‘কোটা আন্দোলনে বিএনপি ভুত দেখা তাদের নৈতিক পরাজয়ের নিদর্শন’

'এখানে সবাই ভুক্তভোগী। ছাত্রলীগও ভুক্তভোগী, তাদের শত শত কর্মী এখানে বক্তব্য দিচ্ছে। এরকম ম্যাস মুভমেন্টের ক্রেডিট যদি বিএনপিকে দেওয়া হয় তাহলে তো সমস্যা।’
সোমবার বিকেলে শাহবাগে ‘বাংলা ব্লকেড’ কর্মসূচি। ছবি: স্টার

সরকারি চাকরিতে কোটাব্যবস্থা বাতিল করে ২০১৮ সালের পরিপত্র পুনর্বহালের দাবিতে পরপর দুদিন অর্ধদিবস সড়ক অবরোধ করে আন্দোলন করছেন শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রত্যাশীরা।

চলমান এ আন্দোলনে 'বিএনপি ও তাদের সমমনস্করা প্রকাশ্যে ভর করেছে' বলে আজ সোমবার ধানমন্ডিতে আওয়ামী লীগ সভাপতির রাজনৈতিক কার্যালয়ে মন্তব্য করেছেন ওবায়দুল কাদের। হাইকোর্টে বিচারাধীন বিষয় নিয়ে আন্দোলন না করে অপেক্ষা করার পরামর্শও দিয়েছেন তিনি।

আজ সোমবার বিকেল ৫টায় শাহবাগে 'বাংলা ব্লকেড' কর্মসূচিতে অংশ নেওয়া কয়েকজন ছাত্র নেতা-কর্মীর কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তারা বলেছেন, সাধারণ ছাত্রদের আন্দোলনে 'বিএনপির ভুত' দেখতে পাওয়া সরকার দলীয় নেতাকর্মীদের নৈতিক পরাজয়ের নির্দশন।

জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগের শিক্ষার্থী দেলওয়ার হোসেন দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আন্দোলনে বিএনপি ভর করছে এটা তো বললেই হবে না। পুরো শিক্ষার্থী সমাজ তো আর বিএনপি না। আমি নিজে ছাত্রলীগের একজন কর্মী এবং আমি এ আন্দোলনে আছি। তাহলে আমি কি বিএনপি? আমি ছাত্রলীগের আদর্শ নিজের মধ্যে ধারণ করি। আমি কয়েকশ বই পড়ছি ছাত্রলীগ, মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধুর জীবনী নিয়ে। আপনি 'বিএনপি' ট্যাগ দিলেই তো হবে না!'

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, 'ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় পর্যায় থেকে কোনো বাধা দেওয়া হয়নি। এটা শিক্ষার্থীদের লড়াই।'

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০২২-২৩ সেশনের হিসাববিজ্ঞান বিভাগের ঢাবি শিক্ষার্থী মো. হানিফ দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'কোনো প্রশ্নফাঁস, মৌখিক পরীক্ষায় কোনো লবিং ছাড়া একটা সুন্দর আমলাতন্ত্র চাই। ছাত্রসমাজ চায়, একটি সুন্দর আমলাতন্ত্র যারা দেশ পরিচালনা করবে। যারা রাষ্ট্রতন্ত্র পরিচালনা করবে তারা যেন দুর্নীতিগ্রস্ত না হয় সেজন্য আমরা মাঠে এসেছি। এখানে কোনো দলীয় উদ্দেশ্য নিয়ে আন্দোলন হচ্ছে না।'

ঢাবির যোগাযোগ বৈকল্য বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী নাহিয়ান মুসারাত ইশা ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আন্দোলনের শুরু থেকেই আমি আছি। আমার মতে, যারা বঞ্চিত জনগোষ্ঠী বা যারা আদতে সুযোগ পাচ্ছে না তাদের জন্য কোটা ঠিক আছে। কিন্তু আমরা যারা সমান সুযোগ পাচ্ছি, তাদের জন্য বিশেষ কোনো কোটার প্রয়োজন নেই।'

আন্দোলনে সংহতি জানাতে শাহবাগে আসা ঢাবি ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি মেঘ মল্লার বসু ডেইলি স্টারকে বলেন, 'কোটা প্রথার অযৌক্তিকতা নিয়ে ছাত্রসমাজ আগে থেকেই একমত। এত শিক্ষার্থী মাঠে নেমেছে। এটার গোটা স্পিরিট আমার কাছে ইতিবাচক মনে হয়েছে সে জায়গা থেকে সাংগঠনিক ও ব্যক্তিগতভাবে আমার এখানে আসা।'

