‘সাংবিধানিকভাবে শেখ হাসিনা এখনো প্রধানমন্ত্রী—এ দাবি সম্পূর্ণ অমূলক ও ভিত্তিহীন’

শেখ হাসিনার পদত্যাগের দাবিতে রাজপথে নেমে আসেন লাথো মানুষ। ৫ আগস্ট ২০২৪। ছবি: আনিসুর রহমান/স্টার

'শেখ হাসিনা পদত্যাগ করেননি' এবং 'সংবিধান অনুযায়ী তিনি এখনো বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী' বলে দাবি করেছেন তার ছেলে ও উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়। তবে, তার এই দাবি সম্পূর্ণ অমূলক এবং ভিত্তিহীন বলে মনে করছেন সংবিধান বিশেষজ্ঞরা।

রয়টার্সকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে জয়ের এমন দাবির বিষয়ে জানতে দ্য ডেইলি স্টার কথা বলেছে সংবিধান বিশেষজ্ঞ আরিফ খানের সঙ্গে।

'শেখ হাসিনা পদত্যাগ করেননি'—এই দাবি প্রসঙ্গে আরিফ খান বলেন, 'বর্তমান সংবিধান অনুযায়ী দুটি ক্ষেত্র ছাড়া বাকি সব বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির আলাপ-আলোচনা গোপনীয়তার মধ্যে হয়। কাজেই তারা গোপনীয়তা রক্ষা করে কী আলোচনা করেছেন, তা তারাই জানেন। তাদের মধ্যে একজন যখন বলেছেন যে প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করেছেন, তখন সেটাই গ্রহণযোগ্য ও চূড়ান্ত।'

'কাজেই সাংবিধানিকভাবে শেখ হাসিনা এখনো প্রধানমন্ত্রী আছেন—এটা মোটেই যুক্তিযুক্ত কথা নয় এবং পুরোপুরি ভিত্তিহীন ও অমূলক দাবি। এটা আর আলোচনারই বিষয় নেই,' যোগ করেন তিনি।

আরিফ খান বলেন, 'গণঅভ্যুত্থান বা যুদ্ধ মুহূর্তে পদত্যাগের অর্থ রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন চ্যানেলে ঘোষণা দিয়ে পদত্যাগ করা না। সংবিধানেও বলা নেই যে ঘোষণা দিয়ে পদত্যাগ করতে হবে।'

তিনি বলেন, 'প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগের সিদ্ধান্ত জানাবেন বা পদত্যাগপত্র জমা দেবেন রাষ্ট্রপতির কাছে। রাষ্ট্রপতি যখন বলেছেন যে প্রধানমন্ত্রী তার কাছে পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন, তখন তার পদত্যাগের প্রমাণ হিসেবে এই ঘোষণাই যথেষ্ট ও চূড়ান্ত। সেখানে কোনো লিখিত পত্র দেওয়া হয়েছে কি না সেটাও দেখার প্রয়োজন নেই।'

পরিবর্তীতে পরিস্থিতিতে যা হচ্ছে বা হয় তা সাংবিধানিক কাঠামোর মধ্যে থেকে হবে কিন্তু সংবিধানের মধ্যে থেকে করতে হবে তা অপরিহার্য না উল্লেখ করে আরিফ খান বলেন, 'সংবিধানে বলা না থাকলেও উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সেনাপ্রধান এক ধরনের কর্তৃত্ব নিয়েছেন, রাষ্ট্রপতি ও ছাত্ররা এক ধরনের কর্তৃত্ব নিয়েছেন। এই তিন কর্তৃত্ব নিয়ে এক ধরনের কাঠামো তৈরি হয়েছে। সংসদ ভেঙে দেওয়া হয়েছে রাষ্ট্রপতির আদেশে। কিন্তু বর্তমান সংবিধানে এমন কোনো বিধি নেই। কিন্তু, উদ্ভূত পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রপতি এটা করতে পরেন, যা সাংবিধানিক কাঠামোর মধ্যেই রয়েছে।'

এই সংবিধান বিশেষজ্ঞ বলেন, 'শেখ হাসিনা সরকারের আমলে পরিবর্তন-পরিবর্ধন করার পরে যে সংবিধান বর্তমানে রয়েছে সে অনুযায়ী, প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করলে মাত্র দুটি ফলাফল আসতে পারে। একটি হচ্ছে, প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগের বিষয়টি জানালে রাষ্ট্রপতি তাকে ছাড়া সংসদের অন্য কোনো যোগ্য ব্যক্তিকে প্রধানমন্ত্রী বানাবেন। অপরটি হচ্ছে, যোগ্য কাউকে না পাওয়া গেলে পদত্যাগী প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রপতিকে সংসদ ভেঙে দিয়ে নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে বলবেন এবং ওইদিন থেকে পরবর্তী তিন মাসের মধ্যে নির্বাচন হবে। এই তিন মাস পদত্যাগী প্রধানমন্ত্রী ও তার মন্ত্রীসভা দায়িত্বে বহাল থাকবে এবং কেবল রুটিন দায়িত্ব পালন করবে নির্বাচন পর্যন্ত।'

