‘বুয়েটকে বুঝতে হবে, শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মতামতকে শ্রদ্ধা করতে হবে’

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতি থাকবে কি থাকবে না, এই বিষয়টিকে কেন্দ্র করে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগ এবং বুয়েটের আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের মুখোমুখি অবস্থান কর্মসূচি নিয়ে আলোচনার মধ্যে ২০১৯ সালে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করে যে প্রজ্ঞাপনটি দিয়েছিল বুয়েট কর্তৃপক্ষ, তা স্থগিত করেছেন হাইকোর্ট।

এক রিট আবেদনের শুনানি শেষে বিচারপতি মো. খসরুজ্জামান ও বিচারপতি কে এম জাহিদ সারওয়ারের হাইকোর্ট বেঞ্চ আজ সোমবার দুপুরে এই আদেশ দেন।

এর আগে সকালে ছাত্ররাজনীতির বিপক্ষে বুয়েটের সাধারণ শিক্ষার্থীদের অবস্থান, ওই অবস্থানের বিরুদ্ধে ছাত্রলীগের তৎপরতা ও ক্ষমতাসীন দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের বক্তব্য নিয়ে দ্য ডেইলি স্টার কথা বলে বুয়েটের প্রাক্তন তিন শিক্ষার্থীর সঙ্গে। তারা হলেন—বুয়েটের সাবেক শিক্ষক ও ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক আইনুন নিশাত, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন স্থপতি রফিক আজম এবং তথ্যপ্রযুক্তিবিদ জাকারিয়া স্বপন

এ বিষয়ে আইনুন নিশাত বলেন, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য নতুন অধ্যাদেশ করে শিক্ষকদের রাজনীতি ইত্যাদির অনুমতি দেওয়া হয়। কিন্তু কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ও বুয়েটের জন্য অধ্যাদেশের খসড়া যখন বঙ্গবন্ধুর সামনে উপস্থাপন করা হয়, তখন তিনি বলেছিলেন যে এই দুটো বিশ্ববিদ্যালয় নষ্ট করা চলবে না।

বুয়েটের সাবেক এই শিক্ষকের ভাষ্য, 'খসড়া অর্ডিন্যান্স বঙ্গবন্ধু ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। বুয়েটের শিক্ষকরা তার সঙ্গে দেখা করার চেষ্টা করেছিলেন। এই এজেন্ডাতে তিনি দেখা করতে রাজি হননি। তখন শিক্ষকরা কথা বলতেন তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী ইউসুফ আলীর সঙ্গে।'

আইনুন নিশাত বলেন, 'বুয়েটের চরিত্র আলাদা। এটা আলাদাভাবে রিকগনাইজ করতে হবে। এর পড়াশোনার ধরন আলাদা। আমি সেখানে পড়েছি, পড়িয়েছিও। এখানে যারা ঠিকমতো পড়াশোনা করে, তাদের দম ফেলার সময় থাকে না। কাজেই এখানে শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের মতের ভিত্তিতেই বলা হয়েছিল যে আমরা এখানে রাজনীতি চাই না। সেটাকে পরিবর্তন করার কোনো কারণ হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয় তো ভালোই চলছে। তাহলে সরকার যে এখানে হস্তক্ষেপ করে গোলমাল করছে সেটা তো ঠিক না।'

যে কথা বলা হচ্ছে যে তারা সব জঙ্গি হয়ে যাচ্ছে—এমন দু-চারটা শিক্ষার্থী সবসময়ই থাকে। তাদের সংখ্যা খুব কম। আছে—অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। তাই বলে সবাইকে সেই কাতারে ফেলা যাবে না। তাহলে সরকারের ইন্টেলিজেন্স কী করে? স্পেশাল ব্রাঞ্চ, ডিজিএফআই, এনএসআই কী করে? যে সন্ত্রাসী তাকে ধরে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যায়।

বুয়েটের সাবেক শিক্ষক ও ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক আইনুন নিশাত

