পুলিশের প্রতি জনতার কেন এতো ক্ষোভ?
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে পুলিশের যে ভূমিকা আমরা দেখেছি তা কেবল প্রশ্নবিদ্ধই নয়, বরং ন্যাক্কারজনক। আন্দোলনে সম্পৃক্ত শিক্ষার্থী এবং তাদের অভিভাবকদের কাছে পুলিশের অবস্থান কোথায় ঠেকেছে তা বলতে অধিক গবেষণার প্রয়োজন নেই। কেবল শিক্ষার্থী নয়, বরং জনসাধারণের কাছে পুলিশ এখন প্রতিপক্ষ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। এই অঞ্চলে বৃটিশ আমল থেকে পাকিস্তান হয়ে বর্তমান বাংলাদেশেও পুলিশ বহন করে চলছে একই ভাবমূর্তি।
মির্জা নুরুল হুদা, আইয়ুব খানের পতনের পর বাংলার গভর্নর হিসেবে নিয়োগ পেয়েছিলেন যিনি, ছিলেন জিয়া সরকারের অর্থমন্ত্রীও। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগ থেকে অনার্স পাশ করে যখন তিনি সরকারি চাকরির প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন তখন তাঁর মা তাঁকে বলেছিলেন: "বাবা, জীবনে আর যাই হও, আমি মেনে নিবো কিন্তু পুলিশ হবা না" (Baba, whatever you want to be in life is fine with me, but, you must never be a policeman). তিনি চাইলে তখন IPS (Indian Police Service) অফিসার হিসেবে জয়েন করতে পারতেন কিন্তু তাঁর মায়ের এই নির্দেশ ভঙ্গ করেননি। এই ঘটনা ১৯৪০ সালের, আজ থেকে ৮৪ বছর আগে। এই ৮৪ বছরে কি পুলিশের প্রতি গণমানুষের এমন ধারণা পাল্টেছে?
পাল্টানোর তেমন কোনো কারণ ঘটেনি, বরং বেড়েছে। ব্রিটিশ কলোনি থেকে মুক্ত হয়ে পাকিস্তান আমলে যখন মানুষ আজাদির স্বপ্ন নিয়ে শুরু করছেন জীবনযাত্রা তখন ৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ছাত্রদের উপর গুলি চালিয়েছিল পুলিশ। তারপর ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের নায়ক শহীদ আসাদ এবং নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থানের নায়ক শহীদ নূর হোসেনসহ বিভিন্ন গণতান্ত্রিক অধিকার আদায়ের আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে নিহত হওয়ার ঘটনা এখন প্রায় স্বাভাবিক বিষয়ে পরিণত হয়েছে। কিন্তু পুলিশ তো তার উচ্চতর কর্মকর্তার আদেশ ব্যতীত গুলি করে না, তাহলে তাদের দোষ কোথায়?
ব্যাপার হলো, নিরস্ত্র মানুষের উপর গুলির কারণে কেবল পুলিশকেই ঘৃণা করা হয় ব্যাপারটি তা নয়, বরং সরকারের উচ্চতম কর্মকর্তা থেকে শুরু করে গুলি করা পুলিশ পর্যন্ত— পুরো চেইন মানুষ চিহ্নিত করে এবং ঘৃণা করে। যে কারণে ভাষা আন্দোলনে গুলি করা পুলিশের সাথে সাথে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিন এবং মুসলিম লীগ সরকারের প্রতিও গণমানুষের ক্ষোভ প্রকাশ পায়। এভাবেই ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে আসাদকে গুলি করা পুলিশের সাথে সাথে