জ্বরঠোসা হলে কী করবেন

জানিয়েছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের রেসপিরেটরি মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ আতিকুর রহমান।
জ্বরঠোসা
ছবি: সংগৃহীত

হারপিস সিমপ্লেক্স ভাইরাস অত্যন্ত ছোঁয়াচে। এই ভাইরাসের কারণেই হয় জ্বরঠোসা। জ্বরঠোসা সম্পর্কে বিস্তারিত জানিয়েছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের রেসপিরেটরি মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ আতিকুর রহমান।

 

হারপিস ল্যাবিয়ালিস বা জ্বরঠোসা কী

ডা. আতিকুর রহমান বলেন, জ্বরঠোসা এক ধরনের ভাইরাল ডিজিজ, ছোঁয়াচে রোগ। এটি মূলত হারপিস সিমপ্লেক্স ভাইরাস টাইপ-১ (এইচএসভি-১) এর সংক্রমণ থেকে হয়। এই ভাইরাসের সংক্রমণেই জ্বরঠোসা হয় যা হারপিস ল্যাবিয়ালিস, কোল্ড সোর, ফিবার ব্লিস্টার নামেও পরিচিত।

কোনোভাবে হারপিস ভাইরাসের সংস্পর্শে আসলে সংক্রমিত হতে পারে যে কেউ। এর কারণে মূলত ঠোঁটে ফোস্কার মতো হয়। এ ছাড়া চোখে, শরীরের অন্য স্থানও আক্রান্ত হয়।

হারপিস সিমপ্লেক্স টাইপ-১ ভাইরাস ছোঁয়াচে। তাই আক্রান্ত ব্যক্তির জ্বরঠোসা থেকে অন্য কেউ আক্রান্ত হতে পারে। জ্বরঠোসায় হাত দেওয়ার পর সেই হাত চোখে বা শরীরের অন্য কোনো স্থানে লাগলেও সংক্রমণ ছড়াতে পারে, বাচ্চাকে আদর করার সময়, ব্যবহার্য জিনিসপত্রের মাধ্যমে ছড়াতে পারে।

জ্বরঠোসা নিজে থেকেই ঠিক হয়ে যায়, তবে কিছু ক্ষেত্রে চিন্তার কারণ হয় দাঁড়ায়। বিশেষ করে চোখ সংক্রমিত হলে। সঠিক সময়ে চিকিৎসা না করলে অন্ধত্বের ঝুঁকি তৈরি করে এই ভাইরাস।

জ্বরঠোসা ওঠার কারণ

ডা. আতিকুর রহমান বলেন, হারপিস সিমপ্লেক্স ভাইরাস সবসময় সংক্রমিত করে না। এটি আমাদের শরীরে অনেক সময় নিষ্ক্রিয় অবস্থায় থাকে। বেশ কিছু কারণে এর সংক্রমণ ঘটে। যেমন-

১. কোনোভাবে হারপিস সিমপ্লেক্স টাইপ-১ ভাইরাসের মাধ্যমে সংক্রমিত হলে জ্বরঠোসা ওঠে।

২. যখন শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায় তখন হারপিস সিমপ্লেক্স ভাইরাস এক্টিভ হয় এবং সংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকি বাড়ে।

৩. হারপিস ভাইরাসের কারণে জ্বর আসে এবং জ্বরঠোসা হয়। তবে অন্য যেকোনো কারণে বা সংক্রমণজনিত জ্বর হলে শরীর দুর্বল হয়ে যায়। এতে করেও জ্বরঠোসা উঠতে পারে।

৪. কারো যদি ডায়াবেটিস থাকে, শারীরিক অসুস্থতা, খুব ক্লান্তি, অত্যাধিক মানসিক চাপ ও হতাশা থাকে।

৫. নারীদের পিরিয়ডের সময় হতে পারে। কারণ সে সময় শরীর দুর্বল থাকে।

৬. ক্যানসার আক্রান্ত ব্যক্তি, ক্যানসারের চিকিৎসা নিচ্ছেন যারা তাদের হতে পারে।

এ ছাড়া মায়ের হারপিস সিমপ্লেক্স থাকলে বাচ্চাকে বুকের দুধ খাওয়ানো, আদর করা বা পরিচর্যার সময় ভাইরাস সংক্রমিত করতে পারে। শিশুদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম। তাই তাদের ভেতর হারপিস সিমপ্লেক্স ভাইরাস বেশি পরিমাণে ছড়ায়।