এই শিক্ষাবিদ আরও বলেন, 'বুয়েট ভালো চলছে, পড়াশোনা হয়, এর গ্রাজুয়েটদের দেশে-বিদেশে সুনাম আছে। ঢাকা কিংবা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় যে খারাপ, সেটা বলছি না। সেখানে পরীক্ষা পদ্ধতিতে কিছু গোলমাল আছে, ফিক্স প্রশ্ন আছে। বুয়েটে পুরো পদ্ধতিটাই অন্যরকম, পরিবেশ অন্যরকম, চরিত্রটাই ভিন্ন। এটা না বুঝে যদি ইন্টারফেয়ার করা হয় তাহলে সেটা দুঃখজনক ব্যাপার।'

'বুয়েট তো সরকার চালায় না। চালান শিক্ষকরা। শিক্ষকরা যদি পছন্দ না করেন, শিক্ষার্থীরা যদি পছন্দ না করেন তাহলে কেন রাজনীতি চালু করতে হবে। আর যে কথা বলা হচ্ছে যে তারা সব জঙ্গি হয়ে যাচ্ছে—এমন দু-চারটা শিক্ষার্থী সবসময়ই থাকে। তাদের সংখ্যা খুব কম। আছে—অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। তাই বলে সবাইকে সেই কাতারে ফেলা যাবে না। তাহলে সরকারের ইন্টেলিজেন্স কী করে? স্পেশাল ব্রাঞ্চ, ডিজিএফআই, এনএসআই কী করে? যে সন্ত্রাসী তাকে ধরে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যায়।'

২৫ বছর আগে বুয়েট ছেড়ে আসা আইনুন নিশাতের অভিমত, 'বুয়েটে এক সময় বহু ছেলে তাবলীগ করত। এখন সেটাও কমে গেছে। এটা দৃশ্যমান। ২৫ বছর আগে কয়টা জামায়াতের সমর্থক ছিল বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সেটা জানত। সারা বিশ্ববিদ্যালয়ে হয়তো ২৫-৩০ জনের বেশি ছিল না। তাই নিরীহ শিক্ষার্থী; যারা পড়াশোনা ছাড়া অন্যকিছু বোঝে না, তাদের জামাতি নাম দিলে খারাপ প্রতিক্রিয়াই হবে।'

বুয়েটের পরিবেশ সুষ্ঠু হোক, পড়াশোনা প্রাধান্য পাক। এটা করতে করতে এখানে রাজনীতি কীভাবে হওয়া উচিত সে ব্যাপারে কথাবার্তা হোক, চর্চা হোক। এই ধারা মেনে যদি এখানে রাজনীতির সুষ্ঠু ধারা তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে, তখন এখানে রাজনীতি হতে পারে।'

স্থপতি রফিক আজম

এ বিষয়ে স্থপতি রফিক আজমের বক্তব্য, 'রাজনীতি আর সুস্থ জায়গায় নেই এখন। এটা নিয়ে আমরা চিন্তিত। কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে রাজনীতি থাকবে না, এটা আমি মনে করি না। কিন্তু অন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে যে রাজনীতির চর্চা হচ্ছে, সেটাও তো একদম সঠিক না।'

তিনি বলেন, 'সুতরাং আমি মনে করি যে বুয়েটের পরিবেশ সুষ্ঠু হোক, পড়াশোনা প্রাধান্য পাক। এটা করতে করতে এখানে রাজনীতি কীভাবে হওয়া উচিত সে ব্যাপারে কথাবার্তা হোক, চর্চা হোক। এই ধারা মেনে যদি এখানে রাজনীতির সুষ্ঠু ধারা তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে, তখন এখানে রাজনীতি হতে পারে।'

রফিক আজম বলেন, 'আমি মনে করি আমাদের দেশের রাজনীতি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো নষ্ট করছে। এটা অবশ্যই রাজনৈতিক ব্যর্থতা। তাই বুয়েটে যতক্ষণ সুষ্ঠু পরিবেশ তৈরি না হয়, ততক্ষণ রাজনীতি নিয়ে ভাবারও দরকার আছে।'

