ছাত্রলীগ-কোটা আন্দোলনকারী সংঘর্ষ: যুবলীগ নেতার গাড়িতে ‘অস্ত্র’ আনার অভিযোগ
চট্টগ্রামের মুরাদপুরে কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের সঙ্গে ছাত্রলীগ ও যুবলীগ কর্মীদের কয়েক ঘণ্টাব্যাপী সংঘর্ষে ব্যবহৃত অস্ত্র চট্টগ্রামের এক যুবলীগ নেতার প্রাইভেটকারে সরবরাহের অভিযোগ পাওয়া গেছে।
প্রত্যক্ষদর্শীদের বয়ান ও এ ঘটনার ভিডিও ফুটেজ বিশ্লেষণ করে বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া গেছে৷
চট্টগ্রাম নগরের ষোলশহর স্টেশনে বিক্ষোভ কর্মসূচি করার কথা ছিল কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের। গতকাল মঙ্গলবার দুপুর সাড়ে ৩টায় এই কর্মসূচি শুরুর আগেই স্টেশনে অবস্থান নেন যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। তাঁদের হাতে ছিল লাঠিসোঁটা ও পাথর।
দুপুর ৩টার দিকে আন্দোলনকারীরা খণ্ড খণ্ড মিছিল নিয়ে স্টেশনের দিকে আসতে থাকেন। এরপর নগর ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক নুরুল আজিম রনি নেতৃত্বে একটি মিছিল মুরাদপুরে গিয়ে আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা করলে শুরু হয় সংঘর্ষ। চলে পাল্টাপাল্টি ধাওয়া ও পাথর নিক্ষেপ এবং ককটেল বিস্ফোরণ।
বিকেল সাড়ে ৩টা থেকে শুরু হওয়া এই সংঘর্ষ চলে বিকেল ৫টা পর্যন্ত।
এরপর দ্বীতিয় দফায় ষোল শহরের দিক থেকে যুবলীগ ও ছাত্রলীগের একটি মিছিল থেকে আন্দোলনকারীদের আবার ধাওয়া দেওয়া হয়। প্রত্যক্ষদর্শী কয়েকজন এবং সেখানে থাকা সাংবাদিকরা জানান মুরাদপুর সাদিয়া কিচেন রেস্টুরেন্টের পাশ থেকে এ সময় যুবলীগ ও ছাত্রলীগের কয়েকজন গুলি ছুড়তে ছুড়তে আন্দোলনকারীদের ধাওয়া দেন এবং বিস্ফোরণ ঘটানো হয় ককটেলের।
আন্দোলনকারীদের অভিযোগ, গুলি ও ককটেল ছুড়েছেন যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। গুলিতে অনেকে আহত হয়েছেন। যুবলীগ ও ছাত্রলীগের তিনজন অস্ত্রধারী ছিলেন। তাদের মধ্যে দুজন ছিলেন হেলমেট পরিহিত।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক বেসরকারি টেলিভিশনের প্রতিবেদক দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'যুবলীগ ও ছাত্রলীগ যখন দ্বিতীয় দফায় আন্দোলনকারীদের ধাওয়া দেয়, তখন একটি সাদা রঙের প্রাইভেটকার তাদের পিছনে ছিলো। অস্ত্রধারীরা হেলমেট পরে গুলি ছুড়ে সামনের দিকে আন্দোলনকারীদের যাচ্ছিলেন। এই সময় সেই সাদা রঙের প্রাইভেটকার থেকে কয়েকটি ব্যাগ নামানো হয়।'
একটি ভিডিও ফুটেজে দেখা গেছে, গুলি ছোড়া ঘটনার সময় গাড়িটির অবস্থান ছিলো যুবলীগ-ছাত্রলীগ কর্মীদের শেষ ভাগে। এই সময় শর্টগান হাতে একজনকে দেখা গেছে। এ ছাড়া, যুবলীগের নেতাকর্মীরা গাড়ির পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন। এরপর সেই ব্যাগগুলো কাঁধে নেন বেশ কয়েকজন। এরপর গাড়িটি চলে যায়।
