ইউরোপিয়ান সোশ্যাল বিজনেস ট্যুরে প্রফেসর ইউনূস
অটোনমাস ইন্টেলিজেন্স, সামাজিক ক্রয়, সামাজিক উদ্যোক্তা ও প্যারিস অলিম্পিক আয়োজন চূড়ান্তকরণ নিয়ে বিভিন্ন পর্যায়ের আলোচনায় অংশ নিতে ইউরোপিয়ান সোশ্যাল বিজনেস ট্যুর করেছেন শান্তিতে নোবেলজয়ী প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস।
আজ রোববার ইউনূস সেন্টারের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, প্রফেসর ইউনূস ফাউন্ডেজিওন মিলানো কর্টিনা আয়োজিত 'মিট দ্য পার্টনারস' শীর্ষক সমাবেশে প্রধান অতিথি হিসেবে যোগদান করেন। মিলানো কর্টিনা শীতকালীন অলিম্পিক ২০২৬ এর উদ্যোগে ফাউন্ডাজিওন মিলানো কর্টিনা সুপরিচিত গ্লোবাল ব্র্যান্ডগুলোর সহযোগিতায় এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করে।
বৈঠকের উদ্দেশ্য ছিল শীতকালীন অলিম্পিক ২০২৬ এর সহযোগীদের কাছে এই সামাজিক অলিম্পিকের উদ্দেশ্য ও বিষয়বস্তু ব্যাখ্যা করা এবং তাদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেওয়া, যাতে তারা এই গেমসের সামগ্রিক সামাজিক লক্ষ্যগুলো পূরণের জন্য নিজেদের প্রস্তুত করতে পারে।
অনুষ্ঠানে অংশীদারদের মধ্যে ছিল ভিসা, স্যামসাং, রেন্সট্যাড ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠান। প্রফেসর ইউনূস সামাজিক ব্যবসার ধারণাটি বিশদভাবে তুলে ধরেন এবং এ সংশ্লিষ্ট বিষয় ব্যাখ্যা করেন।
এরপর প্যারিসে গ্রামীণ ক্রেডিট এগ্রিকোল ফাউন্ডেশনের প্রধান কার্যালয়ে প্রফেসর ইউনূসকে স্বাগত জানানো হয়। প্রফেসর ইউনূস এই প্রতিষ্ঠানটির প্রতিষ্ঠাতা ও সাবেক চেয়ারম্যান। ফাউন্ডেশনটির বিভিন্ন কার্যক্রমের অগ্রগতি পর্যালোচনা করেন প্রফেসর ইউনূস।
এ ছাড়া, গ্রামীণ ক্রেডিট এগ্রিকোল ফাউন্ডেশনের সহায়তায় 'ইউনূস ফ্রান্স' পরিচালিত সেনেগালের ডাকারে নবীন ইক্যুইটি প্রোগ্রামের অগ্রগতিও পর্যালোচনা করেন।
প্যারিসের মেয়র অ্যান হিদালগো প্রফেসর ইউনূসকে 'ইমপ্যাক্ট-২' সম্মেলনে বক্তব্য দেওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানান। 'ইমপ্যাক্ট-২' হলো ফরাসি ইনকিউবেটর 'ইনকো' ও প্যারিসের নগর সরকার আয়োজিত একটি বৈশ্বিক সম্মেলন। প্রফেসর ইউনূস শ্রোতাদের উদ্দেশে প্রযুক্তির সুযোগ ও ঝুঁকি বিষয়ে, বিশেষ করে দারিদ্র ও জলবায়ু সমস্যার সঙ্গে সম্পর্কিত বিষয়ে বক্তৃতা করেন।
প্যারিস সিটি হলে আয়োজিত 'ইমপ্যাক্ট-২' বার্ষিক সমাবেশে অংশ নেন এক হাজারের বেশি মানুষ। প্রফেসর ইউনূস এই সমাবেশে এআই-এর দ্রুত সম্প্রসারণের প্রেক্ষাপটে প্রযুক্তির ভবিষ্যৎ নিয়ে বক্তব্য রাখেন।
অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য রাখেন সেক্রেটারি অব স্টেট ফর দ্য ট্রেজারি (যুক্তরাজ্য) গ্যারেট ডেভিস, আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স ও জলবায়ু পরিবর্তন বিশেষজ্ঞ সাশা লুসিয়নি এবং অন্যান্যরা।
