রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে ব্যবহার হচ্ছে উত্তর কোরিয়ার ক্ষেপণাস্ত্র, দাবি ইউক্রেনের

উত্তর কোরিয়ার স্বল্প-পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র হয়োসাং ১১। ফাইল ছবি: রয়টার্স
উত্তর কোরিয়ার স্বল্প-পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র হয়োসাং ১১। ফাইল ছবি: রয়টার্স

প্রায় আড়াই বছর ধরে চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এক নতুন দিকে মোড় নিয়েছে। সম্প্রতি ইউক্রেনের শহর খারকিভে একটি অস্বাভাবিক ক্ষেপণাস্ত্র আঘাত হানে। এক তরুণ ইউক্রেনীয় অস্ত্র পরিদর্শক দাবি করেছেন, এই ক্ষেপণাস্ত্র রাশিয়ায় নয়, বরং উত্তর কোরিয়ায় নির্মাণ হয়েছে।

আজ রোববার বিবিসি এই তথ্য জানিয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্র ও মিত্রদেশের আরোপিত বিধিনিষেধের কারণে বৈধভাবে উত্তর কোরিয়ার অন্য কোনো দেশের কাছে এ ধরনের অস্ত্র বিক্রির অনুমোদন নেই। এমন কী, এ ধরনের অস্ত্র নির্মাণের জন্য প্রয়োজনীয় সূক্ষ্ম ইলেকট্রনিক চিপ ও অন্যান্য সরঞ্জাম আমদানিরও কোনো (বৈধ) পথ নেই দেশটির হাতে।

২ জানুয়ারি খারকিভের সেই হামলার খবর পাওয়ার পর ইউক্রেনীয় অস্ত্র পরিদর্শক ক্রিস্টিনা কামিচুক দেশের সেনাবাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগ করেন। এক সপ্তাহের মধ্যে রাজধানী কিয়েভের একটি সুরক্ষিত অবস্থানে তিনি সেই ক্ষেপণাস্ত্রের অংশবিশেষের দেখা পান। 

তিনি এই ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবচ্ছেদ করেন এবং এর প্রতিটি অংশের ছবি তোলেন। প্রতিটি স্ক্রু ও তার নখের চেয়ে ছোট আকারের কম্পিউটার চিপেরও ছবি তোলেন তিনি।

ক্রিস্টিনা নিশ্চিত ছিলেন, এটি রুশ ক্ষেপণাস্ত্র নয়। তবে বিষয়টি প্রমাণ করা অত সহজ ছিল না।

ধাতু ও তারের জঙ্গলের মধ্যে ক্রিস্টিনা কোরীয় বর্ণমালার একটি বর্ণ খোদাই করা অবস্থায় দেখতে পান। এরপর তিনি দেখতে পান, এই ক্ষেপণাস্ত্রের বিভিন্ন অংশে ১১২ লেখা আছে, যা উত্তর কোরিয়ার ক্যালেন্ডার অনুযায়ী ২০২৩ সাল।

কিয়েভ থেকে তিনি বিবিসিকে টেলিফোনে জানান, 'আমরা শুনেছি তারা (উত্তর কোরিয়া) রাশিয়াকে কিছু অস্ত্র সরবরাহ করেছে, কিন্ত আমি এখন (সেরকম একটি অস্ত্র) দেখতে পাচ্ছি, পরীক্ষা করতে পারছি, যা এর আগে কেউ পারেনি। বিষয়টা খুবই উত্তেজনাকর।'

এই তথ্য প্রকাশের পর ইউক্রেনীয় সেনাবাহিনী দাবি করেছে, সাম্প্রতিক সময়ে রাশিয়া থেকে তাদের ভূখণ্ডে অসংখ্য উত্তর কোরীয় ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়া হয়েছে। এসব হামলায় অন্তত ২৪ জন নিহত ও ৭০ জনেরও বেশি মানুষ আহত হয়েছেন।

উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক যুদ্ধ শুরুর হুমকিকে খুব একটা গুরুত্ব না দিলেও বিশ্লেষকরা পিয়ংইয়ংয়ের অন্যান্য দেশের সংঘাতকে উসকে দেওয়ার সক্ষমতা নিয়ে হুশিয়ারি দিয়েছেন।