দ্য ডেইলি স্টারের অনুসন্ধানে জানা গেছে, গাড়িটির রেজিস্ট্রেশন নম্বর 'চট্ট মেট্রো-গ ১৪-৩২২১'। গাড়িটি চট্টগ্রাম যুবলীগের নেতা হেলাল আকবর চৌধুরী বাবরের ঘনিষ্ঠ জাফর উল্লাহর।
গাড়িটি জাফর উল্লাহর প্রতিষ্ঠান 'এসএনবি ট্রেড করপোরেশন'র নামে রেজিস্ট্রেশন করা।
নগর যুবলীগের একাধিক সূত্রে জানা যায়, জাফর উল্লাহ নিরাপত্তা বাহিনীর কাজের ঠিকাদারি করেন। তিনি চট্টগ্রাম ওমরগণি এমইএস কলেজের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে মঙ্গলবার রাতে জাফর উল্লাহ দ্য ডেইলি স্টারকে টেলিফোনে বলেন, 'গাড়িটি আমার। আজকে দলের ছেলেরা আমার গাড়িটি ব্যবহার করার জন্য দুইবার নিয়ে গিয়েছিল। একবার সকালে, আরেকবার দুপুরে। তারা কী কাজে নিয়েছে সেটা জানি না।'
সংঘর্ষের সময় অস্ত্রধারীদের পাশে একাধিক ব্যাগ নামানোর বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'আমার ড্রাইভার এ বিষয়ে কিছু জানায়নি। ওই সময় আমি ব্যবসার কাজে বাইরে ছিলাম।'
অস্ত্রধারী একজন 'ডাকাত ফিরোজ'
সংঘর্ষের সময় অস্ত্রধারী যুবকদের মধ্যে একজনের পরিচয় নিশ্চিত করতে পেরেছে দ্য ডেইলি স্টার।
তিনি মুরাদপুরে যুবলীগ নেতা হিসেবে নিজেকে পরিচয় দেন।
তবে ছাত্রলীগ ও যুবলীগের নেতারা বলছেন, ফিরোজ আগে শিবির করতেন। তিনি 'শিবির ক্যাডার ফিরোজ' নামেই খ্যাত। পরে দল বদলে যুবলীগের রাজনীতি শুরু করেন।
সবশেষ চট্টগ্রামে স্কুল ছাত্রী তাসফিয়া হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার হয়েছিলেন তিনি।
পুলিশ জানায়, ২০১১ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি রাতে নগরের প্রবর্তক মোড়ে একটি রোগ নির্ণয়কেন্দ্র থেকে সন্ত্রাসীরা ১১ লাখ টাকা লুট করে নেয়, মারধর করা হয় একজন চিকিৎসককে। ডাকাতি ঘটনার পরদিন নগরের বায়েজিদ থানার কয়লাঘর এলাকা থেকে শিবির ক্যাডার মো. ফিরোজ ও মনিরুজ্জামানকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
পরে ফিরোজের পাঁচলাইশের আস্তানা থেকে ১২ রাউন্ড গুলিভর্তি দুটি বিদেশি পিস্তল, তিনটি গুলিসহ একটি ম্যাগাজিন, একটি একনলা বন্দুক, একটি বন্দুকের ব্যারেল, তিনটি কার্তুজ, দুটি চাপাতি উদ্ধার করা হয়।
গতকাল চট্টগ্রামে হওয়া সংঘর্ষে এখন পর্যন্ত এক পথচারীসহ তিন জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন কমপক্ষে ৪০ জন।
এর মধ্যে ১২ থেকে ১৫ জন ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। আহতরা চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও বিভিন্ন প্রাইভেট হাসপাতালে ভর্তি আছেন।
Comments