‘আঘাত আর যন্ত্রণার ছাপ তাদের চোখে-মুখে’

রামপুরায় কোটা সংস্কার আন্দোলনে পুলিশের সঙ্গে আন্দোলনকারীদের সংঘর্ষে আহত এক কিশোরকে হাসপাতালে নিয়ে যান স্বজনেরা। ছবিটি গত ১৯ জুলাইয়ের। ছবি: সংগৃহীত

হাসপাতালের বেডে শুয়ে নিজের ডান পা যেখানে সেদিকে তাকিয়ে ছিল দশম শ্রেণির ছাত্র মো. রিফাত। এক সময় ডুকরে কেঁদে ওঠে সে। যেখানে তার ডান পা থাকার কথা ছিল হাঁটুর নিচ থেকে সেটি কেটে ফেলা হয়েছে।

গত ১৯ জুলাই সকালে রামপুরায় কী হচ্ছে দেখতে বাড়ি থেকে বের হয়েছিল বাড্ডার আলাতুন্নেছা উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ছাত্র রিফাত। সকাল ১০টার দিকে গুলিবিদ্ধ হয় সে।

রিফাতের দুটি অস্ত্রোপচার করা হয়। তবে রক্ষা করা যায়নি তার একটি পা।

জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও অর্থোপেডিক রিহ্যাবিলিটেশন ইনস্টিটিউটের (নিটোর) ক্যাজুয়ালটি ওয়ার্ড-২ এ নরম গলায় রিফাত বলেন, 'আমি আর স্কুলে যেতে পারব কিনা জানি না।'

অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ নিয়ে হাসপাতালের বেডে শুয়ে বার বার ডুকরে কেঁদে উঠছিল এই কিশোর।

'আমি শুধু দেখতে চেয়েছিলাম আমার আশেপাশে কী হচ্ছে। আমি সেখানে কোনো প্রতিবাদ করতে যাইনি। রামপুরা ইউ-লুপের কাছে শরবত খাচ্ছিলাম, হঠাৎ একটি গুলি আমার ডান পায়ে লাগে আর আমি মাটিতে পড়ে যাই।'

একই ওয়ার্ডে ঢাকা কলেজের দর্শন বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী ইমরান সরকারও তার বাম পা হারিয়েছেন। গত ১৯ জুলাই বিকেলে রায়েরবাজার এলাকায় পুলিশের সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের সংঘর্ষের সময় তিনি গুলিবিদ্ধ হন।

'আমি জুমার নামাজ পড়ে বাড়ি ফিরছিলাম। হঠাৎ আমার পায়ে একটি গুলি লাগে, আমি অজ্ঞান হয়ে যাই,' বলেন ইমরান।

জ্ঞান ফিরলে নিজেকে হাসপাতালের বিছানায় দেখতে পান।

কান্নায় ভেঙে পড়ে ইমরান বলেন, 'আমি আবার কেমন করে হাঁটব?'

গত বৃহস্পতিবার বিকেলে তার আরও একটি অস্ত্রোপচার হয়েছে।

সাম্প্রতিক সহিংসতায় রিফাত ও ইমরানের মতো গুলিবিদ্ধ হয়ে হাত-পা এমন আট জন রয়েছেন নিটোরে। তাদের মধ্যে ছয় জন পা হারিয়েছেন এবং দুজন তাদের হাত।

হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের তথ্য অনুসারে, গত ১৮ জুলাই থেকে ২২ জুলাই পর্যন্ত গুলিবিদ্ধ ২৩৮ জন রোগী হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন। তাদের মধ্যে কয়েকজনকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।

সেখানকার চিকিৎসকরা আশঙ্কা করছেন, চিকিৎসাধীন বেশ কিছু রোগীর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ হয়তো বাঁচানো সম্ভব হবে না।

কিশোরগঞ্জের ভৈরব থেকে আসা ট্রাকচালক মোহাম্মদ মামুন (৩০) গত বুধবার ক্যাজুয়ালটি ওয়ার্ড-১ এর বেডে শুয়ে ছিলেন।

গত ১৯ জুলাই বিকেলে ঢাকা থেকে ভৈরব যাওয়ার সময় নৃশংসভাবে কুপিয়ে জখম করা হয় তাকে।