উত্তর কোরিয়ার অস্ত্রাগার পরিদর্শন করছেন দেশটির নেতা কিম জং উন। ছবি: উত্তর কোরিয়ার স্থানীয় গণমাধ্যম থেকে সংগৃহীত
উত্তর কোরিয়ার অস্ত্রাগার পরিদর্শন করছেন দেশটির নেতা কিম জং উন। ছবি: উত্তর কোরিয়ার স্থানীয় গণমাধ্যম থেকে সংগৃহীত

ক্রিস্টিনা কনফ্লিক্ট আর্মামেন্ট রিসার্চ (সিএআর) নামের একটি সংগঠনের কর্মী। এই সংগঠন যুদ্ধে ব্যবহৃত অস্ত্র নিয়ে গবেষণা করে থাকে।

ক্রিস্টিনার গবেষণায় বের হয়ে এসেছে কিছু চমকপ্রদ তথ্য।

তার ভাষ্য অনুযায়ী, এই তথাকথিত উত্তর কোরীয় ক্ষেপণাস্ত্রের বেশিরভাগ ইলেকট্রনিক উপকরণ যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে নির্মিত, এবং এতে গত ১/২ বছরের সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে। ২০২৩ এর মার্চে নির্মিত একটি মার্কিন কম্পিউটার চিপও এতে খুঁজে পাওয়ার দাবি করেছেন ক্রিস্টিনা।

এর অর্থ হল, উত্তর কোরিয়া অবৈধ ভাবে গুরুত্বপূর্ণ সরঞ্জাম জোগাড় করেছে, নিজেদের দেশে লুকিয়ে নিয়ে এসেছে এবং ক্ষেপণাস্ত্র নির্মাণ করে গোপনে সেগুলোকে রাশিয়ার কাছে পাঠিয়েছে। রাশিয়া এগুলোকে যুদ্ধক্ষেত্রে মোতায়েন করে ইউক্রেনের বিরুদ্ধে হামলায় ব্যবহার করেছে। এ সবই ঘটেছে কয়েক মাসের ব্যবধানে। 

সিএআরের উপ-পরিচালক ড্যামিয়েন স্পিটার্স বলেন, 'সবচেয়ে আজব ব্যাপার হল, প্রায় দুই দশকের বিধিনিষেধ সত্ত্বেও এসব অস্ত্র নির্মাণে প্রয়োজনীয় উপকরণ জোগাড় করেছে উত্তর কোরিয়া, এবং তা অবিশ্বাস্য দ্রুত গতিতে।'

লন্ডন ভিত্তিক বিশ্লেষণী সংস্থা রয়াল ইউনাইটেড সার্ভিসেস ইনস্টিটিউটের (রুসি) উত্তর কোরিয়া বিশেষজ্ঞ জোসেফ বিরনে এ বিষয়টিতে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন।

'আমি কখনো ভাবিনি আমরা উত্তর কোরীয় ব্যালিসটিক ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে ইউরোপীয় ভূখণ্ডে মানব হত্যার দৃশ্য দেখব', যোগ করেন তিনি।

তিনি ও তার সংগঠন রুসি গত বছরের সেপ্টেম্বরে কিম জং উন ও ভ্লাদিমির পুতিনের বৈঠকের পর থেকে দুই দেশের মধ্যে জাহাজ চলাচলের ওপর নজর রাখছেন।

স্যাটেলাইট থেকে পাওয়া ছবিতে জানা গেছে, চারটি রুশ পণ্যবাহী জাহাজ বেশ কয়েকবার উত্তর কোরিয়া ও একটি রুশ সামরিক বন্দরের মধ্যে আসা যাওয়া করেছে। প্রতি যাত্রায় 'শ এর ওপর কন্টেইনার আনা-নেওয়া করা হয়।

