'সরকারের কথার সঙ্গে কাজের কোনো মিল নেই'

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের তিন সমন্বয়ক আসিফ মাহমুদ, নাহিদ ইসলাম ও আবু বাকের মজুমদারকে শুক্রবার বিকেলে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থা থেকে তুলে নেওয়ার পর রাতে গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) পক্ষ থেকে জানানো হয় 'নিরাপত্তাজনিত কারণে' তাদের হেফাজতে নেওয়া হয়েছে।

এ ব্যাপারে ডিবির অতিরিক্ত উপকমিশনার জুনায়েদ আলম সরকার দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, নিরাপত্তার স্বার্থে তিন সমন্বয়ককে ডিবি হেফাজতে নিয়ে আসা হয়েছে। সেখানে তাদের গত দুইদিনে ঘটে যাওয়া ঘটনা সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে বলেও জানান তিনি।

এমন পরিস্থিতিতে প্রশ্ন ওঠে—হাসপাতালে চিকিৎসাধীন কাউকে ডিবি এভাবে তুলে নিয়ে যেতে পারে কি না? এ ব্যাপারে বাংলাদেশের সংবিধানেই বা কী বলা হয়েছে?

বিষয়টি নিয়ে ডেইলি স্টার কথা বলেছে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শাহদীন মালিক, বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান এবং সংবিধান বিশেষজ্ঞ আরিফ খানের সঙ্গে।

এ ব্যাপারে শাহদীন মালিকের ভাষ্য, 'যে শিক্ষার্থীদের তুলে নেওয়া হয়েছে তারা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে বলে কারও কাছে অভিযোগ করেছে কিংবা সাহায্য চেয়েছে—এ ধরনের কোনো খবর তো আমাদের কাছে নাই। অবশ্যই চিকিৎসাধীন কাউকে এভাবে ধরে নিয়ে যাওয়ার বিষয়টি পরিষ্কারভাবে মধ্যযুগে ফিরে যাওয়ার মতো ঘটনা। জমিদারি আমলে জমিদারের লাঠিয়ালরা এসব করত। দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমরা সেই যুগেই ফিরে গিয়েছি বলে মনে হচ্ছে।'

পুলিশ পরিচয়ে তুলে নেওয়ার পর কোটা আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক নাহিদ ইসলামের ওপর নির্যাতন চালানো হয়। ছবি: স্টার

পাশাপাশি আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে একের পর এক মামলা দায়ের ও ঢালাও গ্রেপ্তার প্রসঙ্গে এই জ্যেষ্ঠ আইনজীবী বলেন, 'আমরা তো একটা অগণতান্ত্রিক ও কর্তৃত্ববাদী ব্যবস্থার ভেতর আছি। এখানে এটাই স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া।'

ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিকের আইন বিভাগের এ শিক্ষক আরও বলেন, 'এ ধরনের ব্যবস্থায় যারা ক্ষমতায় থাকে তারা সবসময় মানুষকে দমন-পীড়নের মাধ্যমে দমিয়ে রাখতে চায়। তাই এটা এখানে নতুন কিছু না। অগণতান্ত্রিক কর্তৃত্ববাদী রাস্ট্রের চরিত্র এমনই। এমন অন্যান্য দেশেও সরকার সাধারণত এমনটাই করে থাকে এবং নিপীড়নের আশ্রয় নেয়। এর অংশ হিসেবেই তারা ইন্টারনেট ও সোশ্যাল মিডিয়া শাটডাউনের মতো ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে।'

আসিফ মাহমুদ, নাহিদ ইসলাম ও আবু বাকের মজুমদারকে এর আগেও একবার তুলে নেওয়া হয়েছিল। কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীরা দাবি আদায়ে সারা দেশে 'কমপ্লিট শাটডাউন' বা সর্বাত্মক অবরোধ কর্মসূচি দেওয়ার পর ১৯ জুলাই মধ্যরাতে খিলগাঁওয়ের নন্দীপাড়া থেকে নাহিদকে তুলে নেওয়া হয়। ২১ জুলাই ভোরে পূর্বাচল এলাকায় তাকে ফেলে যাওয়া হয়। নাহিদের শরীরের বিভিন্ন স্থানে ছিল আঘাতের চিহ্ন। এর পর থেকে তিনি গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। অপর দুই সমন্বয়ক আসিফ ও বাকেরকেও ১৯ জুলাই তুলে নেওয়া হয়েছিল। পাঁচ দিন পর ২৪ জুলাই আসিফকে হাতিরঝিল ও বাকেরকে ধানমন্ডি এলাকায় ফেলে যাওয়া হয়। এর পর থেকে আসিফও গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। হাসপাতালে তার সঙ্গে থাকছিলেন বাকের।

