রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস কেন হয়, লক্ষণ ও চিকিৎসা কী

রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস
ছবি: সংগৃহীত

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী পৃথিবীতে প্রায় ৬৯৪ রকমের বাত হতে পারে। এর মধ্যে একটি হচ্ছে রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস।

রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস সম্পর্কে জেনে নিন এনাম মেডিকেল কলেজ অ্যান্ড হসপিটালের রিউমাটোলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক এবং বিআরবি হসপিটালস লিমিটেডের রিউমাটোলজি অ্যান্ড মেডিসিন কনসালটেন্ট ডা. হাবিব ইমতিয়াজ আহমদের কাছ থেকে।

রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস কী ও কেন হয়

ডা. হাবিব ইমতিয়াজ বলেন, রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস এক ধরনের বাত রোগ। শরীরের ছোট ছোট অস্থি সন্ধিগুলোতে বেশি আক্রান্ত করে বিধায় রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিসকে গিট বাত বলা হয়ে থাকে।

রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস অটোইমিউন ডিজিজ। অটোইমিউন ডিজিজের কারণে শরীরের ইমিউনিটি যখন শরীরের বিরুদ্ধে, বিশেষ করে যখন অস্থি সন্ধিগুলোর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে তখন এই ধরনের বাতরোগ হয়ে থাকে। রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস হওয়ার জন্য নির্দিষ্টভাবে কোনো কারণকে এককভাবে দায়ী করা যায় না।

তবে বংশগত বা জেনেটিক কারণে রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস হতে পারে বলে মনে করা হয়ে থাকে। বিশেষ কিছু সংক্রমণের কারণে, ধূমপান, পরিবেশগত কারণেও হতে পারে। এই সমস্ত কারণ যখন একসঙ্গে কাজ করে তখন এই রোগের প্রার্দুভাব দেখা দেয়।

২০ বছর বয়সের দিকে কেউ কেউ রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিসে আক্রান্ত হতে পারেন। তবে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হন ষাটোর্ধ্বরা। পুরুষের তুলনায় নারীদের মধ্যে রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিসে আক্রান্তের হার বেশি।

লক্ষণ

১. বাত বলতে বোঝায় জয়েন্টে বা অস্থিসন্ধির সমস্যা, জয়েন্টে ব্যথা, ফুলে যাওয়া, অস্থিসন্ধি ভাঁজ করতে না পারা। রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিসে সাধারণত হাত ও পায়ের ছোট ছোট জয়েন্ট বা অস্থিসন্ধিগুলো বেশি আক্রান্ত হয়। শরীরের ছোট ছোট অস্থিসন্ধিগুলোতে ব্যথা হয়, গিড়া ফুলে যায়।

২. ঘুম থেকে উঠার পর সকাল বেলায় রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিসের রোগীরা বেশি ব্যথা অনুভব করেন।

৩.  হাতগুলো ভাঁজ করতে না পারা, সকালে বা কোনো একটা সময়ে অস্থিসন্ধিগুলো আড়ষ্ট হয়ে আসা এবং এই আড়ষ্টতা ৩০ মিনিটের বেশি সময় থাকা।

৪.  ঘাড়, কনুই, হাঁটু, গোড়ালি সব ধরনের অস্থিসন্ধি আক্রান্ত হতে পারে রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিসে।

৫. রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিসে অস্থিসন্ধি ছাড়াও চোখ, ত্বক, ফুসফুস, হার্ট, কিডনির মত গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গপ্রতঙ্গ আক্রান্ত হতে পারে।

ডা. হাবিব ইমতিয়াজ বলেন, এই ধরনের উপসর্গ যদি কারো ৬ সপ্তাহের বেশি থাকে তখন তার রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস থাকতে পারে বলে সন্দেহ করা হয়। পরে রক্ত পরীক্ষা ও বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে রোগ নির্ণয় করা হয়।

ঝুঁকি

১. পরিবারে যদি কারো রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিসের ইতিহাস থাকে তাদের রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস হওয়ার ঝুঁকি অন্যান্যদের তুলনায় কিছুটা বেশি। এটি ছাড়া কারা রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিসে আক্রান্ত হবেন সেটি বলা মুশকিল।

২. রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিসে আক্রান্ত হওয়ার পর সঠিকভাবে চিকিৎসা না নিলে অস্থিসন্ধি, আঙ্গুলগুলো বেঁকে যেতে পারে। অস্থিসন্ধি ও আঙ্গুলের যে স্বাভাবিক ক্রিয়াকলাপ সেটি ব্যাহত হয়।

৩.  ফুসফুসে রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস হলে ফুসফুস শুকিয়ে যেতে পারে, দুরারোগ্য ব্যাধি ডিপিএলডি বা ডিফিউজ প্যারেনকাউমাল লাং ডিজিজে আক্রান্ত হতে পারেন যদি বাত ফুসফুসে ছড়িয়ে যায়।

৪. দীর্ঘমেয়াদী বাত থাকার কারণে বিশেষ কিছু ক্যানসারের ঝুঁকি বেড়ে যায়। লিম্ফোমা ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়ায় রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস।