লক্ষণ

জ্বরঠোসা অত্যন্ত যন্ত্রণাদায়ক। ঠোঁটের কোণে বা এর চারপাশে জ্বরঠোসা ওঠে। জ্বরঠোসা প্রথমে ছোট ছোট ফুসকুড়ির মত ওঠে, এরপর ফুসকুড়ির ভেতর পানির মতো তরল জমতে থাকে। পরে ফোস্কা ফেটে গিয়ে শুকিয়ে চলটার মতো ওঠে। জ্বরঠোসায় জ্বালাপোড়া করবে, ব্যথা হবে, জ্বর আসবে, শরীর দুর্বল হয়ে যায়। এ সময় মুখ হা করতে, খাবার খেতে অসুবিধা হয়।

চোখ সংক্রমিত হলে চোখ ফুলে যাবে, ব্যথা করবে, জ্বালাপোড়া করবে, পানি পড়বে।

চিকিৎসা

ডা. আতিকুর রহমান বলেন, জ্বরঠোসা হরে চিকিৎসকের কাছে যেতেই হবে এমনটা নয়। তবে কিছু ক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। জ্বরঠোসা যদি চোখের কাছাকাছি স্থানে ওঠে বা চোখ হারপিস সিমপ্লেক্স ভাইরাসের মাধ্যমে সংক্রমিত হয় তখন অবশ্যই চক্ষু বিশেষজ্ঞের কাছে যেতে হবে। নয়তো চোখের কর্নিয়া ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। যাদের ডায়াবেটিস আছে, ক্যানসার আক্রান্ত, শিশু, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম তাদের পরিস্থিতি অনুযায়ী চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে।

১. জ্বরঠোসার জন্য চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী অ্যান্টিভাইরাল ক্রিম ব্যবহার করতে হবে। আক্রান্ত স্থানে দিনে ৫ বার ক্রিম লাগাতে হবে।

২. ব্যথা কমানোর জন্য চিকিৎসকের পরামর্শে ব্যথানাশক হিসেবে প্যারাসিটামল খাওয়া যেতে পারে।

৩. জ্বালাপোড়া করলে আক্রান্ত স্থানে বরফ দেওয়া যেতে পারে।

৪. জ্বরঠোসার চিকিৎসায় কোনোভাবেই অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়া যাবে না।

৫. ফোস্কা আস্তে আস্তে শুকিয়ে যায়। ত্বক যাতে না ফাটে সেজন্য জ্বরঠোসায় ও ঠোঁটে পেট্রোলিয়াম জেলি ব্যবহার করতে হবে।

৬. জ্বরঠোসা হলে অনেকে পানি খাওয়া কমিয়ে দেন, যা ঠিক নয়। পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি খেতে হবে এই সময়।

৭. চোখ হারপিস ভাইরাস সংক্রমিত হলে চোখ ঘষা যাবে না, চক্ষু বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হতে হবে।

৮. অতিরিক্ত টক জাতীয় ফল, অতিরিক্ত ঝাল মসলাযুক্ত খাবার খেলে আক্রান্ত স্থানে বেশি জ্বালাপোড়া ও ব্যথা হয়। তাই ওই সময়ের জন্য এসব খাবার পরিহার করতে হবে। পুষ্টি সমৃদ্ধ ফল ও খাবার খেতে হবে যাতে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে।

প্রতিরোধ

ডা. আতিকুর রহমান বলেন, হারপিস সিমপ্লেক্স ভাইরাস ছোঁয়াচে তাই জ্বরঠোসা হলে আক্রান্ত ব্যক্তির ব্যবহার্য লিপজেল, লিপস্টিক, বিভিন্ন প্রসাধনী সামগ্রী, রেজার, তোয়ালে, পানির বোতল, গ্লাস, চামচ ইত্যাদি অন্য কেউ যাতে ব্যবহার না করে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। খাবার খাওয়া অবস্থায় সেই খাবার অন্য কারো সঙ্গে শেয়ার করা যাবে না।

জ্বরঠোসা হাত দিয়ে স্পর্শ করা যাবে না, কোনো কারণে আক্রান্ত স্থানে হাত দিলে সাবান পানি দিয়ে ভালো করে হাত ধুয়ে নিতে হবে।

আক্রান্ত স্থান স্পর্শ করে অন্য কাউকে এমনকি নিজের শরীরের অন্য কোনো স্থানে হাত দেওয়া যাবে না। বাচ্চাদের চুমু দিয়ে আদর করা যাবে না, চোখ চুলকানো বা হাত দেওয়া যাবে না। জ্বরঠোসা থাকলে দাঁত প্রসিডিউর করা থেকে বিরত থাকতে হবে। কারণ সে সময় এটি করা যন্ত্রণাদায়ক এবং ভাইরাস ছড়ানোর ঝুঁকি বেশি থাকে।

 

Comments

The Daily Star  | English
economic challenges for interim government

The steep economic challenges that the interim government faces

It is crucial for the interim government to focus on setting a strong foundation for future changes.

10h ago