ছাত্ররাজনীতির প্রথম শহীদ নজির আহমদ
বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসের সূচনাবিন্দু ধরা হয় ভাষা আন্দোলনকে। এই আন্দোলনে রাজনৈতিক অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে ছাত্রসমাজ রেখেছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা।
ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানেও ছাত্রদের দাপট ছিল রাজপথে। অভ্যুত্থানে যিনি প্রাণ দিয়ে পরিস্থিতিকে আরও জীবন্ত করে তুলেছিলেন—শহীদ আসাদ—তিনি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের ছাত্র। পরবর্তীতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধেও ছাত্রসমাজের ভূমিকা ছিল শীর্ষস্থানীয়।
কিন্তু স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররাজনীতি ধীরে ধীরে বিতর্কে রূপ নিয়েছে। ছাত্ররাজনীতি যত প্রকট আকার ধারণ করেছে, তত মান কমেছে পড়াশোনার। যেখানে ছাত্রদের রাজনীতির ফলে শিক্ষার্থীদের একাডেমিক পড়াশোনা, আবাসন ব্যবস্থা এবং অন্যান্য দরকারি বিষয়ে উন্নতির কথা ছিল, সেখানে হয়েছে ঠিক উল্টো।
ছাত্ররাজনীতির অতীত ইতিহাস এবং বাস্তবতার সঙ্গে মিল পাওয়া যায় সামান্যই। যে কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনীতি করা শিক্ষার্থীদের জন্য স্বস্তির জায়গা থেকে আতঙ্কে পরিণত হয়েছে। শহীদ আসাদের মৃত্যু যতটা গৌরবের, শহীদ আবরারের মৃত্যু ততটাই আক্ষেপ ও বেদনার।
বুয়েটের শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মধ্য দিয়ে আজ আবারও জেগে উঠেছে সেই পুরনো আলাপ—বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররাজনীতি শিক্ষার্থীদের জন্য কতটা সুখের আর কতটা বেদনার? স্বস্তি নাকি আতঙ্ক? সেই জায়গা থেকে একটু ঘুরে আসতে চাই পাকিস্তান আন্দোলনের সময়ে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে।
১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর থেকে লাহোর প্রস্তাবের আগ পর্যন্ত ছাত্র কিংবা শিক্ষকদের মধ্যে রাজনীতির তেমন প্রভাব ছিল না। কিন্তু লাহোর প্রস্তাবের পর হিন্দু ও মুসলমানের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সম্পূর্ণ আলাদা হয়ে গেলো—হিন্দুরা কংগ্রেসের অধীনে অখণ্ড ভারত আর মুসলমানরা মুসলিম লীগের অধীনে পাকিস্তান চাওয়া শুরু করেছে।
বাংলার গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হিসেবে ঢাকায় বসবাসকারী হিন্দু ও মুসলমানের মধ্যেও চলছিল বিপরীতধর্মী রাজনীতি। এই রাজনীতির প্রভাব সরাসরি বিস্তার লাভ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ও শিক্ষকদের মধ্যে। সাংগঠনিক কিংবা কাঠামোগত রাজনীতি তখনও প্রবেশ করেনি সত্য, কিন্তু সম্প্রদায়গত অসাংগঠনিক রাজনীতির উত্থান ঘটে গেছে চল্লিশের পরেই।
বাংলা বিভাগের শিক্ষক কবি জসীম উদ্দীন সারাদিন তার শয্যাপাশে ছিলেন। একজন শিক্ষক হিসেবে ছাত্রের প্রতি এমন কর্তব্যনিষ্ঠ আচরণ বর্তমানে স্বপ্নের মতো মনে হয়। যাই হোক! প্রথমবারের মতো বাংলার কোনো শিক্ষাঙ্গনে রাজনৈতিক কারণে শিক্ষার্থী নিহত হলেন। অমর হয়ে গেলেন শহীদ নজির আহমদ।
এভাবেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক ইতিহাসের সূচনা হয়। এই সূচনাবিন্দুতেই সংঘটিত হয় এমন অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা, যা সদ্য প্রবেশিত অভ্যন্তরীণ রাজনীতিকে স্থায়ী রূপদানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।
