আমাদের সঙ্কটে যেভাবে আপন হয় নজরুল 

মানবতার তূর্যবাদক কাজী নজরুল ইসলাম। আমাদের জাতীয় কবি, কারো কাছে ঝাঁকড়া চুলের বাবরি দোলানো পুরুষ, আবার কারো কাছে অবিনশ্বর বিপ্লবী। তিনি আসলে এই তিনের সম্মিলন, এককথায় মানবতার বরপুত্র। এজন্য বাঙালির জীবন সাম্য ও সম্প্রীতির ঝান্ডাধারী এই কবি ছাড়া নিষ্প্রভ, বাঙালির চেতনাও ঠিক একইভাবে নিরর্থক।

কাজী নজরুল ইসলামের যখন জন্ম হয়, তখন গোটা ভারতবর্ষ হাহাকারে বিক্ষুদ্ধ। একদিকে ইংরেজদের হৃদয়বিদারক অত্যাচার ও পরাধীনতার দুর্জয় জাঁতাকল, আরেকদিকে তাদেরই সৃষ্ট মৌলবাদের চোখরাঙানি। ইতিহাসের এহেন বিরুদ্ধ সময়ে জন্ম নিয়েও কীভাবে তিনি অসাম্প্রদায়িকতার স্বর্ণালী ঝাণ্ডাধারী হয়ে ওঠেন,তা আজও আমাদের ভাবায়। 

হয়তো "ইমামের সন্তান" দুখু মিয়া ছিলেন বলেই জীবনকে হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়েছিলেন। হয়ত জীবনকে খুব কাছ থেকে দেখেছিলেন বলেই তিনি সত্য অনুধাবনে সক্ষম হয়েছিলেন। এজন্যই যেখানে বেশিরভাগ উচ্চমার্গীয় ব্যক্তিবর্গ লাজসাহেবদের পদলেহনে উন্মত্ত ছিলেন। সেখানে নজরুল হয়ে ওঠেন বিবেকের অনির্বাণ আলোকশিখা, কোটি মানুষের রুদ্ধ কণ্ঠস্বর। এজন্য মানবতাকে পরিপূর্ণভাবে বুঝতে হলে নজরুলকে বোঝা অপরিহার্য।

মৌলবাদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে নজরুল নির্ভীকতার সঙ্গে ধর্মব্যবসার বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলেন। বাংলা ভাষা কতটা পরাক্রমশালী হতে পারে, নজরুল তাঁর দোয়াতের কালিতে সেটির নিখুঁত প্রমাণ করে।

কবি নজরুল মনে-প্রাণে, রক্তে-মাংসে ছিলেন একজন মানবতাবাদী  কবি। মুসলিম হিসেবে নিজ ধর্মের প্রতি যেমন তার অনুরাগ ছিল, তেমনিভাবে অন্য সকল ধর্মের প্রতিও তার সমান অনুরাগ। তিনি যেমন গজলের আসরে সবাইকে মাতিয়ে রেখেছেন, তেমনি কীর্তনের আসরে সবাইকে করেছেন তদ্রূপ বিভোর। তার সর্বাধিক কালজয়ী সাহিত্যকর্মও ছিল ধর্মনিরপেক্ষতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। তার "বিদ্রোহী" কবিতায় তিনি যেমন মুসলমানদের স্রষ্টা-নির্দেশক শব্দ "খোদা" ব্যবহার করেছেন, ঠিক তেমনি হিন্দুধর্মের স্রষ্টা নির্দেশক শব্দ "ভগবান"ও ব্যবহার করেছেন নি:সঙ্কোচে। ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে নজরুলের প্রথম সংগ্রাম প্রস্ফুটিত হয় তার "রুদ্রমঙ্গল" গ্রন্থে।

মৌলবাদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে নজরুল নির্ভীকতার সঙ্গে ধর্মব্যবসার বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলেন। বাংলা ভাষা কতটা পরাক্রমশালী হতে পারে, নজরুল তাঁর দোয়াতের কালিতে সেটির নিখুঁত প্রমাণ করে।

নজরুল বরাবরই তার লেখনীতে জীবনবোধকেই চিত্রায়িত করেছেন। এজন্য ব্যক্তি নজরুলও একজন আদর্শবাদী বিদ্রোহী। নজরুলের জীবনচরিতে কোনোদিন সাম্প্রদায়িকতার লেশমাত্রও পাওয়া দায়। জীবনের প্রতি পরতে পরতে তিনি অসাম্প্রদায়িক চেতনার বহি:প্রকাশ ঘটিয়েছেন। তিনি যেমন কুরআন তিলাওয়াত করেছেন, তেমনিভাবে পুরাণ, ত্রিপিটক ও বাইবেল আত্মস্থ করেছেন। যেমনিভাবে গজলের আসরের মধ্যমণি ছিলেন, ঠিক তেমনিভাবেই কীর্তন ও বৈষ্ণবগানের প্রাণকেন্দ্র ছিলেন। তার সঙ্গ নির্বাচনেও নজরুল কখনোই ধর্ম পরিচয়কে বিন্দুমাত্র তোয়াজ করেননি। 

