্যা, এখন এখানে বন্যা—ভারত ইচ্ছা মতো পানি ছাড়ে এবং আমরা কোনো প্রতিবাদ করি না; গত ১৫ বছরে আমরা প্রতিবাদ করিনি, সেই কারণে এটি ভারতের সাধারণ চর্চায় পরিণত হয়েছে যে, চাইলেই আমি পানি ছেড়ে দিতে পারি, চাইলেই আমি এখানকার লোকজনকে বানে ভাসিয়ে দিতে পারি এবং পুরো এলাকাটাকে ভালনারেবল করে ফেলতে পারি,' বলেন তিনি।

আজাজ বলেন, 'গত ১৫ বছরে চর্চা তৈরি হয়েছে কোনো কথা বলা যাবে না। ভারতের সঙ্গে আন্তঃসীমান্ত নদী নিয়ে কথা বলা নেই। এমনকি প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে শেখ হাসিনা তিস্তার বন্যার পক্ষে কথা বলেছেন, বন্যা তো খারাপ না, বন্যা হলে তো কৃষকের জমি উর্বর হয়। এগুলো জনগণের সঙ্গে তামাশা করা। যেখানে আমাদের অধিকার-অস্তিত্ব ঝুঁকিতে ফেলবে, সেখানে তারা ভারতের পক্ষে সাফাই গেয়েছে। এগুলো কারণে জয়েন্ট রিভার কমিশনের সাহস হয়নি যে, তারা এই নেগোশিয়েট করবে। ফলে একটি অকেজো জয়েন্ট রিভার কমিশনের কারণে আরও কিছু সমস্যা হয়েছে।'

অভ্যন্তরীণ সমস্যা তুলে ধরে তিনি বলেন, 'ঠিক আছে ফ্ল্যাশ ফ্লাড নামবে, আমাদের এখানে অসংখ্য নদী-খাল আছে, সেগুলো দিয়ে আমরা পানি বের করে দেবো। গত ১৫ বছরে শুধু কুমিল্লা, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর ও ফেনীতে প্রায় ১৮ হাজার নদী দখলদার সরকারের তালিকায় আছে, যারা আওয়ামী লীগ করে। রাষ্ট্রীয় তত্ত্বাবধানে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা যদি অভ্যন্তরীণ সব নদী খেয়ে ফেলে, তাহলে পানিটা যাবে কোন দিক দিয়ে!

'যত ফুটেজ দেখা যাচ্ছে, স্কুল ডুবে গেছে, মসজিদ ডুবে গেছে, বাড়ি ডুবে গেছে, এই সবগুলোর পাশেই কিন্তু খাল আছে। এই পুরো অঞ্চলে প্রত্যেকটা হাট-বাজার খালের পাশে। নোয়াখালীর ভৌগলিক বৈশিষ্ট্যই এ রকম—খালের পাড়ে হাট-দোকান, পেছনে খাল, সামনে স্কুল, রাস্তার দুপাশে খাল। এগুলো সব ভরাট করে গিলে ফেলেছে রাজনৈতিক দৌরাত্ম্যে এবং এটার বিরুদ্ধে কেউ কথা বলেনি। নদী রক্ষা কমিশন একটি তালিকা প্রকাশ করে রেখে দিয়েছে, কোনো বাস্তবায়ন আমরা লক্ষ্য করিনি। ফলে প্রাকৃতিকভাবে এই দুর্যোগ আমি মোকাবিলা করতে পারবো না। আমরা একটি ক্ষেত্র তৈরি করেছি গত ১৫ বছরে, যাতে অস্ত্রটা আমি প্রতিবেশীর হাতে তুলে দিয়েছি,' যোগ করেন আজাজ।

তিনি আরও বলেন, 'এখন আমাদের ভাবতে হবে, পুরো পাশে ভারতের যে বিনিয়োগ হয়েছে সেটার প্রকৃতি কী রকম এবং আমরা এটাকে কীভাবে মোকাবিলা করতে পারবো।'

মৌলভীবাজারের বন্যার চিত্র | ছবি: মিন্টু দেশোয়ারা/স্টার

এক নজরে বন্যার ক্ষতি

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের দুপুর ১টা পর্যন্ত তথ্য অনুসারে, আটটি জেলা—ফেনী, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, খাগড়াছড়ি, নোয়াখালী, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ৫০টি উপজেলা প্লাবিত হয়েছে এবং ৩৫৭টি ইউনিয়ন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