তিনি বলেন, 'এটা স্বাভাবিক সময়ের জন্য—যা নিয়ে কোনো দ্বিধা নেই। কিন্তু বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপট তো স্বাভাবিক নেই, এখানে একটি সফল গণঅভ্যুত্থান হয়ে গেছে।'

তিনি আরও বলেন, 'পৃথিবীর কোনো সংবিধান লেখার সময় এটা কল্পনা করা হয় না যে ওই দেশের প্রধানমন্ত্রী তার দেশের সাধারণ মানুষকে গণহত্যা করবে কিংবা গণহত্যা করে দেশকে একটি সংকটে ফেলে পালিয়ে যাবে কিংবা পালিয়ে অন্য কোনো দেশে রাজনৈতিক আশ্রয় নেবে। এগুলো বিবেচনায় সংবিধান লেখার নিয়মও নেই। কিন্তু বাংলাদেশের বাস্তবতায় এই তিন ধরনের ঘটনাই ঘটেছে। ফলে বাংলাদেশের সংবিধান এর সমাধান দিতে পারছে না এবং নতুন কিছু করতে হচ্ছে।'

'দেশের পুরো ক্ষমতা বিপ্লবী জনতার কাছে চলে গেলে ওই মুহূর্তে কোনো সরকার থাকে না। কিন্তু প্রশাসনিক শৃঙ্খলা আনার জন্য প্রধানমন্ত্রী পালিয়ে যাওয়ার পরপরই যারা দৃশ্যত ক্ষমতাবান থাকেন বা সার্বিক পরিস্থিতি যাদের নিয়ন্ত্রণে থাকে, তারাই ক্ষমতায় আছে বলে ধরে নেওয়া হয়,' যোগ করেন তিনি।

সজীব ওয়াজেদ জয় দাবি করেছেন, 'প্রধানমন্ত্রী আনুষ্ঠানিকভাবে পদত্যাগ না করায় তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনকে আদালতে চ্যালেঞ্জ করা যেতে পারে।'

এই দাবির বিষয়ে আরিফ খান বলেন, 'এটা নিয়ে আদালতে যাওয়ার সুযোগ আছে, কারণ পৃথিবীতে সুযোগের দরজা সবসময় খোলা। সভ্যতার নিয়ম হচ্ছে, পৃথিবীর সবচেয়ে ভালো জিনিসটা নিয়েও আদালতে যাওয়া যাবে। কিন্তু, প্রশ্ন হচ্ছে, এটার বৈধতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করা যাবে কি না।'

তিনি মনে করেন, 'এর বৈধতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করা যাবে না। একটি বিপ্লব বা গণঅভ্যুত্থানের পর একটি কার্যত সরকার বা ডিফেক্টো সরকার প্রয়োজন হয়। কারণ, গণঅভ্যুত্থান মানেই নৈরাজ্যের শুরু। এই নৈরাজ্য নিয়ন্ত্রণের জন্য একটি সরকার লাগবে। এই সরকারের বৈধতা কোথাও চ্যালেঞ্জ করা যায় না এবং চ্যালেঞ্জ করলেও সেটা বাতিল করা হয়।'

আরিফ খান বলেন, 'গণঅভ্যুত্থান সফল হওয়ার পরে খুবই গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে সংসদ ভেঙে দেওয়া এবং একজনকে প্রধান উপদেষ্টা করে তার নেতৃত্বে একটি সরকার গঠন করা। যদিও বাংলাদেশের বর্তমান সংবিধানের কোথাও এর কোনো উল্লেখ নেই।'

'৯০ এর গণঅভ্যুত্থানের সঙ্গে তুলনা করে তিনি বলেন, 'সরকার গঠন ও ক্ষমতাচর্চার দিক থেকে '৯০ এর গণঅভ্যুত্থানের সঙ্গে ৫ আগস্টের গণঅভ্যুত্থানের প্রায় ৯০ শতাংশ মিল আছে। সেই সময়েও অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনসহ যা যা করা হয়েছিল তার কোনোটিই তৎকালীন সংবিধানে ছিল না। পরবর্তীতে দ্বাদশ সংশোধনের মাধ্যমে এসব কর্মকাণ্ডকে বৈধতা দেওয়া হয়।'

এসব ঘটনাকে আজ পর্যন্ত কেউ আদালতে চ্যালেঞ্জ করেননি উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'পরবর্তীতে বর্তমান সময়ের এই সার্বিক কার্যক্রমেরও সাংবিধানিক ও আইনি বৈধতা দিতে হবে।'

Comments

The Daily Star  | English
caretaker government proposal Bangladesh

Restoration of caretaker system to be proposed

The restoration of the caretaker government and the introduction of a bicameral system in parliament will be among the recommendations to be proposed by the Constitution Reform Commission.

5h ago