শুক্রবার তিনজনকে তুলে নেওয়ার খবর জানাজানি হলে গণমাধ্যমকর্মীরা বিকেল সাড়ে পাঁচটার দিকে গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালে যান। নাহিদ হাসপাতালের ৭০৩ নম্বর কক্ষে এবং আসিফ ৩১১ নম্বর কক্ষে ভর্তি ছিলেন। নাহিদের সঙ্গে তাঁর স্ত্রী আর আসিফের সঙ্গে বাকের ছিলেন।

হাসপাতালে উপস্থিত নাহিদের স্বজনেরা জানান, বেলা সাড়ে তিনটার দিকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য পরিচয় দিয়ে একদল লোক এসে প্রথমে নাহিদকে তুলে নিয়ে যান। পরে আসিফ ও বাকেরকে নিয়ে যান।

বিষয়টি নিয়ে সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, 'প্রথম কথা হচ্ছে তারা তো আন্ডার অ্যারেস্ট না। তাদের বিরুদ্ধে কোনো অ্যারেস্ট ওয়ারেন্ট নেই। এখন ডিবি যে কাকে নিরাপত্তা দেয় আর কাকে দেয় না এটাই তো বুঝতে পারছি না। হাসপাতালে কি ওরা অনিরাপদ ছিল? তেমন হলে হাসপাতালেই নিরাপত্তা বাড়ানোর দরকার ছিল। কারণ ছেলেগুলো অসুস্থ। একজনের অভিযোগ তাকে বার বার করে অজ্ঞান করে ফেলা হয়েছে। আরেকজনের গায়ে তো আমরা ক্ষতচিহ্ন দেখেছি।'

এই অধিকারকর্মী আরও বলেন, 'ডিবি কাউকে এভাবে তুলে নিতে পারে কি না সেটা একটা বড় প্রশ্ন। চোখের সামনে যা ইচ্ছা তাই করা হচ্ছে। এটা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য না। ডিবির যদি ওদের বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকে তাহলে ডিবি অভিযোগের প্রেক্ষিতে জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারে। সেটা তো হাসপাতালে রেখেই করা সম্ভব। ডিবির কাছে যদি অ্যারেস্ট ওয়ারেন্ট থাকে তাহলে ডিবি অ্যারেস্ট করতে পারে। আর যখন কেউ অসুস্থ থাকে সেই অসুস্থ অ্যারেস্টিকেও তো আমরা হাসপাতালে রাখি।'

এই পর্যায়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উদ্দেশে রিজওয়ানা বলেন, 'আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে আইনানুগ হতে হবে। এর পাশাপাশি সংবেদনশীলতাও দেখাতে হবে। জাতির এই সাংঘাতিক সংকটময় সময়ে যা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। যেখানে গোটা দেশ মন খারাপ করে আছে সেখানে এখন তো ক্ষমতা দেখানোর কোনো বিষয় থাকতে পারে না। এখন সংবেদনশীলতা দেখানো ও আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকার সময়।'

আর শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের প্রসঙ্গে এই আইনজীবীর বক্তব্য, 'ছাত্রসমাজ তো বিক্ষুব্ধ আছে। আপাতত হয়তো নানান রকমের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তোপের মুখে তারা সংঘটিত নেই, ছড়িয়ে গেছে। এটা সমাজকেও বিক্ষুব্ধ করেছে। কেবল ছাত্রদের বিক্ষুব্ধ করেছে তা না।

'এখন গণহারে মামলা দেওয়া হচ্ছে। আবার সরকারের পক্ষ থেকে এটাও বলা হচ্ছে যে যারা সহিংসতা করেছে জনগণ যেন তাদের চিনিয়ে দেয়। তাহলে সরকার কিসের ভিত্তিতে এই মামলাগুলো দিচ্ছে? আমরা যেমন একটা সাঁজোয়া যানের ভেতর থেকে একটা বডি ফেলে দিতে দেখলাম। পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জ থেকে গুলি করতে দেখলাম। সেখানে যদি গ্রেপ্তার হতো, বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হতো তাহলে হয়তো জনমনে স্বস্তি আসত। কিন্তু ছাত্রদের বিরুদ্ধে মামলা দিয়ে কখনো পরিস্থিতি পুরোপুরি সামলানো গিয়েছে, সেটা আমার জানা নেই। ইতিহাস অন্তত তা বলে না।'