এসব জেলায় পানিবন্দি আছেন চার লাখ ৪০ হাজার ৮৪০টি পরিবার। ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ ২৯ লাখ চার হাজার ৯৬৪ জন। এখন পর্যন্ত ফেনীতে ও ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে দুইজন মারা গেছেন।

কক্সবাজার থেকে থেকে দ্য ডেইলি স্টারের প্রতিবেদক জানিয়েছেন, বন্যায় এদিন সকালে রামু উপজেলায় আরও অন্তত একজনের মৃত্যু ও দুইজন নিখোঁজ হয়েছেন।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় আরও জানিয়েছে, এক হাজার ৫৩৪টি আশ্রয়কেন্দ্রে আজ দুপুর দেড়টা পর্যন্ত ৭৫ হাজার ৬৭৮ জন আশ্রয় নিয়েছেন। আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে প্রায় সাড়ে সাত হাজার গবাদি পশু আশ্রয় নিয়েছে। আটটি জেলাতে মোট ৪৪৪টি মেডিকেল টিম কাজ করছে। ফেনীতে সেনাবাহিনী ও নৌবাহিনী কাজ করছে।

ফেনীর বন্যার চিত্র | ছবি: রাজীব রায়হান/স্টার

সতর্কতার অভাব

অধ্যাপক আইনুন নিশাত বলেন, 'আমাদের এখানে বন্যার প্রধানতম কারণ বাংলাদেশ অংশে ভারী বৃষ্টি। পাশাপাশি উজান থেকে পানি এসেছে।'

তিনি বলেন, '১৯৬২ সালে কাপ্তাই ড্যাম তৈরির আগে এর ভাটিতে রাউজান কিংবা এর পাশের এলাকায় প্রতি বছর প্রচণ্ড বন্যা হতো। কাপ্তাই ড্যাম হওয়ার পরে বন্যা নিয়ন্ত্রণে আছে। একই ঘটনা গোমতীতেও হচ্ছে। উজানে তারা ড্যাম তৈরি করেছে বিদ্যুৎ উৎপাদন ও বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য। গত ৩০-৪০ বছরে এর ভাটিতে কোনো বন্যা হয়নি। ভারতের ত্রিপুরা ও বাংলাদেশের কুমিল্লা অঞ্চলে বন্যা কমে গেছে,' বলেন তিনি।

এই জলবায়ু বিশেষজ্ঞ বলেন, 'জলাধারগুলো বর্ষার প্রথমেই পানি দিয়ে ভর্তি করে ফেলার চেষ্টা করা হয়। বর্ষার শেষে বৃষ্টি নাও হতে পারে। বর্ষায় বৃষ্টি হওয়ার কথা, হয়েছে। তবে এবার অস্বাভাবিক অতি বৃষ্টি হয়েছে। ৩০০-৩৫০ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। ভারতেও প্রচুর হচ্ছে।

'দিল্লিতে আবহাওয়া অধিদপ্তর অরেঞ্জ অ্যালার্ট দিয়েছে। ত্রিপুরা প্রশাসন রেড অ্যালার্ট জারি করেছে। অর্থাৎ মানুষকে তারা প্রস্তুত করেছে। আমাদের এখানে আবহাওয়া দপ্তর গত ৫০ বছর ধরে যেভাবে বলে চলেছিল, সেভাবেই বলে চলেছে "ভারী বৃষ্টি হতে পারে"। এটা তো স্থানীয়ভাবে সতর্কবাণী দিতে হবে! এ রকম ৩০০ মিলিমিটার বৃষ্টি ঢাকাতেও হতে পারে, বর্ষায় যে কোনো সময় হতে পারে। এ রকম বৃষ্টি ত্রিপুরায় হয়েছে, ফেনীতে হয়েছে,' যোগ করেন তিনি।

আইনুন নিশাত বলেন, 'ত্রিপুরার কিছু পানি নামছে গোমতী দিয়ে, যেটা জলাধারে ধরা ছিল। জলাধার খুলে দিতে হয়েছে, কারণ তাছাড়া জলাধার ঝুঁকি তৈরি করবে। প্রশ্ন হচ্ছে তারা রিজার্ভারের গেট খুলে দিয়েছে কি না? এই তথ্যটা বাংলাদেশকে সঙ্গে সঙ্গে জানিয়েছে কি? গেট খুলে দিতে হতে পারে কিন্তু তথ্যটা আমাদের দিলে আমরা পূর্বাভাস দিতে পারি, প্রস্তুতি নিতে পারি। আমার ধারণা, পানি উন্নয়ন বোর্ডের কাছে এই পূর্বাভাস আছে। তারা যদি পূর্বাভাস প্রচার না করে, তাহলে তো কোনো লাভ নেই।'

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বন্যার চিত্র | ছবি: মাসুক হৃদয়/স্টার

পর্যাপ্ত প্রস্তুতি ছিল?