৫.  হাড় ক্ষয় রোগ বেড়ে যেতে পারে।

৬. পায়ের স্নায়ুগুলো শুকিয়ে যেতে পারে।

৭. রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস থাকার কারণে উচ্চরক্তচাপ, হৃদরোগ, স্ট্রোকের ঝুঁকি বেড়ে যেতে পারে, ওজন কমে যেতে পারে।

চিকিৎসা

ডা. হাবিব ইমতিয়াজ বলেন, রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিসের ক্ষেত্রে নন ফার্মাকোলজিক্যাল ও ফার্মাকোলজিক্যাল এই দুইভাবে চিকিৎসা দেওয়া হয়।

নন ফার্মাকোলজিক্যাল বা ওষুধ ছাড়া চিকিৎসা

রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিসে আক্রান্ত রোগীকে রোগ সর্ম্পকে ধারণা দেওয়া হয়। এই রোগটি নিরাময়যোগ্য নয়, তবে নিয়ন্ত্রণযোগ্য। জীবনযাপন পদ্ধতিতে পরিবর্তন আনা, ওজন বেশি থাকলে ওজন কমানো, ধূমপান না করা, ধূমপানের অভ্যাস থাকলে তা পরিহার করা এই বিষয়গুলো মেনে চলার পরামর্শ দেওয়া হয় রোগীকে। এর পাশাপাশি কিছু বিশেষ টিকা যেমন- নিউমোনিয়া, ইনফ্লুয়েঞ্জার টিকা নিতে বলা হয়। যদি রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস কমে যায় সেক্ষেত্রে থেরাপি নেওয়া এবং কখন চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে, কখন ফলোআপে আসতে হবে সেই বিষয়ে নির্দেশনা দেওয়া হয় রোগীকে।

ফার্মাকোলজিক্যাল বা ওষুধসহ চিকিৎসা

ফার্মাকোলজিক্যাল ব্যবস্থাপনার মধ্যে ওষুধ ২ ভাগে ভাগ করা হয়। একটি হচ্ছে ব্যথানাশক ওষুধ, যেটি সামান্য সময়ের জন্য দেওয়া হয় রোগীকে। অপরটি হচ্ছে বাত নিয়ন্ত্রণকারী ওষুধ, যা দীর্ঘদিন, এমনকি সারাজীবন সেবন করতে হতে পারে। রোগী যাতে নিয়মিত ওষুধ সেবন করেন এবং চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে প্রয়োজন অনুযায়ী ওষুধের ডোজ কমানো অথবা বাড়ানো হয় সেটি নিশ্চিত করার কথা বলেন ডা. হাবিব ইমতিয়াজ।

৩ থেকে ৪ ধরনের বাত নিয়ন্ত্রণকারী ওষুধ আছে, এর মধ্যে কিছু কিছু ওষুধ মুখে খাওয়ার আবার কিছু ওষুধ ইনজেকশনের মাধ্যমে শরীরে প্রবেশ করানো হয়। এভাবে ব্যথা কমানোর মাধ্যমে রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা হয়।

রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিসে সন্তান ধারণে সমস্যা হয় কি না

রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিসের কারণে নারীদের সন্তান ধারণে কোনো সমস্যা হয় কি না এমন প্রশ্নে ডা. হাবিব ইমতিয়াজ বলেন, রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিসের জন্য কোনো নারী মা হতে পারবেন না বিষয়টি তা নয়। রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিসের কারণে গর্ভধারণে কোনো সমস্যা নেই। তবে দেখা যায় এমন কিছু ওষুধের মাধ্যমে রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস নিয়ন্ত্রণ করতে হয়, যা গর্ভাবস্থায় যদি কেউ চালিয়ে যায় সেটি ওই অন্তঃসত্ত্বা নারী এবং অনাগত সন্তানের জন্য বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরি করতে পারে। সেজন্য কনসিভ করার আগে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে, রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস আছে কি না সেটি জানাতে হবে। সেক্ষেত্রে প্রয়োজন অনুযায়ী ওষুধ পরিবর্তন করে যে ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কম এবং গর্ভাবস্থায় নিরাপদ সেই ওষুধ দেওয়া হয় রোগীকে।

রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিসে আক্রান্ত এক তৃতীয়াংশ রোগীর গর্ভধারণ করার পর রোগের তীব্রতা কমে যায়। সেক্ষেত্রে তাদের ওষুধ নাও লাগতে পারে, আর ওষুধ দিলেও তা কম ডোজের এবং কিছু দিনের জন্য দেওয়া হয়। কিছু কিছু রোগীর তীব্রতা একই রকম থাকে, আবার কিছু রোগীর তীব্রতা অনেক বেড়ে যায়। গর্ভাবস্থায় রোগের তীব্রতা বেশি হলে মা ও সন্তানের জন্য নিরাপদ এমন ওষুধ বেছে নেওয়া হয়। তবে কার ক্ষেত্রে কোনটা হবে সেটি আগে থেকে অনুমান করা কঠিন।

 

 

Comments

The Daily Star  | English
India visa restrictions for Bangladeshi patients

A wake-up call for Bangladesh to reform its healthcare

India’s visa restrictions on Bangladeshi nationals, while initially perceived as a barrier, could serve as a wake-up call for Bangladesh to strengthen its healthcare system and regain the confidence of its patients.

12h ago