প্রফেসর ইউনূস তার বক্তব্যে প্রযুক্তিকে দুটি ভাগে বিভক্ত করার প্রস্তাব করেন। একটি হলো দ্রুত বিস্তার লাভকারী, অতি বুদ্ধিমান প্রযুক্তি, যা মানুষের নিয়ন্ত্রণে থাকে। এটিকে তিনি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স বলেন। অন্যটি হচ্ছে, যা আজ নেই কিন্তু সুচিন্তিতভাবে সৃষ্টি করা হবে অথবা ইচ্ছা না থাকা সত্ত্বেও ঘটনাচক্রে জন্ম লাভ করবে। যেটা মানুষের নিয়ন্ত্রণ থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত থাকবে। এই প্রযুক্তি কোনো মানব হস্তক্ষেপ, সাহায্য বা নির্দেশনা ছাড়াই স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নেবে, প্রযুক্তিকে ক্রমাগতভাবে উচ্চতর পর্যায়ে নিয়ে যাবে। তিনি প্রযুক্তির এই ভবিষ্যৎ শাখার নাম দিয়েছেন অটোনোমাস ইন্টেলিজেন্স। তিনি সতর্ক করে বলেন, 'এই প্রযুক্তির যাত্রা শুরু হলে পৃথিবীতে মানুষের অস্তিত্বের অবসান ঘটবে।'
প্রফেসর ইউনূস জানান, তার কাছে মূল ইস্যুটি প্রযুক্তির শক্তির সম্প্রসারণ বিষয়ক নয়, বরং প্রযুক্তির মাধ্যমে মানুষ কী অর্জন করতে চায় তা স্থির করা এবং প্রযুক্তিকে সেপথে নিয়ে যাওয়া। সে সিদ্ধান্ত নেওয়াটা খুবই জরুরি বিষয়। প্রযুক্তি দিয়ে মুহূর্তে সীমাহীন নির্দোষ মানুষকে হত্যা করা, নানাভাবে মানবসমাজকে তছনছ করে দেওয়া আমাদের উদ্দেশ্য হতে পারে না।
তিনি বলেন, 'বর্তমানে যে প্রযুক্তি আমাদের হাতে আছে তার সাহায্যে অনায়াসে আমরা দারিদ্র্য দূর করতে পারি, পৃথিবীকে রোগমুক্ত করতে পারি এবং প্রযুক্তিকে ব্যবহার করে বৈশ্বিক উষ্ণতা দূর করতে পারি। কিন্তু তা না করে প্রযুক্তিকে আমরা সীমাহীন মুনাফা উপার্জনের কাজে পরিচালনা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি এবং তাই করছি।'
তিনি আরও বলেন, 'সুপার টেকনোলজি তৈরি করে আমরা শুধু কিছু লোককে ক্রমাগতভাবে সীমাহীন সম্পদের অধিকারী হতে সাহায্য করছি, যখন সবার জন্য স্বাস্থ্যসেবা এবং বৈশ্বিক উষ্ণতার মতো সমস্যা ক্রমাগত উপেক্ষিত বা আরও খারাপ হচ্ছে। আমাদেরকে অবশ্যই আমাদের উদ্দেশ্যগুলোকে সঠিকভাবে সংজ্ঞায়িত করতে হবে এবং প্রযুক্তিকে সেভাবেই শক্তিশালী করতে হবে।'
প্রফেসর ইউনূসের ক্ষুদ্রঋণ ও সামাজিক ব্যবসার দীর্ঘদিনের অনুসারী বিএনপি পারিবাসের 'ইনক্লুসিভ ফাইন্যান্স অ্যান্ড রিলেশানস উইথ সিভিল সোসাইটি'র প্রধান ক্লডিয়া বেলির সঙ্গে একটি উচ্চপর্যায়ের আলোচনায় অংশ নেন। ক্লডিয়া ও তার দল প্রফেসর ইউনূসের কাছে সামাজিক উদ্যোক্তা, সামাজিক ক্রয়, নবীন ইক্যুইটির নানা বিষয়ে জানতে চান এবং ইউনূস ফ্রান্স ও বিএনপি পারিবাসের মধ্যকার নতুন অংশীদারিত্বের বিশদ বিবরণ নিয়ে আলোচনা করেন।