আবহাওয়া অধিদপ্তর বেশ কয়েক দিন আগেই বন্যার পূর্বাভাস দিয়েছিল বলে জানিয়েছেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব কে এম আলী রেজা।

তিনি বলেন, 'সে অনুযায়ী আমরা প্রস্তুতি নিয়েছি। কন্ট্রোল রুম চালু করা হয়েছে। বিভিন্ন পর্যায়ে প্রয়োজন কমিটিগুলো সক্রিয় হয়েছে। বন্যা শুরুর আগেই আমরা ত্রাণ সামগ্রী পাঠিয়ে দিয়েছি।'

তবে বন্যা কবলিত এলাকায় পর্যাপ্ত সহায়তার ঘাটতি দেখা গেছে।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ গওহার নঈম ওয়ারা বলেন, 'মেঘ জমছে, বৃষ্টি হবে সেই পূর্বাভাস আবহাওয়া অধিদপ্তর আগেই দিয়েছিল। অথচ সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।'

তিনি বলেন, 'ভারতের উচিত ছিল অন্তত পাঁচ ঘণ্টা আগে জানানো যে, আমাদের এখানে পানি বাড়ছে, আমরা ব্যারেজ খুলে দেওয়ার কথা চিন্তা করছি। সেটাও তারা করেনি।

'ভারতের ব্যারেজ নির্মাণ ঠেকানো সম্ভব না হলেও, আমাদের উচিত ছিল তাদের সমঝোতায় বাধ্য করা যে, তারা পানি ছাড়ার আগে আমাদের জানাবে। কতটুকু পানি ছাড়বে সেই ধারণা দেবে। তাহলে আমরা এক রকম প্রস্তুতি রাখতে পারতাম। পানি কোন দিক দিয়ে যাবে সেটা নির্ধারণ করে জায়গাগুলো খালি রাখা যেত। সেই রুটে অপরিকল্পিতভাবে বাড়ি-ঘর উঠেছে,' বলেন তিনি।

গওহার নঈম আরও বলেন, 'নতুন প্রজন্ম জানে না, বন্যা পরিস্থিতি কেমন হয়। প্রবীণদের দায়িত্ব ছিল তাদের জানানো।'

সারা দেশ থেকে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীদের বন্যা কবলিত এলাকায় পাঠানো প্রয়োজন মন্তব্য করে তিনি বলেন, 'এই বর্ষাকালে আর আগুন লাগবে না। অত্যাবশ্যক সংখ্যক কর্মী রেখে বাকিদের উদ্ধার কার্যক্রমে সম্পৃক্ত করা দরকার। কারণ এই পরিস্থিতি উদ্ধার কার্যক্রম পরিচালনার পেশাদার মানুষ দরকার।'

খাগড়াছড়ির শান্তিপুর এলাকার বন্যার চিত্র | ছবি: ফারহানা আক্তার নাবিলার সৌজন্যে

গওহার নঈম বলেন, 'বন্যা কবলিত এলাকায় বিদ্যুৎ নেই। মোবাইল ফোনগুলো অকেজো হয়ে গেছে। এখন বিশেষ উদ্যোগ নিয়ে মোবাইল কোম্পানিগুলোর উচিত চার্জড মোবাইল ফোন পৌঁছে দেওয়া। চাল-ডাল কবে দেবেন সেটা পরের ব্যাপার।'

অমানবিকতার পরিচয় দিয়েছে ভারত, ব্যারেজ খোলার অভিযোগ অস্বীকার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের

কোনো ধরনের আগাম সতর্কতা ও প্রস্তুতি নেওয়ার সুযোগ না দিয়েই ব্যারেজ খুলে দিয়ে ভারত অমানবিকতার পরিচয় দিয়েছে এবং বাংলাদেশের সঙ্গে অসহযোগিতা করছে বলে মন্তব্য করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের তথ্য উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম।

