‘সংবিধান সংশোধন ছাড়া রাষ্ট্রের কাঙ্ক্ষিত সংস্কার সম্ভব নয়’

এর পাশাপাশি রাজনৈতিক দলগুলোর ভেতর গণতান্ত্রিক চর্চা বাড়ানো ও নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কারের তাগিদও দিয়েছেন আন্দোলনকারী তরুণরা।
আলোচনায় দেশের বিভিন্ন পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা। ছবি: রাশেদ সুমন/স্টার

ছাত্র-জনতার অভূতপূর্ব অভ্যুত্থানের ভেতর দিয়ে নতুন ইতিহাসের সাক্ষী হওয়া বাংলাদেশ রাষ্ট্রের কাঙ্ক্ষিত সংস্কার সংবিধান পরিবর্তন কিংবা সংশোধন ছাড়া সম্ভব নয় বলে অভিমত দিয়েছেন দেশের বিভিন্ন পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলনকারী তরুণরা।

এর পাশাপাশি রাজনৈতিক দলগুলোর ভেতর গণতান্ত্রিক চর্চা বাড়ানো ও নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কারের তাগিদও দিয়েছেন তারা। কথা বলেছেন ধর্মভিত্তিক রাজনীতি ও রাজনৈতিক দলগুলোর কর্মপ্রক্রিয়া এবং এর অভিঘাত নিয়েও।

আজ বুধবার দ্য ডেইলি স্টার সেন্টারে 'ভিশন অব দ্য ইয়ুথ' শিরোনামের  গোলটেবিল আলোচনায় এ কথা বলেন তরুণরা।

আলোচনায় দেশের উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষক ও ছাত্র রাজনীতি থাকা উচিত কি উচিত না—তার পক্ষে-বিপক্ষে এবং জাতীয় নির্বাচন কোন প্রক্রিয়ায় হওয়া উচিত সে বিষয়েও নিজেদের মতামত তুলে ধরেন অংশগ্রহণকারীরা।

এরা হলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মেঘমল্লার বসু, উমামা ফাতেমামোজাম্মেল হক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আরিফ সোহেলপ্রাপ্তি তাপসী, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মাসুদ রানা, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের মুস্তাফিজ রহমান, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবাহ আনজিম ফারাবী এবং ইস্ট-ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের নাজিফা জান্নাত

ডেইলি স্টার আয়োজিত এই গোলটেবিল আলোচনাটি সঞ্চালনা করেন সাংবাদিক সুচিস্মিতা তিথি। উপস্থিত ছিলেন পত্রিকাটির সম্পাদক মাহফুজ আনাম।

আলোচনায় রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয় সংস্কারের জন্য সংবিধান পরিবর্তনের তাগিদ দিয়ে মেঘমল্লার বসু বলেন, 'আমরা একটা রাজনৈতিক জনগোষ্ঠী। আমাদের ভেতর মত আছে, দ্বিমত আছে। নানা বিষয়ে তীব্র দ্বিমত আছে। কিন্তু যেকোনো সভ্য জনগোষ্ঠী এই মত, দ্বিমতগুলোকে রাজনৈতিকভাবে সামনে নিয়ে আসতে পারে। সেগুলোকে ডিল করতে পারে। এর তরিকা কী হবে সেটা নিয়ে কথা হতে পারে। কিন্তু সংবিধান পরিবর্তন করা কিংবা রিফর্মেশন আনা উচ্চাভিলাষী কোনো বিষয় নয়। এটা পলিটিক্যাল নেসেসিটি।'