তিনি বলেন, 'এই আন্দোলনে সব ছাত্র সংগঠনের লোকজন আছে। কারণ প্রত্যেকেই ছাত্র, প্রত্যেকেই সামনের দিনে চাকরি প্রত্যাশী। কেউ ছাত্রদল হলে আন্দোলনে আসতে পারবে না এমন তো কথা হতে পারে না। আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে খুব খারাপ দিকে যাচ্ছে যে আমরা বিভিন্ন দলীয় সংগঠনের লোকজন কেন আন্দোলনে সম্পৃক্ত হবে এ নিয়ে বারবার কথা তুলছি। ছাত্রলীগের নেতারা বলছে, যে এটা ছাত্রলীগের আন্দোলন, ছাত্রলীগের কর্মীরাও এখানে আছে। আবার ওবায়দুল কাদের বলছেন "বিএনপি ভর করছে"। বাস্তবতা হচ্ছে এখানে সব ছাত্র সংগঠনের সংহতি আছে। কিন্তু আন্দোলনের মূল স্পিরিট সাধারণ শিক্ষার্থীদেরই। এটা তাদেরই আন্দোলন। যারা এটাকে 'বিএনপি' ট্যাগ দিতে চাচ্ছে তারা আসলে সাধারণ ছাত্রদের দাবি ও স্পিরিটের বিরুদ্ধে অবস্থান করছে।'

সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট (মার্কসবাদী) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার নেতা মোজ্জামেল হক ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এটা একটা ম্যাস মুভমেন্ট। আমরা সাংগঠনিকভাবে এতে সংহতি জানাচ্ছি। শিক্ষার্থীদের চার দাবির সাথে আমরা একমত। ২০১৮ সালে আন্দোলন ছিল কোটা সংস্কার। যৌক্তিক মাত্রায় কোটা সংস্কার করা। কিন্তু সরকার এটাকে সংস্কার না করে বাতিল করে দিলো। এটা আসলে কোনো স্থায়ী সমাধান না। ২০১৮ সালে বাতিল করার কারণেই আজকে ২০২৪ সালে এই সমস্যা তৈরি হলো। এটা বাতিল না হয়ে যৌক্তিক সংস্কার হওয়া উচিত বলে মনে করি। বৈষম্যমূলক মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিল এবং নারী কোটা, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী কোটা, অনগ্রসর পিছিয়ে পড়া জাতিসত্তা, জনপদ ও বঞ্চিত শ্রেণির মানুষের জন্যে যৌক্তিক মাত্রায় কোটা নির্ধারণ করলে এটার একটা স্থায়ী সমাধান হয়।'

তিনি আরও বলেন, 'সরকারের বিভিন্ন দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা বিভিন্ন কমেন্ট করছেন। সেটা দেখে বোঝা যায় তারা এই আন্দোলনকে কীভাবে দেখছে। এটা ছাত্রদের দাবি। এটা নিয়ে পার্লামেন্টে আলোচনা হতে পারে।'

কেবল শিক্ষার্থীদের আন্দোলন নয়, শিক্ষকদের আন্দোলনেও সরকার 'বিএনপি' খুঁজে পাচ্ছে বলে মন্তব্য করেছেন ছাত্র ফেডারেশন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার নেতা আরমান।

তিনি ডেইলি স্টারকে বলেন, 'শিক্ষকরা যে আন্দোলন করছে খুবই যৌক্তিক একটা বিষয়। এখানে বিএনপিপন্থী শিক্ষকও থাকতে পারে, আওয়ামী লীগপন্থি শিক্ষকও থাকতে পারে। যারা নেতৃত্ব দিচ্ছে, দারুণ ভূমিকা রাখছে তারা শিক্ষক সমিতির নেতা। কোটা আন্দোলনের বিষয়টিও তাই। এখানে সবাই ভুক্তভোগী। ছাত্রলীগও ভুক্তভোগী, তাদের শত শত কর্মী এখানে বক্তব্য দিচ্ছে। এরকম ম্যাস মুভমেন্টের ক্রেডিট যদি বিএনপিকে দেওয়া হয় তাহলে তো সমস্যা।'

'আমরা ছাত্র ফেডারেশন কি শিক্ষার্থীদের জন্য আন্দোলন করি না? এখানে ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্র ফ্রন্টও আছে। তারা কি আন্দোলন করে? এখানে বিএনপির বিষয় না, আওয়ামী লীগেরও বিষয় না এটা সাধারণ শিক্ষার্থীদের বিষয়, তাদের স্বার্থের বিষয়। আমরা ছাত্রদের স্বার্থে সবসময় রাজপথে থাকব। এটা বলার মাধ্যমে তারা ছাত্রদের নৈতিক আন্দোলনকে রঙ দিতে চাচ্ছে। এটা তাদের নৈতিক পরাজয়ের একটা নিদর্শন।'

কোটাবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক হাসনাত আবদুল্লাহ ডেইলি স্টারকে বলেন, 'ওবায়দুল কাদের যে কমেন্ট করেছেন এটা উনার রুটিন মন্তব্য। যেহেতু উনি একটি দল করেন সেজন্য রাজনৈতিক মন্তব্য করেছেন। সবকিছুকে উনি রাজনীতির জায়গা থেকে যেহেতু দেখেন, সে কারণে সবসময়ই বিরোধী পক্ষ খুঁজে বেড়ান, বিরোধিতা করেই এটা বলেছেন বলে আমি মনে করি।'

'এটা এখন সবার কাছে স্পষ্ট ও প্রতিষ্ঠিত যে এটা সাধারণ ছাত্রদের আন্দোলন, তাদের দাবির আন্দোলন। একে কোনো রাজনৈতিক রঙ দেওয়া যাবে না,' বলেন তিনি।

Comments