'আমি সংঘর্ষের ঠিক মাঝখানে পইড়া গেছিলাম। চারপাশে ব্যাপক গোলাগুলি হইতাছিল। নিরাপদে যাওয়ার জন্য ট্রাক থেকে নামার সময় অনেকগুলা লোক আমাকে ধইরা ফালায় আর ছুরি মারে। আমি তাগো কাউরে চিনি না,' দ্য ডেইলি স্টারকে বলছিলেন মামুন।

তার বাম হাতে সাতটি সেলাই পড়ে। আর ডান হাতে ছুরিকাঘাতের অনেকগুলো আঘাত দেখা যায়, সেখানে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়েছিল।

'ডাক্তাররা বলছে আমার ডান হাত কাটা ছাড়া আর কোনো উপায় নাই। ডান হাত ছাড়া আমি গাড়ি চালামু কেমনে?'

বৃহস্পতিবার অস্ত্রোপচারে তার ডান হাত কেটে ফেলতে হয়েছে বলে জানিয়েছেন তার পরিবারের সদস্যরা।

গত ২৪ জুলাই হাসপাতাল সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায় গুলিবিদ্ধ ৩৪ রোগীকে ক্যাজুয়ালটি ওয়ার্ড-২-এ চিকিৎসাধীন।

তাদের মধ্যে সাতজন হাতে এবং ২৬ জন পায়ে গুলিবিদ্ধ হয়েছেন।

রোগী ও স্বজনদের কান্নায় হাসপাতালের পরিবেশ ভারি হয়ে ওঠে। কেউ কেউ রোগীর জন্য রক্তের জন্য ছুটছিলেন।

তাদের অনেকেই জানান, ঢাকায় আসতে আর হাসপাতালের খরচ যোগাতে তাদের হাত একেবারে খালি। নিটোরে আসার আগে বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসার যেতে হয়েছে তাদের।

নিটোরের পরিচালক কাজী শামীম উজ্জামান বলেন, সেখানে ভর্তি হওয়া সব রোগীরই অস্ত্রোপচার হয়েছে এবং কারও কারও একাধিক অস্ত্রোপচার হয়েছে।

'এমনকি অস্ত্রোপচারের পরও, তাদের কারও কারও শরীরে এখনও গুলি রয়েছে,' বলেন তিনি।

কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে নজিরবিহীন সহিংসতা দেখেছে করেছে দেশ। গত ১৫ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগের হামলার পর অহিংস আন্দোলন সহিংস রূপ নেয়।

সংঘর্ষে বেশ কয়েকজন ছাত্র নিহত হওয়ার পরের দিনগুলোতে সহিংসতা আরও বেড়ে যায়। সরকার শেষ পর্যন্ত দেশব্যাপী কারফিউ জারি করে এবং সশস্ত্র বাহিনী মোতায়েন করে।

ডেইলি স্টারের হিসাব অনুসারে, গত ১৬ জুলাই থেকে এ পর্যন্ত তিন পুলিশ সদস্যসহ অন্তত ১৫৬ জন নিহত হয়েছেন। ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের সহায়তায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও আন্দোলনকারীদের  মধ্যে সংঘর্ষে কয়েক হাজার মানুষ আহত হয়েছেন।

মৃতের সংখ্যা বাড়তে পারে কারণ ডেইলি স্টার ঢাকা এবং বাইরের অনেক হাসপাতালে পৌঁছাতে পারেনি যেখানে অনেক গুরুতর আহতদের চিকিৎসার জন্য নেওয়া হয়েছিল। এছাড়াও, অনেক বন্ধু এবং পরিবার ঘটনাস্থল থেকে তাদের প্রিয়জনের মরদেহ নিয়ে গেছে বলে জানা গেছে এবং এই সংবাদপত্র তাদের সাথে যোগাযোগ করতে পারেনি। ডেইলি স্টারের মৃত্যুর সংখ্যার গণনা শুধুমাত্র হাসপাতাল এবং পুলিশ সূত্রের উপর ভিত্তি করে।

Comments

The Daily Star  | English
Bangladesh trade deficit July-August FY25

Trade deficit narrows 2.6% in July-April

The country’s trade deficit narrowed by 2.60 percent in the first ten months of the current fiscal year compared to the same period a year ago, thanks to a rise in export earnings coupled with subdued imports..During the July-April period of fiscal year (FY) 2024-25, the trade gap was $18.

6h ago