ইরানের প্রেসিডেন্ট রাইসির মৃত্যুতে যুক্তরাষ্ট্র, ইসরায়েল ও ভারতের সমীকরণ
হেলিকপ্টার বিধ্বস্ত হয়ে প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসির মৃত্যুতে যখন শোক পালন করছে ইরান, তখন এর পরবর্তী পরিস্থিতি এবং ভূ-রাজনৈতিক সমীকরণের প্রভাব নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে পুরো বিশ্ব।
আজ সোমবার রাইসির মৃত্যুর সম্ভাব্য ভূ-রাজনৈতিক প্রভাব নিয়ে একটি বিশ্লেষণী প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে ভারতের গণমাধ্যম এনডিটিভি।
পশ্চিম এশিয়ার ভূ-রাজনীতির এক ক্রান্তিলগ্নে এই হেলিকপ্টার দুর্ঘটনা ঘটল বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
ইসরায়েলি ভূখণ্ডে ফিলিস্তিনি সশস্ত্র সংগঠন হামাসের এক হামলার জেরে গত সাত মাস ধরে গাজায় নিরবচ্ছিন্ন হামলা চালাচ্ছে ইসরায়েল। এই সংঘাতে হামাসের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে লেবানন-ইসরায়েল সীমান্তে হামলা চালাচ্ছে লেবাননের সশস্ত্র সংগঠন হিজবুল্লাহ।
হামাস ও হিজবুল্লাহ, উভয় সংগঠনকে পৃষ্ঠপোষকতার অভিযোগ রয়েছে তেহরানের বিরুদ্ধে। তবে পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলোর এই অভিযোগ বরাবরই অস্বীকার করে এসেছে ইরান।
তা সত্ত্বেও, গত মাসে ইসরায়েল-ইরান সম্পর্ক বৈরিতায় রূপ নেয়। সিরিয়ায় ইরানের দূতাবাসে ইসরায়েলি বিমান হামলায় কয়েকজন কর্মকর্তা নিহত হন।
এ ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় ইসরায়েলে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায় ইরান। তবে ইসরায়েলের আয়রন ডোম আকাশ হামলা প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা বেশিরভাগ ক্ষেপণাস্ত্রকে ভূপাতিত করে। এরপর ইরানের ইসফাহান প্রদেশে সীমিত আকারে পাল্টা হামলা চালায় ইসরায়েল।
এই প্রেক্ষাপটে, অবধারিত ভাবেই হেলিকপ্টার দুর্ঘটনা নিয়ে জল্পনা কল্পনা শুরু হয়েছে। এখন পর্যন্ত ইরানের রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমে হেলিকপ্টার ধ্বংসের বিষয়টিকে দুর্ঘটনা হিসেবেই বলা হয়েছে। তবে এখন দুর্ঘটনার আনুষ্ঠানিক কারণ জানায়নি ইরান। যেকোনো ধরনের ষড়যন্ত্রের অভিযোগ বা ইঙ্গিত এই সংবেদনশীল অঞ্চলের অস্থিরতা বাড়াতে পারে।
ইতোমধ্যে অন্তর্বর্তীকালীন প্রেসিডেন্ট ও পররাষ্ট্রমন্ত্রীর নাম ঘোষণা করেছে ইরান। বিশ্লেষকদের মতে, অন্যান্য দেশের সঙ্গে ইরানের সম্পর্কে তেমন কোনো পরিবর্তন আসবে না। মূলত শীর্ষ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলি-খামেনি নেপথ্যে থেকে কলকাঠি নাড়বেন। সরকার ইতোমধ্যে জানিয়েছে, কার্যক্রমে 'সামান্যতম বাধাও' আসবে না।
মার্কিন সমীকরণ
ইসরায়েলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মিত্র যুক্তরাষ্ট্র এখনো রাইসির মৃত্যুতে কোনো আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানায়নি। তবে সার্বিক পরিস্থিতি সম্পর্কে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে ব্রিফিং করা হয়েছে বলে জানা গেছে।
গত কয়েক বছর ইরান-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কে অনেক টানাপড়েন দেখা দিয়েছে। কারণ মূলত তেহরানের পারমাণবিক সক্ষমতা অর্জনের প্রচেষ্টা। ২০১৮ সালে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ইরানের সঙ্গে পারমাণবিক চুক্তি থেকে পিছিয়ে যান এবং দেশটির বিরুদ্ধে অসংখ্য অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন। যার ফলে, পারমাণবিক চুক্তিতে উল্লেখ করা কিছু শর্ত পালন থেকে বিরত থাকে ইরান।
২০২১ সালে ক্ষমতা গ্রহণের পর দর কষাকষিতে কঠোর অবস্থান নেন ইব্রাহিম রাইসি (৬৩)। রয়টার্সের এক প্রতিবেদন মতে, ইরানের অত্যাধুনিক পারমাণবিক প্রযুক্তির উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় কিছুটা রাশ টেনে ধরার বিনিময়ে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের বিধিনিষেধের একটি বড় অংশ থেকে বের হয়ে আসার সুযোগ দেখতে পান।