বিষয়টি ব্যাখ্যা করে মেঘমল্লার বলেন, 'কারণ এই (অন্তবর্তী) সরকার যে সংবিধানের ওপর হাত রেখে শপথ নিল তাতে কিন্তু কোনো অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বিধান ছিল না। কাজেই এই সরকার যত ভালো কাজ করুক, যত সংস্কার করুক—আগামীতে একটা রাজনৈতিক সরকার এসে এই সরকারকে যে বেআইনি ঘোষণা করে দেবে না তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। কাজেই এই অভ্যুত্থানের স্বার্থে, এই অভ্যুত্থানকে সমুন্নত রাখতেই সংবিধান পরিবর্তনের দিকে যেতে হবে।'

বিষয়টির সঙ্গে সহমত পোষণ করে উমামা ফাতেমা। বলেন, 'একটা গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে স্বৈরাচারী শেখ হাসিনাকে হটানো হয়েছে। ওই গণঅভ্যুত্থানের স্পিরিটটাকে আপহোল্ড করতেই আসলে সংবিধানটাকে সংশোধন করা দরকার। নাহলে এই গণঅভ্যুত্থান ভয়াবহভাবে ব্যর্থ হবে। আজ থেকে দুই বছর পর হোক, তিন বছর পর হোক নির্বাচনের মাধ্যমে যখন কোনো গণতান্ত্রিক সরকার আসবে তার পক্ষে এই সংবিধানকে ব্যবহার করে পুনরায় একটা ফ্যাসিস্ট শাসন কায়েম করা খুবই সহজ।'

সংবিধানের পাশাপাশি এখনো টিকে থাকা ঔপনিবেশিক আইনগুলো পরিবর্তনের দাবিও জানান উমামা।

এদিকে নির্বাচনে মনোনয়নপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে পেশীশক্তি, অর্থ ও গণমাধ্যমকে ব্যবহার করার মতো বিষয়গুলো বন্ধ হওয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন মোজাম্মেল হক। পাশাপাশি নির্বাচন ব্যবস্থায় সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করার তাগিদ দেন তিনি।

আরিফ সোহেল কথা বলেন নির্বাচনী কাঠামোতে রাজনৈতিক প্রভাবের প্রসঙ্গে। বলেন, 'আমাদের এখানে নির্বাচন করা হয় অনেকটা রিচুয়ালের (ধর্মীয় ও সামাজিক আচার) মতো করে। এখানেও ঔপনিবেশিক মানস জড়িত। ওই রিচুয়ালকে সার্ভ করার জায়গা থেকে কমিশনকে বেরিয়ে আসতে হবে। কোটি মানুষকে পুরো প্রক্রিয়ার সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে হবে। নাহলে অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা পূরণ হবে না।'

প্রাপ্তি তাপসীর ভাষ্য, নির্বাচন কমিশনে কেবল রাজনীতিকদের প্রভাব থাকে না। ব্যবসায়ীদেরও প্রভাব থাকে। তিনি বলেন, 'ব্যবসায়ীদের প্রভাবমুক্ত একটি স্বাধীন ও স্বচ্ছ নির্বাচন কমিশনের কথা আমরা অনেকদিন আগে থেকেই বলে আসছি। বলে আসছি—ইসিকে হতে হবে স্বাধীন, স্বচ্ছ এবং নিরপেক্ষ। এখন পর্যন্ত আমরা সেটা দেখতে পাইনি।'

এছাড়া নির্বাচন কমিশনারদের মধ্যে যে নারী সদস্য থাকেন তার ভূমিকা অনেকটা 'পাপেটের' মতো হয় বলেও মন্তব্য করেন প্রাপ্তি। তিনি মনে করেন, এ কারণে কমিশন সত্যিকার অর্থে অন্তর্ভূক্তিমূলক হতে পারে না।

মাসুদ রানা রাজনৈতিক দলগুলোর ভেতর গণতান্ত্রিক চর্চা বাড়ানোর তাগিদ দেন। বলেন, 'দলগুলোকে শোধরাতে হবে। প্রশ্নের জায়গা রাখতে হবে। জবাবদিহির জায়গা তৈরি করতে হবে। গত ১৫ বছরে আওয়ামী লীগ তাদের কোনো নেতাকে ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত করেনি। সবই ঘটেছে অগণতান্ত্রিক উপায়ে। তাই তাদের যতখানি সম্ভব গণতান্ত্রিক হতে হবে। জনগণের কাছে নিজেদের গ্রহণযোগ্য করে তুলতে হলে নিজেদের কর্মীদের জবাবদিহির মধ্যে আনতে হবে।'