শিক্ষার্থীদের এভাবে গ্রেপ্তার ও নির্যাতনের ফলাফল কোনোভাবেই ভালো হবে না মন্তব্য করে তিনি বলেন, 'আপনি (সরকার) আইনানুগ হওয়ার চেষ্টা করছেন না, সংবেদনশীল হওয়ার চেষ্টা করছেন না। আপনি যাকে প্রতিপক্ষ মনে করছেন তার ওপর যদি আপনি আপনার চূড়ান্ত বল প্রয়োগ করে ফেলেন তাহলে তো আপনি উত্তেজনা স্তিমিত করলেন না, বরং তা আরও বাড়িয়ে দিলেন। এতে যারা গ্রেপ্তারের বাইরে আছে তারা আরও বেশি ক্ষুব্ধ হয়ে যাচ্ছে। সরকারের কথার সঙ্গে এখনো কাজের কোনো মিল নেই।'

তিন সমন্বয়ককে তুলে নেওয়ার বিষয়টি আইন ও সংবিধানের আলোকে ব্যাখ্যা করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ আরিফ খান। তিনি বলেন, 'প্রথমত এভাবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কেউ কোনো নাগরিককে তুলে নিয়ে যেতে পারে না। দ্বিতীয়ত, যে তিনজন সমন্বয়ককে তুলে নেওয়া হয়েছে তারা জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে আলোচিত একটা বড় আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত। যে আন্দোলনের সঙ্গে জনগণের সম্পৃক্ততা তৈরি হয়েছে, মানুষের অধিকারের প্রশ্ন সম্পৃক্ত হয়েছে। ফলে এমন পরিচিতি তিনজন সমন্বয়ককে এভাবে অযৌক্তিকভাবে গায়ের জোরে তুলে নেওয়াটা আরও অকল্পনীয়, আরও বেআইনি।

'তৃতীয়ত কেবল এই আন্দোলনের প্রখ্যাত সমন্বয়ক হিসেবেই না, বাংলাদেশের যেকোনো একজন অখ্যাত নাগরিক, খুব সাধারণ প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর একজন মানুষকেও জোর করে তুলে নেওয়ার কোনো ক্ষমতা নেই পুলিশের। দুই জায়গায় এটার সুস্পষ্ট নিষেধ আছে। সংবিধানে নিষেধ আছে যে কাউকে কোনো সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ছাড়া তুলে নেওয়া যাবে না। আমাদের আইনে নিষেধ আছে। এবং বাংলাদেশ সরকার বনাম ব্লাস্টের মামলায় (৬৯ ডি এল আর, আপিল বিভাগ, পৃষ্ঠা ৬৩) এভাবে গ্রেপ্তারের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের স্পষ্ট নির্দেশনা আছে। তাই পুলিশ এটা পারে না। এটা বেআইনি। পুলিশের এ ক্ষমতা নেই।'

আরিফ খান আরও বলেন, 'যদি কাউকে পুলিশ তুলে নিয়েও যায় তাহলে সঙ্গে সঙ্গে তাকে ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে হাজির করতে হবে। অনেকে বলে থাকেন ২৪ ঘণ্টার মধ্যে নিতে হবে। কিন্তু এটা ম্যাক্সিমাম। আসলে তাকে ধরার সঙ্গে সঙ্গে নিতে হবে ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে। অর্থাৎ আইন, সংবিধান, সুপ্রিম কোর্টের রায়ে এটা বেআইনি, অসাংবিধানিক। এভাবে কাউকে ধরে নিয়ে যাওয়া সম্ভব না। গায়ের জোরে এটা করা হয়েছে, যা গণতান্ত্রিক রীতিনীতি ও বিচারব্যবস্থার সঙ্গে যায় না।'

এদিকে শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে যেভাবে ঢালাও মামলা দেওয়া হচ্ছে তাতে এই উদ্যোগও সরকারের বিরুদ্ধে যাবে বলে মনে করেন এ আইনজীবী। তিনি বলেন, 'ছাত্রদের নামে মামলা দেওয়ার কোনো ধরনের যৌক্তিকতা এবং আইনি ভিত্তি নেই। কারণ আন্দোলন করা সংবিধান-স্বীকৃত একটা অধিকার। সংবিধানের ৩৮ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা আছে—"আমি যদি কোনো বিষয়ে নিজেকে বঞ্চিত মনে করি আমি সেটার জন্য মিটিং-মিছিল করতে পারব।"

'ফলে যে ছাত্ররা নিছক আন্দোলনে নেমেছে এবং আন্দোলনের মধ্য দিয়ে তারা তাদের দাবিদাওয়া তুলে ধরেছে সেটার কারণে তাদের বিরুদ্ধে মামলা দেওয়াটা খুবই বেআইনি ও অসাংবিধানিক কাজ হচ্ছে। এতে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসবে না; বরং ছাত্রদের মধ্যে যে ক্ষোভ আছে সেই ক্ষোভ আরও বেড়ে যাবে। এটা ঠিক না।' 

Comments

The Daily Star  | English
US dollar price rises

Explanations sought from 13 banks for higher dollar rate

BB issued letters on Dec 19 and the deadline for explanation ends today

2h ago