১৯৪৩ সালের জানুয়ারির শেষদিকে ছাত্রীদের একটি অনুষ্ঠানে 'বন্দে মাতরম' গাওয়া এবং পূজার্চনা বিধিকে কেন্দ্র করে হিন্দু এবং মুসলমান ছাত্রদের মধ্যে উত্তপ্ত পরিস্থিতি তৈরি হয়। পুরো বিশ্ববিদ্যালয়ের হিন্দু ও মুসলমান ছাত্ররা মোটাদাগে দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে।
ফেব্রুয়ারির ২ তারিখ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবন—বর্তমান ঢাকা মেডিকেল কলেজের পুরাতন ভবনে—ক্লাস চলছিল। পূর্বের ঘটনার জের ধরে ক্লাস চলাকালীন হিন্দু ও মুসলমান ছাত্রদের মধ্যে শুরু হলো সহিংসতা। লাঠিসোটা নিয়ে একদল আরেক দলের ওপর হামলা করে। বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে দুই দল আবির্ভূত হয় সম্মুখ সমরে। দুই দলেরই বেশ কিছু ছাত্র আহত হয়। মুসলিম ছাত্রনেতা নজির আহমদ প্রতিপক্ষের হামলায়, ছুরিকাঘাতে আহত হন। বন্ধুরা তাকে মিটফোর্ড হাসপাতালে ভর্তি করে এবং বিরতিহীন রক্তক্ষরণের ফলে মাগরিবের সময় তিনি ইন্তেকাল করেন।
বাংলা বিভাগের শিক্ষক কবি জসীম উদ্দীন সারাদিন তার শয্যাপাশে ছিলেন। একজন শিক্ষক হিসেবে ছাত্রের প্রতি এমন কর্তব্যনিষ্ঠ আচরণ বর্তমানে স্বপ্নের মতো মনে হয়। যাই হোক! প্রথমবারের মতো বাংলার কোনো শিক্ষাঙ্গনে রাজনৈতিক কারণে শিক্ষার্থী নিহত হলেন। অমর হয়ে গেলেন শহীদ নজির আহমদ।
নজির আহমদের মৃত্যুতে বিশ্ববিদ্যালয়ে হিন্দু-মুসলমান ছাত্রদের বিভেদ আরও বাড়লো, পরিস্থিতি হলো আরও উত্তপ্ত। নজির আহমদ ছিলেন সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের নেতৃস্থানীয় ছাত্র। অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক, সৈয়দ সাজ্জাদ হোসায়েনদের পাক্ষিক 'পাকিস্তান' পত্রিকার ম্যানেজার ছিলেন তিনি। তার মৃত্যুর পর 'পাকিস্তান' পত্রিকা আর প্রকাশ হয়নি। মুসলিম ছাত্রদের কাছে তিনি হয়ে গেলেন হিরো—আদর্শ অর্জনে ত্যাগের প্রতীক, পাকিস্তান আন্দোলনের প্রথম শহীদ। যে কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের মুসলিম ছাত্ররা '২ ফেব্রুয়ারি'কে শহীদ নজির দিবস হিসেবে ঘোষণা করে এবং ১৯৪৩ থেকে উদযাপন করা শুরু করে।
তৎকালীন ছাত্র রবীন্দ্রনাথ গুহ তার স্মৃতিকথায় লিখেছেন, 'এরপর কয়েক বছর মুসলিম বন্ধুরা শহীদ নজিরের স্মরণে সভা করেছে। প্রতি বছরই একমাত্র হিন্দু বক্তা ছিলাম আমি। তার জন্যও হিন্দু বন্ধুদের কাছে জবাবদিহি করতে হয়েছে।'
নিজেদের সহিংসতায় প্রাণ হারানো একজন সহপাঠীর স্মরণসভায় যোগদানের জন্যও স্বধর্মের বন্ধুদের কাছে জবাবদিহি করতে হচ্ছে রবীন্দ্রনাথ গুহের! এ থেকেই বোঝা যায়, হিন্দু-মুসলমান প্রশ্নে তৎকালীন ছাত্রদের মধ্যে কতটা ক্রোধের সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল।
১৯৪৪ সালে সৈয়দ আলী আহসানের সম্পাদনায় 'নজীর আহমদ' নামে একটি স্মারকগ্রন্থ প্রকাশিত হয়। উক্ত স্মারকগ্রন্থে আলী আহসানের তিনটি, সাজ্জাদ হোসায়েনের একটি, বেনজীর আহমদের একটি এবং অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাকের একটি প্রবন্ধ অন্তর্ভুক্ত হয়।
শহীদ নজিরের অন্তিমকালে তার শিয়রে থাকা কবি জসীম উদ্দীন একটি কবিতাও লিখেছিলেন। সৌভাগ্যবশত সৈয়দ আলী আহসানের আত্মজীবনীতে এই তথ্যগুলো পাওয়া গেলেও দুর্ভাগ্যবশত উক্ত স্মারকগ্রন্থটি ডুবে গেছে কালের গহীনে।