মুস্তাফিজ রহমান ২০১৪ সালের 'ভোটারবিহীন নির্বাচন', ২০১৮ সালের 'রাতের ভোট' ও চলতি বছরের 'আমি-ডামির' নির্বাচনের প্রসঙ্গ উল্লেখ করেন। ওই ইতিহাস পর্যালোচনা করে অন্তর্বর্তী সরকারের মাধ্যমে যথাযথ পরিবর্তন আনার তাগিদ দেন তিনি।

সাবাহ আনজিম ফারাবীর ভাষ্য, দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোকে পুরো দেশ ও সংবিধানকে তাদের রাজনৈতিক কার্যালয় হিসেবে ব্যবহার করে। এমন জায়গা থেকে সংবিধানে এমন কয়েকটি মূল নীতির জায়গা থাকতে পারে, যে জায়গাগুলো কখনোই গণতান্ত্রিক মনোভাবের বিপরীতে গিয়ে পরিবর্তন করা সম্ভব হবে না। কারণ এই চরিত্রটা বার বার আমাদের দেশে বিভিন্ন পটভূমিতে ফিরে এসেছে।

আর স্বচ্ছতা নিশ্চিতের জন্য নাজিফা জান্নাত নির্বাচন কমিশনের সভাগুলার আলোচ্যসূচি গণবিজ্ঞপ্তি আকারে প্রকাশ করার পক্ষে মত দেন।

এছাড়া ক্যাম্পাসগুলোতে দলীয় শিক্ষক ও ছাত্র রাজনীতি থাকবে কি থাকবে না—সে ব্যাপারে মিশ্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন এই আন্দোলনকারী তরুণরা।  

আলোচনার শুরুতে ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনাম তরুণদের উদ্দেশে বলেন, 'আমরা কখনোই ভাবিনি এই সরকার যাবে। ওই অর্থে তোমরা অসাধ্য সাধন করেছো।'

মাহফুজ আনাম এমন একটি অভ্যুত্থানের ভেতর দিয়ে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য তরুণদের ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানান। বলেন, 'আমরা তোমাদের সহযোগী হিসেবে কাজ করতে চাই। আমরা এই স্বপ্নটাকে এগিয়ে নিতে চাই।'

আলোচনায় বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের কার্যক্রম নিয়েও কথা বলেন ডেইলি স্টার সম্পাদক। বলেন, 'বিচ্যুতির আভাস আসছে। বল প্রয়োগে সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের চেষ্টা চলছে। কিন্তু রাষ্ট্র পরিচালনা ও ভবিষ্যতের জন্য এটা পাল্টাতে হবে।'

সেইসঙ্গে কেউ তরুণদের কর্মপন্থা ও দর্শন নিয়ে সমালোচনা করলে তা গ্রহণ করার মানসিকতা থাকতে হবে মন্তব্য করে মাহফুজ আনাম বলেন, 'আমাদের যে ভিন্নমত নেয়ার অক্ষমতা, তা জাতির বিরাট একটা রোগ। পরমতসহিঞ্চুতা প্রয়োজন। এই দৃষ্টান্তও স্থাপন করতে হবে তোমাদের।'

Comments

The Daily Star  | English

Post-August 5 politics: BNP, Jamaat drifting apart

The taunts and barbs leave little room for doubt that the 33-year-old ties have soured. Since the fall of Sheikh Hasina’s government on August 5, BNP and Jamaat-e-Islami leaders have differed in private and in public on various issues, including reforms and election timeframe.

7h ago