খারকিভের হামলায় ব্যবহৃত উত্তর কোরীয় ক্ষেপণাস্ত্রের ধ্বংসাবশেষ। ছবি: কনফ্লিক্ট আর্মামেন্ট রিসার্চের সৌজন্যে
খারকিভের হামলায় ব্যবহৃত উত্তর কোরীয় ক্ষেপণাস্ত্রের ধ্বংসাবশেষ। ছবি: কনফ্লিক্ট আর্মামেন্ট রিসার্চের সৌজন্যে

রুসি'র জানিয়েছে, অন্তত ১০ লাখ কামানের গোলা ও রকেট নিয়ে সাত হাজার কন্টেইনার উত্তর কোরিয়া থেকে রাশিয়ায় এসেছে। এ ধরনের রকেট ট্রাক থেকে একসঙ্গে অনেকগুলো করে ছোড়া যায়।

রুসির এই বিশ্লেষণে একমত প্রকাশ করেছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও দক্ষিণ কোরিয়া। তবে এ ধরনের বাণিজ্যের বিষয়টি অস্বীকার করেছে রাশিয়া ও উত্তর কোরিয়া উভয়ই। 

বিরনে বলেন, 'এসব রকেট ও কামানের গোলা এখন বিশ্বের সবচেয়ে দুর্লভ বস্তুর অন্যতম। এগুলো হাতে পেয়ে রাশিয়া ইউক্রেনীয় শহরগুলোতে হামলা অব্যাহত রেখেছে এবং এটা এমন সময় হচ্ছে যখন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ (ইউক্রেনকে) অস্ত্র দিয়ে সহায়তা দিতে হিমশিম খাচ্ছে।'

বিরনের মতে, যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যালিসটিক ক্ষেপণাস্ত্রের আগমনে গভীর উদ্বেগজনক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।

তবে অস্ত্র পরিদর্শক ক্রিস্টিনার দাবি, ২ জানুয়ারির হামলায় ব্যবহৃত ক্ষেপণাস্ত্রটি উত্তর কোরিয়ার সবচেয়ে অত্যাধুনিক স্বল্প-পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র। তার মতে, হোয়াসং ১১ নামের এই ব্যালিসটিক ক্ষেপণাস্ত্র ঊর্ধ্বে ৭০০ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে পারে।  

৮০র দশক থেকেই বিভিন্ন দেশ ও সংগঠনের কাছে অস্ত্র বিক্রি করে আসছে উত্তর কোরিয়া। তাদের অস্ত্র উত্তর আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্যের দেশ লিবিয়া, সিরিয়া ও ইরানে ব্যবহার হয়েছে। এমন কী হামাসের যোদ্ধারাও ৭ অক্টোবরের হামলায় কিছু রকেট-গ্রেনেড ব্যবহার করেছে বলে দাবি করা হয়েছে।

প্রথাগতভাবে, উত্তর কোরিয়ার অস্ত্র খুব একটা নির্ভরযোগ্য নয় বলেই সর্বজনবিদিত ধারণা।

তবে হোয়াসং ক্ষেপণাস্ত্রের কার্যকারিতা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই।

এই যুদ্ধে কিয়েভের মূল পৃষ্ঠপোষক যুক্তরাষ্ট্র তাদেরকে প্রয়োজন অনুযায়ী অস্ত্র-গোলাবারুদ দিতে হিমশিম খাচ্ছে। ইউরোপ ও অন্যান্য মিত্ররাও প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী অস্ত্র দিতে পারছে না। বিশ্লেষকদের অনুমান ছিল, কড়া বিধিনিষেধের কারণে রাশিয়া এই যুদ্ধ চালিয়ে যেতে সক্ষম হবে না—ফুরিয়ে যাবে অস্ত্র-গোলাবারুদ, সেনা সদস্যের সংখ্যাও কমতে থাকবে।

কিন্তু অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, উত্তর কোরিয়ার অস্ত্র পেয়ে আরও বিপুল বিক্রমে আগাচ্ছে রাশিয়া, আর অপরদিকে অস্ত্র-গোলাবারুদ চেয়ে মিত্রদের দরজায় কড়া নেড়ে চলেছেন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি। 

Comments

The Daily Star  | English

65% of suicide victims among students are teenagers: survey

At least 310 students from schools, colleges, universities and madrasas died by suicide last year

3h ago