আইয়ুব খান এবং নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থানে নূর হোসেনকে গুলি করা পুলিশের সাথে সাথে এরশাদকেও মানুষ ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছে। আবার চলমান বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনেও গুলি করা পুলিশের সাথে সাথে ক্ষমতাসীন দলের প্রতিও গণমানুষের ক্ষোভ উপচে পড়ছে। ফলে, গুলির প্রতিক্রিয়ায় গণমানুষের ঘৃণার ভাগিদার কেবল পুলিশ একা নয়, বরং সরকার ও প্রশাসনের পুরো চেইন।
আর পুলিশকে কেবল গুলির কারণে মানুষ অপছন্দ করে তাও নয়, বরং বছরজুড়ে গণমানুষের বিভিন্ন হয়রানির সাথেও তারা জড়িত থাকে বিধায় অন্যান্য পেশার চেয়ে পুলিশের প্রতি ক্ষোভটা বেশি। রাজনৈতিক কারণ ছাড়াও, টাকার বিনিময়ে জেল থেকে মুক্তি দেওয়া, অভিযোগ থেকে মুক্তি দেওয়া এবং চার্জশিট থেকে নাম প্রত্যাহারসহ নানাবিধ সমস্যার সমাধান পুলিশ স্রেফ টাকার বিনিময়ে নিমিষেই সমাধান করে দিতে পারেন। এই বিষয়ে বোধহয় পুলিশের জুড়ি নেই।
ফজলুর রহমান বলেছেন, "আগে যেসব দারোগা ঘুষ খেতো এবং মানুষ সে ব্যাপারে জানতে পারতো তাদের সাথে মানুষ আত্মীয়তা করতে চাইতো না, তাদেরকে ঘৃণা করতো।" ঘুষ খাওয়া পুলিশের প্রতি এই ঘৃণাত্মক মনোভাব বহাল আছে; কারণ ঘুষ খাওয়া দারোগারাও আছে বহাল তবিয়তে।
পাসপোর্ট এবং সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে পুলিশ ভ্যারিফিকেশনের সময় দায়িত্বরত পুলিশকে টাকা না দিলে যে পরিমাণ হয়রানির শিকার হতে হয় তা ভুক্তভোগী ছাড়া আর কারো পক্ষে বোঝা সম্ভব নয়। ঘুষের ক্ষেত্রে পুলিশের দুর্নাম রাতারাতি হয়নি; একটা দীর্ঘ সময় নিয়ে আমাদের সমাজে ও প্রশাসনে এই আলাপ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এবং এটি যে নিছক গুজব কিংবা অপপ্রচার নয় তা কিছুদিন পরপরই কিছু পুলিশ সদস্য তাদের অসদুপায় অবলম্বনের মাধ্যমে প্রমাণ করেন, যা আমরা গণমাধ্যম মারফত জানতে পারি। সাবেক আইজিপি বেনজির আহমেদের কীর্তিকলাপ এখনো বেশ তাজা খবর। স্বভাবতই মানুষ ধারণা করে, একজন পুলিশপ্রধান যখন এমন লুটপাট করতে পারে তাহলে তার অধিনস্তরা না জানি কী করে! বদরুদ্দীন উমরের একটি কথা আছে, একটি ডাকাতের দল যখন দলপতি নির্বাচন করে তখন তারা দলের সবচেয়ে বড় ডাকাতকেই সে সম্মান দিয়ে থাকে।
অ্যাডভোকেট ফজলুর রহমান বলেছেন, "আগে যেসব দারোগা ঘুষ খেতো এবং মানুষ সে ব্যাপারে জানতে পারতো তাদের সাথে মানুষ আত্মীয়তা করতে চাইতো না, তাদেরকে ঘৃণা করতো।" ঘুষ খাওয়া পুলিশের প্রতি এই ঘৃণাত্মক মনোভাব বহাল আছে; কারণ ঘুষ খাওয়া দারোগারাও আছে বহাল তবিয়তে। এই ঘুষের সাথে যখন যুক্ত হয় হয়রানি, শারীরিক নির্যাতন ও গুলির ঘটনা তখন ঘৃণার তীব্রতা বাড়তে থাকে। এই ঘৃণা দেখতে পাওয়া যায়, কোনো পুলিশ আহত বা নিহতের খবরের কমেন্টবক্সে; অসংখ্য মানুষ ইন্না লিল্লাহ'র পরিবর্তে আলহামদুলিল্লাহ লিখে তাদের ক্ষোভ প্রশমিত করে। অথচ কথা ছিল, রাষ্ট্রের একজন বেতনভুক্ত কর্মচারী মারা যাওয়ায় নাগরিক স্বেচ্ছায় শোক পালন করবে। যেমনভাবে কথা ছিল পুলিশ হবে জনগণের বন্ধু আর বিপদের সাথী।
