অমনোযোগিতাও হতে পারে খিঁচুনি বা মৃগীরোগের লক্ষণ, জানুন ঝুঁকি ও করণীয়

মৃগীরোগ
ছবি: সংগৃহীত

খিঁচুনি বা মৃগীরোগ মস্তিষ্কজনিত একটি রোগ। এটি হওয়ার পেছনে অনেকগুলো কারণ আছে।

খিঁচুনি বা মৃগীরোগ সম্পর্কে জেনে নিন বাংলাদেশ মেডিকেল কলেজের নিউরোলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. সৈয়দা শাবনাম মালিকের কাছ থেকে।

খিঁচুনি বা মৃগীরোগ কী

ডা. শাবনাম মালিক বলেন, মস্তিষ্কে কিছু নিউরোট্রান্সমিটার বা রাসায়নিক পদার্থ আছে যা মস্তিষ্কের কার্যকারিতা ঠিক রাখতে কাজ করে। যখন কোনো কারণে মস্তিষ্কের রাসায়নিক পদার্থের ভারসাম্য নষ্ট হয় তখন মস্তিষ্কের স্নায়ুকোষের কার্যকলাপ বিঘ্নিত হয়। মস্তিষ্কের কার্যকলাপ অস্বাভাবিক ও অতিরিক্ত বেড়ে যাওয়ার ফলে বিভিন্ন লক্ষণ দেখা দেয়, যা মৃগীরোগ হিসেবে শনাক্ত করা যায়।

হঠাৎ হাত-পা শক্ত হয়ে খিঁচুনি, চোখ উল্টে যাওয়া, জিহ্বা কেটে যাওয়া, এ ছাড়া লেখাপড়া কিংবা বিভিন্ন সময়ে শিশুর মধ্যে অমনোযোগিতার প্রবণতা এরকম বিভিন্ন লক্ষণের মাধ্যমে মৃগীরোগ প্রকাশ পেতে পারে।

মৃগীরোগের লক্ষণ

এক ধরনের মৃগীরোগ আছে যাতে আক্রান্ত ব্যক্তি জ্ঞান হারান না। আক্রান্ত ব্যক্তির জ্ঞান থাকে কিন্তু তার কিছু শারীরিক লক্ষণ প্রকাশের মাধ্যমে বোঝা যায় মৃগীরোগ আছে। যেমন-

১.  হঠাৎ করে মাথা ঘোরা এবং কিছু সময়ের জন্য অমনোযোগী হয়ে যাওয়া।

২.  চোখে লাল নীল আলো দেখতে পাওয়া। হ্যালুসিনেশন হতে পারে।

৩. শরীরের কোনো একটা অংশ হাত বা পা ঝিমঝিম, অবশ অনুভূত হওয়া।

৪. হঠাৎ করে কিছুক্ষণ পরপর হাত বা পা ঝাঁকুনি দিতে পারে কয়েক সেকেন্ড বা কয়েক মিনিটের জন্য। আবার বন্ধ হয়ে যায়।

৫.  শিশুদের মধ্যে বেশি দেখা যায় যে, তারা শ্রেণিকক্ষে খুব অমনোযোগী হয়ে যায় কয়েক সেকেন্ডের জন্য এবং এটা বারবার হতে থাকে। অনেক সময় দেখা যায় দিনের মধ্যে ২০ থেকে ৩০ বার অমনোযোগী হওয়ার লক্ষণ দেখা যায়। কিন্তু শারীরিকভাবে হাত-পা শক্ত হয়ে যাওয়া, খিঁচুনি হয় না। শুধু হঠাৎ অমনোযোগী হয়ে যায়। এটাও শিশুদের মৃগীরোগের লক্ষণ।

আবার কিছু মৃগীরোগে আক্রান্ত ব্যক্তি জ্ঞান হারান, যাদের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। তাদের মধ্যে যেসব লক্ষণ দেখা যায়-

১. রোগী হঠাৎ জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন।

২.  চোখে উল্টে যায়, দাঁতে কামড় পড়ে, জিহ্বা কেটে যায়, মুখ দিয়ে ফেনা বের হয়।

৩. কয়েক মিনিটের জন্য হাত-পা ঝাঁকুনি দেয়। একইসঙ্গে পস্রাব-পায়াখানা হতে পারে।

৪.  আস্তে আস্তে শরীর ছেড়ে দেওয়া বা নমনীয়ভাবে ঢলে পড়ার পর ওই অবস্থায় ২০ থেকে ৩০ মিনিট থাকতে পারেন রোগী। পরে জ্ঞান ফেরার পর ওই সময়ের ঘটনা কিছুই বলতে পারেন না।

অনেকের এই সমস্যাগুলো ঘুমের মধ্যেও হতে পারে।

মৃগীরোগের ঝুঁকি ও করণীয়

ডা. শাবনাম মালিক বলেন, মৃগী রোগ যেকোনো বয়সেই হতে পারে। তবে শিশু এবং বয়স্কদের হওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকে।

১. মৃগীরোগে আক্রান্ত ব্যক্তির যখন খিঁচুনি হয় তখন তিনি তার পারিপার্শ্বিক অবস্থা সম্পর্কে বুঝতে পারেন না। সেজন্য আক্রান্ত ব্যক্তি এবং অন্যান্যদের সবসময় সচেতন থাকতে হবে।

২. আক্রান্ত ব্যক্তি যেন কখনো একা পুকুর কিংবা পানির কাছাকাছি না যান, চুলা কিংবা আগুনের সামনে না যান সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।