তিনি বলেন, উজানের পানি বাংলাদেশে ধেয়ে এসে বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে।

আজ বৃহস্পতিবার অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠক শেষে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনার সামনে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ কথা বলেন।

ভারত শিগগির বাংলাদেশের জনগণবিরোধী এ ধরনের নীতি থেকে সরে আসবে বলেও এ সময় প্রত্যাশা করেন।

এদিকে ত্রিপুরার গোমতী নদীর ওপর ভারতীয় ব্যারেজ থেকে পানি ছাড়ার কারণে বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চলের বন্যা পরিস্থিতি তৈরি হয়নি বলে জানিয়েছে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।

এক বিবৃতিতে জানানো হয় 'আমরা দেখেছি, ত্রিপুরার গোমতী নদীর উজানে ডুম্বুর ব্যারেজ খুলে দেওয়ায় পূর্বাঞ্চলীয় জেলাগুলোতে বর্তমান বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে বলে বাংলাদেশ উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। এটি তথ্যগতভাবে সঠিক নয়।'

ভারত ও বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত গোমতী নদীর অববাহিকা এলাকায় গত কয়েক দিনে সবচেয়ে ভারী বৃষ্টিপাত হয়েছে বলে জানিয়েছে ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। তারা আরও জানিয়েছে, বাংলাদেশে বন্যা মূলত বাঁধের ভাটিতে এই বড় অববাহিকা থেকে নামা পানির কারণে।

বিবৃতিতে বলা হয়, ডুম্বুর ব্যারেজটি সীমান্ত থেকে বেশ দূরে—বাংলাদেশ থেকে ১২০ কিলোমিটার উজানে অবস্থিত। এটি একটি কম উচ্চতার (প্রায় ৩০ মিটার) ব্যারেজ, যা বিদ্যুৎ উৎপাদন করে একটি গ্রিডে সরবরাহ করে এবং বাংলাদেশও এখান থেকে ৪০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেনে।

এতে বলা হয়, গত ২১ আগস্ট থেকে পুরো ত্রিপুরা ও বাংলাদেশের আশপাশের জেলাগুলোতে ভারী বৃষ্টিপাত অব্যাহত রয়েছে। প্রচুর মেঘের কারণে স্বাভাবিকভাবে ভারী বর্ষণ হয়েছে।

প্রায় ১২০ কিলোমিটার দীর্ঘ এ নদীর অববাহিকায় তিনটি জায়গায় (অমরপুর, সোনামুড়া ও সোনামুড়া–২) পানি পর্যবেক্ষণ স্টেশন রয়েছে। গতকাল থেকে পুরো ত্রিপুরা এবং বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী জেলাগুলোয় ভারী বৃষ্টি হচ্ছে। এ কারণে পানির চাপে ব্যারেজ থেকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে পানি প্রবাহের ঘটনা দেখা গেছে।

অমরপুর স্টেশনটি একটি দ্বিপাক্ষিক প্রোটোকলের অংশ, যার অধীনে ভারত বাংলাদেশকে বন্যার রিয়েলটাইম তথ্য পাঠিয়েছে।

'গত ২১ আগস্ট দুপুর ৩টা পর্যন্ত পানি বাড়ার তথ্য বাংলাদেশকে সরবরাহ করা হয়েছে। সন্ধ্যা ৬টার দিকে বন্যার কারণে বিদ্যুৎ বিভ্রাট দেখা দেয়, ফলে যোগাযোগে সমস্যা হয়। তারপরও আমরা জরুরি তথ্য পাঠাতে অন্যান্য উপায়ে যোগাযোগ অব্যাহত রাখার চেষ্টা করেছি,' বলা হয় বিবৃতিতে।

এতে আরও উল্লেখ করা হয়, 'ভারত ও বাংলাদেশের অভিন্ন নদীগুলোর তীরবর্তী এলাকায় বন্যা একটি অভিন্ন সমস্যা। উভয় দেশের জনগণের দুর্ভোগের কারণ। এটি সমাধানে পারস্পারিক সহযোগিতা প্রয়োজন। যেহেতু দুই দেশের মধ্যে ৫৪টি আন্তঃসীমান্ত নদী রয়েছে, তাই নদীর পানি সহযোগিতা দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। দ্বিপাক্ষিক পরামর্শ ও কারিগরি আলোচনার মাধ্যমে পানিসম্পদ ও নদীর পানি ব্যবস্থাপনায় সমস্যা ও পারস্পারিক উদ্বেগ সমাধানে আমরা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।'