শহীদ নজিরের আত্মত্যাগকে স্মরণীয় করে রাখতে তার বন্ধুরা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন একটি লাইব্রেরিও। পুরান ঢাকার চকবাজারের উত্তর-পশ্চিম কোণে নাজিরা বাজারে একটি বিরাট আকারের পাবলিক লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা করা হয়। সেই লাইব্রেরিকে কেন্দ্র করে মুসলিম ছাত্ররা পাকিস্তান সংক্রান্ত আলাপ-আলোচনা পরিচালনা করতেন।
ভাষাসৈনিক আবদুল গফুরের সাক্ষ্য, '১৯৪৫ থেকে ১৯৪৭—এ দু'বছরের কলেজ জীবনে এসব রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি সাহিত্য-সংস্কৃতির অঙ্গনেও নিয়মিত অংশ নিয়েছি। এই উপলক্ষেই নাজিরা বাজারে "শহীদ নজির লাইব্রেরি"তে যেতাম পাকিস্তান আন্দোলনের পরিপোষক পুস্তক-পুস্তিকা ও সংবাদপত্র পাঠ ও আলোচনা সভায় যোগদানের উদ্দেশ্যে।'
বলা চলে, শহীদ নজির আহমদ মুসলিম ছাত্রদের কাছে রাজনৈতিক আশা ও আকাঙ্ক্ষার প্রতীক হিসেবে বিরাজ করছিলেন। ঐতিহাসিক তথ্য উপাত্ত থেকেই আমরা দেখছি, তাকে কেন্দ্র করেই মূলত আবর্তিত হচ্ছে মুসলিম ছাত্রদের রাজনৈতিক কার্যক্রম।
'বন্দে মাতরম' সংগীত নিয়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে হিন্দু-মুসলমান ছাত্রদের মধ্যে যে রাজনীতির সূচনা হয়েছিল, তিরিশের দশকে তা চল্লিশের দশকে আমদানি হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ছাত্র রাজনীতির উত্থানের সঙ্গে সঙ্গেই সহপাঠীদের হাতেই নিহত হলেন নজির আহমদ।
দেখা যাচ্ছে, বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনৈতিক আধিপত্য বিস্তারের আগের এবং পরের পরিবেশে বিস্তর ফারাক। তিরিশের দশকে যেখানে ছাত্রদের মধ্যে হিন্দু ও মুসলমান বলে তেমন কোনো বিভেদ ছিল না, সেখানে চল্লিশের দশকে ছাত্রদের মধ্যে হিন্দু ও মুসলমানই হয়ে দাঁড়িয়েছে প্রধান পরিচয় ও বাধা।
কেবল হিন্দু-মুসলমান নয়, বরং যেকোনো রাজনৈতিক পরিচয় যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের আঙিনায় আধিপত্য বিস্তার করবে এবং সহিংস হয়ে উঠবে, তখনই পরিস্থিতি এমন প্রাণনাশী হয়ে উঠবে।
রাজনীতি প্রবেশের একেবারে সূচনাতেই নজির আহমদ জীবন দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছেন যে বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র রাজনীতির সুফলের চেয়ে কুফলই প্রকারান্তরে বেশি। পড়াশোনার জায়গা দখল করে মিছিল-মিটিং, নোটের জায়গা দখল করে লিফলেট, রেজাল্টের প্রতিযোগিতার বদলে প্রতিযোগিতা হয় পদের, পদলেহনের। এভাবেই একটি বিশ্ববিদ্যালয় তার মূল লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য থেকে সম্পূর্ণ বিপরীত পথে হাঁটতে থাকে, যখন সে নুয়ে পড়ে রাজনৈতিক আধিপত্যের চাপে।
বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র রাজনীতির প্রথম শহীদ নজির আহমদের আত্মত্যাগের পুনর্মূল্যায়নের সময় এসেছে। তিনি জীবন দিলেন, কিন্তু আমরা শিক্ষা নিলাম না—বরং উল্টো পথে হাঁটলাম। এই হাঁটার পরিণতি কতটা ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে, তা স্বচক্ষে দেখতে পাচ্ছি আমরা। শহীদ নজির আহমদকে স্মরণ করে শিক্ষা নিতে হবে, যেন তার উত্তরসূরির পথ আর লম্বা না হয়।
তথ্যসূত্র হিসেবে ব্যবহৃত:
১. এ. কে. নাজমুল করিম স্মারকগ্রন্থ: অধ্যাপক মুহাম্মদ আফসার উদ্দীন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ২০০০
২. East Pakistan District Gazetteers Dacca: S. N. H. Rizvi, East Pakistan Govt Press, 1969
৩. জীবনের শিলান্যাস: সৈয়দ আলী আহসান, বাড কম্প্রিন্ট এন্ড পাবলিকেশন্স, ২০১৮
৪. বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক আন্দোলন: সাঈদ-উর রহমান, অনন্যা প্রকাশনী, ২০০১
Comments