৩. রোগী যদি কোনো যন্ত্রাংশ কিংবা কলকারখানায় কাজ করেন সেই কাজ থেকে বিরত থাকতে হবে। অন্য কোনো পেশা বেছে নিতে হবে।

৪. যারা পেশায় গাড়িচালক তাদের ঝুঁকি অনেক বেশি। কারণ গাড়ি চালানো অবস্থায় খিঁচুনি হলে মারাত্মক ক্ষতি হতে পারে।

৫. খিুঁচনির সময় অনেকে হাত-পা টেনে সোজা করার চেষ্টা করেন ঝাঁকুনিরত অবস্থায়। অনেকে রোগীর নাকে জুতা ধরেন, মুখের ভেতর চামচ দেন। এই কাজগুলো অবশ্যই করা যাবে না।

৬. যখন রোগীর খিঁচুনি হবে তখন প্রথম কাজ হবে রোগী যদি বিপজ্জ্নক অবস্থানে থাকেন সেখান থেকে তাকে দ্রুত নিরাপদ স্থানে আনা। খিঁচুনি শেষ হয়ে গেলে রোগীকে বাম পাশ করে শুইয়ে দিতে হবে। কারণ ওই সময় মুখে প্রচুর লালা বা ফেনা হয়। এগুলো জমে যাতে শ্বাস বন্ধ হয়ে না যায়।

৭. মৃগী রোগীদের সঙ্গে অবশ্যই একটি কার্ড রাখতে হবে রোগের বৃত্তান্ত সম্পর্কিত। কারণ যেকোনো সময় যেকোনো স্থানে তারা অসুস্থ হতে পারেন, অনেকের বারবার খিঁচুনি এবং দীর্ঘসময় জ্ঞান থাকে না। সেই অবস্থায় হাসপাতালে নেওয়ার দরকার হতে পারে।

রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসা

ডা. শাবনাম মালিক বলেন, চিকিৎসা না করালে দিনে অনেকবার অসুস্থ হতে পারেন রোগী, আবার অনেকের ক্ষেত্রে দেখা যায় চিকিৎসা নেওয়ার পরেও অসুস্থ হতে পারেন। রোগের লক্ষণ ২ বার বা তার বেশি হলেই চিকিৎসা শুরু করতে হবে।

প্রথমে রোগীকে কাউন্সিলিং করতে হবে অর্থাৎ রোগীকে তার রোগ সর্ম্পকে অবহিত করতে হবে। অনেক সময় সামাজিকভাবে হেয় করা হয় মৃগী রোগীদের, সেজন্য পরিবারের সদস্যদের বিষয়টি বুঝাতে হবে যে চিকিৎসায় রোগটি ভালো হয়। তবে সুস্থ হওয়ার জন্য নিয়মিত ওষুধ খেতে হবে, ওষুধ বাদ দেওয়া যাবে না, কোনো সমস্যা হলে তাৎক্ষণিক চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে ওষুধ নির্ধারণ করতে হবে।

রোগী কী করবেন আর কী করবেন না এই সংক্রান্ত নির্দেশনা মেনে চলতে হবে। মৃগী আক্রান্ত বিবাহিত নারীদের সন্তান নেওয়ার আগে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। সর্বোপরি জীবনধারায় পরিবর্তন আনতে হবে, পর্যাপ্ত ঘুমাতে হবে, অন্ধকারে ল্যাপটপ, মোবাইল ব্যবহার, গেমস, টিভি দেখা যাবে না। কারণ অন্ধকারে এসব যন্ত্রাংশের আলো মস্তিষ্কে উত্তেজনা সৃষ্টি করে, যার ফলে খিঁচুনি হতে পারে।

চা, কফি, অ্যালকোহল পরিহার করতে হবে, নিয়মিত ব্যায়াম, হাঁটার অভ্যাস, ধ্যান করতে হবে মস্তিষ্ক শান্ত রাখতে। মৃগী রোগী যদি আমিষ জাতীয় খাবার বেশি খান তাহলে রোগের লক্ষণ কম প্রকাশ পাবে। রোগের জন্য সামাজিকভাবে একঘরে হয়ে না যান সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।

দ্বিতীয়ত, রোগের লক্ষণ বিশ্লেষণ করে চিকিৎসা করা হয়। ইইজি অর্থাৎ ইলেক্ট্রোএনকেফালোগ্রাম পরীক্ষার মাধ্যমে মৃগীরোগের ধরন চিহ্নিত করা হয়। মস্তিষ্কের সিটিস্ক্যান ও এমআরআইয়ের মাধ্যমে দেখা হয় মস্তিস্কে কোনো সমস্যা আছে কি না।  এরকম কোনো লক্ষণ থাকলে এবং রোগীর অবস্থা অনুযায়ী ওষুধ নির্ধারণ করা হয়।

তৃতীয়ত, সর্বোচ্চ ডোজের ওষুধ দেওয়ার পরেও যদি মৃগী রোগ ভালো না হন, দিনে ৩ থেকে ৪ বার খিঁচুনি হয়, সেক্ষেত্রে রোগীর পরিস্থিতি বিবেচনায় সার্জারি করা যেতে পারে।

Comments

The Daily Star  | English

Yunus returns home completing 4-day Japan tour

A flight of Singapore Airlines, carrying the CA landed at Hazrat Shahjalal International Airport at 12:15am on Sunday

2h ago