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে আইনুন নিশাত বলেন, 'আমাদের ক্ষতি করার জন্য তারা ড্যাম খোলেনি। না খুললে ড্যামটা ক্ষতিগ্রস্ত হতো, সেটাকে রক্ষা করার জন্য তারা করেছে। তবে ড্যাম খোলার কারণে আমাদের এখানে প্রভাব পড়েছে এবং খুব স্বাভাবিকভাবেই পড়েছে। ড্যাম খুললে তার প্রভাব ভাটিতে পড়ে।'

যোগাযোগ করা হলে বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী সরদার উদয় রায়হান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'বন্যার ভয়াবহতা সংক্রান্ত সব তথ্য আমরা এখনো পাইনি। এখন পর্যন্ত যা আছে, তা পানির সমতল বৃদ্ধির তথ্য। হবিগঞ্জ পয়েন্টে ২০১৭ সালের পরে এবার পানির সমতল বৃদ্ধি রেকর্ড ছাড়িয়েছে।'

তিনি বলেন, 'ভারতের বেশ কিছু পয়েন্টে পানির সমতল বৃদ্ধি অতীতের অন্তত ৪০ বছরের রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে।'

ত্রিপুরার গোমতী নদীর ওপর ভারতীয় ব্যারেজের জলকপাট খুলে দেওয়া হয়েছে কি না সে রকম কোনো তথ্য নেই জানিয়ে উদয় রায়হান বলেন, 'ভারত কখনোই আমাদের সঙ্গে এ ধরনের তথ্য আদান-প্রদান করে না। আমরা তাদের কাছ থেকে ওয়াটার লেভেল সংক্রান্ত তথ্য পাই।'

হবিগঞ্জের বন্যার চিত্র | ছবি: ওয়াহিদ ইকবালের সৌজন্যে

ভারী বর্ষণের সতর্কবাণী

সক্রিয় মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে ঢাকা, ময়মনসিংহ, খুলনা, বরিশাল, চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের কোথাও কোথাও বৃহস্পতিবার সকাল থেকে পরবর্তী ৪৮ ঘণ্টা ভারী (২৪ ঘণ্টায় ৪৪-৮৮ মিলিমিটার) থেকে অতি ভারী (২৪ ঘণ্টায় ৮৯ মিলিমিটারের বেশি) বর্ষণ হতে পারে।

এছাড়া, বৃষ্টির কারণে চট্টগ্রাম বিভাগের পাহাড়ি এলাকার কোথাও কোথাও ভূমিধসের আশঙ্কা রয়েছে।

আবহাওয়াবিদ মো. তরিফুল নেওয়াজ কবির ডেইলি স্টারকে বলেন, 'গত ১৬ আগস্টের পর থেকে উপকূলীয় এলাকা, খুলনা, বরিশাল, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, ফেনী ও নোয়াখালী এলাকায় বৃষ্টি বাড়তে থাকে। আমরা মনে করছি, আরও দুএকদিন পরিস্থিতি এ রকম থাকতে পারে। তারপর বৃষ্টিপাতের প্রবণতা কমে আসবে এবং বৃষ্টি উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের দিকে চলে আসবে।'

গত ১৭ আগস্ট সকাল (পূর্ববর্তী ২৪ ঘণ্টার তথ্য) থেকে আজ সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত কুমিল্লায় ৭০২ মিলিমিটার ও নোয়াখালীতে ৫০৬ মিলিমিটার বৃষ্টি রেকর্ড করেছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। ২১ আগস্ট দুপুর ১২টা পর্যন্ত ফেনীতে বৃষ্টি হয়েছে ৫৪৪ মিলিমিটার। আবহাওয়া কেন্দ্রের যন্ত্রপাতি পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় এর পরে তথ্য পাওয়া যায়নি।

আজ সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত গত ২৪ ঘণ্টায় কক্সবাজারে সর্বোচ্চ ২৭৫ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে।

Comments

The Daily Star  | English
Bangladeshi-Americans eager to help build new Bangladesh

July uprising and some thoughts of Bangladeshi-Americans

NRBs gathered in New Jersey showed eagerness to assist in the journey of the new Bangladesh forward.

4h ago