গাজার সংঘাত ইরানসহ মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য অংশেও ছড়িয়ে পড়তে পারে, এমন আশঙ্কায় ছিল বাইডেন প্রশাসন। যার ফলে বেসামরিক নাগরিকদের জীবনের সুরক্ষা দিতে ইসরায়েলকে বারবার চাপ দিতে থাকে ওয়াশিংটন। বাইডেন এমনকি ইসরায়েলকে অস্ত্র দেওয়া বন্ধ করার ও নীতিমালা পরিবর্তনের হুমকিও দেন।
কয়েকটি প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে, বাইডেন প্রশাসনের কর্মকর্তারা ইরানের সঙ্গে পরোক্ষভাবে আলোচনা চালাচ্ছিলেন যেন অন্যান্য দেশে সংঘাত ছড়িয়ে না যায়।
তবে রাইসির মৃত্যুতে খানিকটা হলেও এ অঞ্চলে অস্থিতিশীলতা দেখা দেওয়ার হুমকি দেখা দিয়েছে। বিশ্লেষকদের মতে, যুক্তরাষ্ট্র যেকোনো মূল্য শান্তি নিশ্চিতের প্রচেষ্টা চালাবে।
ইসরায়েল
প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসির মতো কট্টরপন্থী নেতার মৃত্যুর পর ইরানকে মোকাবিলা করতে ইসরায়েল মধ্যপ্রাচ্যে তার অবস্থান শক্তিশালী করতে পারে বলে দ্য ইকোনমিক টাইমসের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
এতে বলা হয়, রাইসির মৃত্যু ইসরায়েলের নিরাপত্তা পরিস্থিতিকে প্রভাবিত করতে পারে। কারণ ইসরায়েল বিরোধী হামাস ও হিজবুল্লাহর মতো সশস্ত্র গোষ্ঠীকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছিলেন রাইসি।
এদিকে, রাইসিকে বহনকারী হেলিকপ্টার বিধ্বস্তের পেছনে ইসরায়েলের সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে কেউ কেউ সন্দেহ করছে। যদিও, কোনো রাষ্ট্রপ্রধানকে হত্যা করার মতো এত বড় সিদ্ধান্ত কখনো নেয়নি ইসরায়েল।
রাইসির মৃত্যুতে নেতৃত্বের পরিবর্তনে ইরান ও ইসরায়েলের সঙ্গে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর সম্পর্কের গতিশীলতায় পরিবর্তন আসতে পারে বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র, ইসরায়েল ও সৌদি আরবসহ প্রতিপক্ষ দেশগুলো ইরানকে মোকাবিলা করতে এই সুযোগে নিজেদের নিরাপত্তা সম্পর্ক আরও গভীর করার কথা ভাবতে পারে।
ভারতের অবস্থান
ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইতোমধ্যে রাইসির মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন এবং এই ক্রান্তিলগ্নে ইরানের জনগণের পাশে দাঁড়ানোর অঙ্গীকার করেছেন।
'ভারত-ইরান দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক বলিষ্ঠ করায় তার অবদানকে আমরা সব সময় মনে রাখব', যোগ করেন মোদি।
এক সপ্তাহ আগেই ইরানের সঙ্গে চাবাহার বন্দর পরিচালনার চুক্তি করে ভারত। এই চুক্তির লক্ষ্য ছিল মধ্য এশিয়ার সঙ্গে দুই দেশের বাণিজ্য সম্প্রসারণ। ২০০৩ সালে প্রথমবারের মতো এই পরিকল্পনা করেছিল ভারত। কিন্তু মার্কিন বিধিনিষেধের কারণে এই উদ্যোগ স্তিমিত হয়ে পড়ে।
ইরানের সঙ্গে এই চুক্তিতে কড়া প্রতিক্রিয়া জানায় যুক্তরাষ্ট্র।
মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় হুশিয়ারি দেয়, এই প্রকল্পে যেসব ভারতীয় প্রতিষ্ঠান কাজ করবে, তাদেরকে নিষেধাজ্ঞার আওতায় আনা হতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র বেদান্ত প্যাটেল বলেন, 'ইরানের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা এখনো কার্যকর। এসব নিষেধাজ্ঞা আরও জোরদার করা হবে। যেসব পক্ষ ইরানের সঙ্গে ব্যবসায়িক চুক্তি করার কথা ভাবছে, তাদের সম্ভাব্য মার্কিন ঝুঁকির বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে।'
উল্লেখযোগ্য বিষয় হল, ইসরায়েলের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কও বেশ উষ্ণ। হামাসের হামলার পর তেল আবিব নয়াদিল্লির সমর্থনকে ধন্যবাদ জানায়।
Comments