বুয়েটে ছাত্ররাজনীতি চালুর পক্ষে ছাত্রলীগের অবস্থান প্রসঙ্গে এই স্থপতির বক্তব্য, 'শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ঠিক কী ধরনের রাজনীতির চর্চা হবে সেটা রাজনীতিবিদদেরই ঠিক করা উচিত। সেই জায়গায় যেহেতু ঝামেলা আছে তাই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের রাজনীতিকে আমি ভয় পাই। কিন্তু যৌক্তিকভাবে ভাবলে, এটা সঠিকভাবে থাকা উচিত ছিল।'

বুয়েট শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে হিজবুত তাহরীরের মতো নিষিদ্ধ সংগঠনের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ প্রসঙ্গে রফিক আজম বলেন, 'বুয়েটে যে জঙ্গিবাদী চর্চার কথা বলা হচ্ছে, সে ব্যাপারে সরকার আগে থেকেই নজর রাখতে পারত। তাতে কোনো অসুবিধা ছিল না। কিন্তু এভাবে কথার মারপ্যাঁচে ফেলে বিষয়টাকে আরও কলুষিত করা হচ্ছে।'

তিনি বলেন, 'সরকার যদি এমন কথা বলতে থাকে, তাহলে মানুষ দূর থেকে ভাববে যে বুয়েটটাও শেষ হয়ে গেল। এটা তাহলে সরকারেরই ব্যর্থতা। সরকারের উচিত এটা বলা যে, "আমরা দেখছি বিষয়টা কী হচ্ছে"। আর শিক্ষার্থীরা যেহেতু রাজনীতির বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে, তাদের কথাটাও সরকারের মনোযোগ দিয়ে শোনা উচিত। সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করা উচিত।'

এমন পরিস্থিতিতে বুয়েটের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করে রফিক আজম বলেন, 'এমন অবস্থা চলতে থাকলে বুয়েট আস্তে আস্তে ভেঙে যাবে। হয়তো আমরা ১০ বছর পর দেখতে পাব, বুয়েট আর বুয়েট নেই। অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মতো এখানেও রোজ মারামারি হচ্ছে, কোন্দল হচ্ছে।'

এই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে বাংলাদেশের অন্য দশটা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে মেলালে হবে না। তাহলে ওই প্রতিষ্ঠানটাকে নষ্ট করা হবে। এ ক্ষেত্রে তাদের আবেগটাকেও বুঝতে হবে।

তথ্যপ্রযুক্তিবিদ জাকারিয়া স্বপন

তথ্যপ্রযুক্তিবিদ জাকারিয়া স্বপনের ভাষ্য, 'আমি বুয়েটে পড়েছি, বুয়েটকে যেভাবে দেখি এবং বুয়েটের সঙ্গে যে সম্পর্ক আমার আছে, তাতে বুয়েটকে একটু অন্যভাবে দেখতে হবে। কারণ এখানে বাংলাদেশের সবচেয়ে মেধাবী ছেলেমেয়েরা যায়।'

এই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে বাংলাদেশের অন্য দশটা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে মেলালে হবে না মন্তব্য করে এই লেখক বলেন, 'তাহলে ওই প্রতিষ্ঠানটাকে নষ্ট করা হবে। এ ক্ষেত্রে তাদের আবেগটাকেও বুঝতে হবে।'

তিনি বলেন, 'সেখানে গিয়ে আমরা যেভাবে চড়াও হচ্ছি, ঢালাওভাবে বলা হচ্ছে ছাত্র রাজনীতি দিয়ে দিলেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে—বুয়েট কিন্তু এরকম না। বুয়েটকে হ্যান্ডেল করতে হলে বুয়েটকে বুঝতে হবে। শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মতামতকে শ্রদ্ধা করতে হবে।'

Comments

The Daily Star  | English

Leather legacy fades

As the sun dipped below the horizon on Eid-ul-Azha, the narrow rural roads of Kalidasgati stirred with life. Mini-trucks and auto-vans rolled into the village, laden with the pungent, freshly flayed cowhides of the day’s ritual sacrifices.

17h ago