বাংলাদেশের টিভি নাটক ও চলচ্চিত্রে পুলিশের যে চিত্রায়ন আমরা দেখি তার মধ্যে অধিকাংশই থাকে নেতিবাচক চরিত্র। বাংলা চলচ্চিত্রে খলনায়ক কিংবা সেমি-খলনায়কের ভূমিকায় পুলিশের উপস্থিতি একসময় ধরাবাঁধা ব্যাপার ছিল। রাজনৈতিক নেতাদের টাকা খেয়ে তাদের হয়ে কাজ করার পুলিশি চরিত্র চলচ্চিত্র ও নাটক উভয় ফরম্যাটেই দেখা যায়। প্রশ্ন হলো, চলচ্চিত্র ও নাটকের এই চিত্রায়ন কি বানোয়াট, ভিত্তিহীন নাকি অন্য সকল চরিত্রের মতোই বাস্তব জীবন থেকে নেওয়া? পুলিশের প্রতি গণমানুষের সামাজিক ক্ষোভের জায়গায় ডিজিটাল মিডিয়ার পুলিশি চিত্রায়ন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।
অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ সুপার ছদ্রেল উলা খান চৌধুরী ১৯৯০ সালে প্রকাশিত 'অতীত কথা কয়' বইতে লিখেছেন, "বৃটিশ আমল থেকে একটা প্রবাদ আছে, পুলিশ ঘুষ খায়, তবে কম বেশী সবাই খেলেও দোষটা পড়তো পুলিশের ঘাড়ে, যত দোষ নন্দ ঘোষ। পুলিশ ঘুষ খায় কেন খায়, কি অবস্থায় খায় কার কাছ থেকে খায়, এ বিষয়ে কেউ তলিয়ে দেখে না। ভাল মানুষের কাছ থেকে পুলিশ কখনও ঘুষ খায় না এবং ভাল মানুষ পুলিশকে ঘুষ দেয়ও না। পুলিশ ঘুষ খায় খারাপ লোকের কাছ থেকে। সমাজের নিকৃষ্ট ব্যক্তিদের কাছ থেকে।" চৌধুরী ঠিকই বলেছেন, ভালো মানুষ পুলিশকে ঘুষ দেয় না, দেওয়ার কারণও নেই। কিন্তু খারাপ, অপরাধীদের কাছ থেকে ঘুষ খেয়ে যে আইনের ব্যত্যয় ঘটিয়ে তাদেরকে সহায়তা করা হয় এবং তাদের পক্ষে কাজ করে অনেক সময় ভিকটিমকে হয়রানি করা হয় তা পরোক্ষভাবেই অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ সুপার জনাব চৌধুরী স্বীকার করেছেন।
সদ্যঘটিত স্বাধীন বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় গণহত্যার মধ্যেও পুলিশের শরিক আমরা দেখেছি। অত্যাচারী এবং অত্যাচারিত— পুলিশ দুভাবেই শরিক হয়েছে। বনশ্রীতে একটি নির্মাণাধীন ভবনে, রডে ঝুলে থেকে প্রাণ বাঁচানোর প্রাণান্তকর চেষ্টারত একটি কিশোরকে লাগাতার কয়েক রাউন্ড গুলি করা পুলিশ যেমন দেখা গেছে, তেমনি পুলিশকে মেরে লাশ ঝুলিয়ে উল্লাসের দৃশ্যও দেখা গেছে। প্রথম ঘটনা থেকেই দ্বিতীয় ঘটনার হাকিকত বোঝা যাবে। সেই অসহায় অবস্থায় কয়েক রাউন্ড গুলিবিদ্ধ কিশোরের কোনো আত্মীয় যদি পরবর্তীতে প্রতিশোধ পরায়ণ হয়ে পুলিশের উপর অনুরূপ হামলার চেষ্টা করে তাহলে তার দায় কে নেবে?
এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, পুলিশের মাঝেও আছে নিষ্ঠাবান ও দায়িত্বশীল ব্যক্তি। কিন্তু অসৎ ও দুর্নীতিবাজদের ভিড়ে তারাও কোণঠাসা হয়ে পড়ে। কোনো দুর্নীতিবাজ এসআইয়ের অধীনে সৎ হাবিলদার বা কনস্টেবল থাকা একপ্রকার অসম্ভব। যে কারণে সৎ পুলিশদের কারণে পুলিশের ব্যাপারে ইতিবাচক ধারণা সমাজে তেমন প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি, যতটা পেরেছে অসৎ ও দুর্নীতিবাজদের কারণে নেতিবাচক প্রভাব বিস্তার করতে।
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে পুলিশের যে ভূমিকা ছিল তা দেখে আন্দোলনের সাথে যুক্ত কোনো ছাত্র কিংবা অভিভাবক কি পুলিশকে শ্রদ্ধা করবে? তারাই তো ভবিষ্যতে দেশের বিভিন্ন পদ অলংকৃত করবে; তাদের মাঝে কিশোরাবস্থায় পুলিশ সম্পর্কে এমন নেতিবাচক মনোভাব ঢুকিয়ে দেওয়ার পরিণতি কী হতে পারে তা আমরা ইতোমধ্যে দেখেছি।
একটি জাতীয় দৈনিকের সূত্রে জানা যায়, পুলিশের সাবেক আইজিপি শহীদুল হক কর্তৃক চালু হওয়া কমপ্লেন সেলে, ২০১৭ সালের ১৩ নভেম্বর থেকে ২০ জুলাই ২০২২ তারিখ পর্যন্ত ৬১ হাজার অভিযোগ এসেছে। এই চার বছরে বিভিন্ন অভিযোগে সারাদেশে প্রায় ৬৫ হাজার পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। গড়ে মাসে এক হাজার ৩৫৫ পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগের বাৎসরিক সংখ্যাটা যদি আমরা দেখি, ২০১৮ সালে ১৪ হাজার ৪০২ ; ২০১৯ সালে ১৪ হাজার ৫১২ ; ২০২০ সালে ১৫ হাজার ২১২ এবং ২০২১ সালে ১৬ হাজার ৪১৮। অর্থাৎ, অভিযোগ এবং অভিযুক্ত পুলিশের সংখ্যা দিনদিনই বাড়ছে।
সকল অভিযোগ সত্য তা নয়, কিন্তু অর্ধেকও যদি সত্য হয় তাহলেও তা ভয়াবহ ব্যাপার। প্রতিটা সত্য ঘটনায় কোনো না কোনো সাধারণ মানুষ নিশ্চয়ই হয়রানির শিকার হয়েছেন। এভাবেই অতীতে যারা হয়রানির শিকার হয়েছেন এবং বর্তমানে হচ্ছেন তাদের কেউ কি পুলিশকে 'বন্ধু/সেবক' হিসেবে গ্রহণ করতে পারবেন? তাদের পরিবারের কোনো সচেতন ব্যক্তি কি পারবে? পুলিশের বিতর্কিত কর্মকাণ্ড, দুর্নীতির খতিয়ান এবং হয়রানির অভ্যাস যত বাড়ছে দেশের জনসাধারণের কাছে সামাজিক ও প্রশাসনিকভাবে পুলিশের অবস্থান ততই খর্ব হচ্ছে।
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে পুলিশের যে ভূমিকা ছিল তা দেখে আন্দোলনের সাথে যুক্ত কোনো ছাত্র কিংবা অভিভাবক কি পুলিশকে শ্রদ্ধা করবে? তারাই তো ভবিষ্যতে দেশের বিভিন্ন পদ অলংকৃত করবে; তাদের মাঝে কিশোরাবস্থায় পুলিশ সম্পর্কে এমন নেতিবাচক মনোভাব ঢুকিয়ে দেওয়ার পরিণতি কী হতে পারে তা আমরা ইতোমধ্যে দেখেছি।
শেখ হাসিনার পতনের পর, পুলিশ তাদের ৯ দফা দাবি ঘোষণা করে কর্মবিরতিতে গিয়েছিল। তারা নিজেরাই নিজেদের ঘৃণিত কর্মকাণ্ড নিয়ে স্বীকারোক্তি দিয়েছে। রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তির কারণে সাধারণ মানুষের উপর জুলুম করতে রাজি নয়। তারাও সংস্কার চায়। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা ইতোমধ্যে পুলিশের লোগো এবং পোশাক পরিবর্তনের কথা বলেছেন। পুলিশ ছাড়া দেশ পরিচালনা সম্ভব নয়, এটা যেমন সত্য তেমনি সত্য হলো, আগের মতো লেজুড়বৃত্তির পুলিশ দিয়েও আর দেশ পরিচালনা সম্ভব নয়। পুলিশকে সংস্কার করার মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তি থেকে মুক্ত করাই হবে আগামী দিনের চ্যালেঞ্জ।
ব্যবহৃত গ্রন্থাবলি:
১. My seven decades' journey through British India, Pakistan and Bangladesh : Mirza Nurul Huda, Upl, 2021
২. অতীত কথা কয় : এস ইউ খান চৌধুরী, ঢাকা, ১৯৯২
Comments