ল'রিয়ালের প্রধান কার্যালয়ে আয়োজিত একটি পৃথক বৈঠকে প্রফেসর ইউনূস মিসেস পলিন অ্যাভেনেল লাম এবং মিসেস লরা বারোসোর নেতৃত্বে পরিচালিত 'ল'রিয়াল ফান্ডস ফর উইমেন' টিমের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং ইউনূস ফ্রান্স পরিচালিত 'ডেগ না লা প্রোগ্রাম' নিয়ে আলোচনা করেন।
এই কর্মসূচির লক্ষ্য, সেনেগালের ডাকারে ২ হাজার ৫০০ নারীকে উদ্যোক্তা ও আর্থিক শিক্ষা দিয়ে সহায়তা করা এবং তাদের ব্যবসা প্রকল্পগুলোকে সমর্থন দেওয়া—যা বাংলাদেশে অধ্যাপক ইউনূসের সৃষ্ট নবীন উদ্যোক্তা মডেল দ্বারা অনুপ্রাণিত।
প্রফেসর ইউনূস এরপর 'সোশ্যাল টাইডস' আয়োজিত এক আলোচনা সভায় একদল তরুণ উদ্যোক্তার সঙ্গে আলোচনায় যোগ দেন। সোশ্যাল টাইডসের লক্ষ্য হলো আগ্রহী সামাজিক উদ্যোক্তাদের ক্ষমতায়ন করা যারা সামাজিক, পরিবেশগত বা সাংস্কৃতিক অভিঘাত রয়েছে এমন সব প্রকল্প তৈরি করছে। গুগল ফাউন্ডেশন সোশ্যাল টাইডসকে অর্থায়ন করছে।
প্রফেসর ইউনূস 'ইনকো' আয়োজিত অনুষ্ঠানে সামাজিক ব্যবসা নিয়ে আলোচনা করেন। 'ইনকো' একটি বিশ্বব্যাপী সংস্থা, যা ৫০টি দেশে পরিবেশগতভাবে টেকসই এবং সামাজিকভাবে দায়বদ্ধ একটি নতুন অর্থনীতি গড়ে তোলার কাজে নিবেদিত। সংস্থাটি ১১০টি প্রভাবশালী কোম্পানিতে বিনিয়োগ করেছে এবং বিশ্বব্যাপী ২ লাখ মানুষকে প্রশিক্ষণ দিয়েছে।
পরদিন প্রফেসর ইউনূস 'মাইক্রোফিউচার' নামে ফ্রান্স ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন উভয়ের সরকারি ও বেসরকারি অংশীজনদের একটি গোলটেবিল আলোচনার জন্য প্যারিসের দারিদ্র অধ্যুষিত এলাকা সেইন সেন্ট ডেনিসে যান। সেন্ট ডেনিসের প্রেসিডেন্ট স্টিফেন ট্রাউসেল, ভাইস প্রেসিডেন্ট মেলিসা ইউসুফ তাকে এলাকার প্রেসিডেন্টের সচিবালয়ে অভ্যর্থনা জানান।
সেইন সেন্ট ডেনিসের কর্মসংস্থান, ইনসারসন ও সামাজিক অর্থনীতি বিষয়ক ডেপুটি ডিরেক্টর ম্যাথিউ আলেসি তার জন্য এলাকার অর্থনৈতিক পরিস্থিতির ওপর একটি প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন। ইউরোপীয় ইউনিয়ন আন্তঃআঞ্চলিক তহবিল দ্বারা অর্থায়নকৃত 'মাইক্রোফিউচার' হলো ক্ষুদ্রঋণের ভবিষ্যৎ ও সর্বোত্তম অনুশীলনগুলো নিয়ে আলোচনার একটি বিশেষ উদ্যোগ।
প্রফেসর ইউনূস ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে তার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেন। তিনি বেকার তরুণদের জন্য ভেঞ্চার ক্যাপিটাল নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেন। সেন্ট ডেনিসের কোনো নাগরিক বেকার ভাতার ওপর নির্ভরশীল থাকবে না, তা নিশ্চিত করতে এবং এলাকাটিকে প্যারিসের 'বেকার ভাতামুক্ত এলাকায়' পরিণত করতে শ্রোতাদের উৎসাহিত করেন তিনি।
Comments