এর সবচেয়ে সুস্পষ্ট প্রমাণ মেলে তার সহধর্মিণী প্রমীলা দেবীর ক্ষেত্রে। হিন্দু ধর্মাবলম্বী প্রমীলা দেবীর সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার মাধ্যমে এমনিভাবে হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতির এক বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন বিদ্রোহী কবি। অনুরূপভাবে সন্তানদের নামকরণের ক্ষেত্রেও তিনি সবসময় সৌন্দর্যকে ধর্মীয় বিভাজনের উপরে প্রাধান্য দিয়েছেন। চলনে-বলনে ধর্মনিরপেক্ষ চেতনার মূর্তপ্রতীক ছিলেন নজরুল।

নজরুল সারাজীবনই ছিলেন স্বাপ্নিক। তার স্বপ্নের মাহাত্ম্য কতটা প্রগাঢ় ছিল, তার লেখনীতেই বিশেষভাবে বর্তমান। স্বাধীনতা, সাম্য ও সমঅধিকার–এই ত্রয়ীর নিষ্কলুষ মিলনই ছিল নজরুলের স্বপ্ন। যে স্বপ্ন বাস্তবায়নে তিনি আজীবন সংগ্রাম করে গেছেন।  ইংরেজদের বিরাগভাজন ছিলেন স্বাধীনতার আপোষহীন দাবির প্রশ্নে। ঠিক একইভাবে কাঠমোল্লা ও পুরোহিতের চক্ষুশূলে পরিণত হন মানবতাবাদ ও অসাম্প্রদায়িক চেতনার কণ্টকাকীর্ণ পথ পাড়ি দিতে গিয়ে। তিনি খুব ভালোভাবেই জানতেন যে স্রষ্টা কখনোই তাঁর সৃষ্টির মধ্যে ভেদাভেদ চাইবেন না। এই সত্যের উপলব্ধি থেকেই তিনি বাজিয়েছেন ঐক্য ও মানবতার সুর ও ভ্রাতৃত্বের সুর। হয়তো এমন স্বর্গীয় বাঁশির  সুরের মাধুর্যে স্বয়ং হ্যামেলিনও বশীভূত হতে বাধ্য হতেন!

প্রতিবছর জন্ম মৃত্যুতে কবি কাজী নজরুল ইসলামকে উদযাপন করা হয়। কিন্তু কেবল উদযাপনের মধ্যেই আমরা দিন দুটিকে সীমাবদ্ধ করে রাখি, তাহলে নজরুলের সারাজীবনের সংগ্রাম ও ত্যাগের প্রতি চরম অপমান হবে। সময় এসেছে ভাই হিসেবে ভাইয়ের হাত ধরে পথ চলার, পারস্পরিক শ্রদ্ধা ভালোবাসার, সামাজিক ভেদাভেদ ভুলে মানুষকে মানুষ হিসেবে মূল্য দেওয়ার।

যদি কুরআন কখনো গীতার সাথে যুদ্ধ না করে, কিংবা বাইবেল কখনো ত্রিপিটক বা তোরাহর সাথে যুদ্ধ না করে, তবে কীসের জের ধরে আমরা দাঙ্গা-হাঙ্গামা করার জের রাখি? চন্ডীদাস থেকে নজরুল–সকলের চেতনাই মূলত  মানব বন্দনা তথা একই সূত্রে গাঁথা। আর তা হলো–"সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপর নাই।"

মাত্র ৪৩ বছর বয়সে নজরুল তার চৈতন্য হারিয়ে ফেলেন। রুদ্ধ হয়ে যায় তার বলিষ্ঠ কণ্ঠের সুরের প্রবাহ। অনেকে একে "করুণ পরিণতি" মনে করলেও আসলে স্রষ্টাও জানেন,"স্বাদের অল্পই ভালো"! অতএব, আজ আমাদের প্রতিজ্ঞা করতে হবে অসাম্প্রদায়িকতার চিরসত্য আদর্শকে সমুন্নত রাখার। তবেই কেবল এই বিদ্রোহী মহামানবের মহাত্মা শান্তি পাবে।

মাধ্যমিক শিক্ষার্থী, ঢাকা রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজ

Comments