এনআরবিসি ব্যাংকের ৪ শীর্ষ কর্তার মধ্যাহ্নভোজে ২০ প্লেট ভাত, ১১৮ প্লেট তরকারি!
অর্থপাচার, ঋণ অনিয়ম, অতিরিক্ত ব্যয় ও নিয়োগ সংক্রান্ত অনিয়মের অভিযোগে প্রায়ই খবরের শিরোনাম হয় এনআরবিসি ব্যাংক। ৭০০ কোটি টাকার ঋণ কেলেঙ্কারির অভিযোগে ২০১৭ সালে ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দেওয়া ও তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক দেওয়ান মুজিবুর রহমানকে অপসারণে হস্তক্ষেপ করতে হয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংককে।
তৎকালীন চেয়ারম্যান ফরাসত আলীকে বোর্ড থেকে পদত্যাগ করতে হয়। মুজিব ও ফরাসতকে পরিচালক পদ থেকে দুই বছরের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক নিষিদ্ধ করে এবং পরবর্তীকালে বোর্ড পুনর্গঠন করা হয়।
কিন্তু নতুন পর্ষদে চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পেয়েছেন এমন একজন, যার বিরুদ্ধে আগেই অনিয়মের অভিযোগ উঠেছিল এবং ব্যাংকটিতে এখনো অনিয়ম অব্যাহত আছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
ব্যাংকটির সভার কার্যবিবরণী এবং অভ্যন্তরীণ তদন্ত প্রতিবেদন, ব্যাংক স্টেটমেন্ট, বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন ও সুপ্রিম কোর্টের নথির শত শত পৃষ্ঠা গত ছয় মাস ধরে বিশ্লেষণ করে দ্য ডেইলি স্টার ব্যাংকটির অভ্যন্তরীণ অসংখ্য অনিয়ম, এমনকি অস্ত্র দিয়ে ভীতি সৃষ্টির করার মতো ঘটনার বিষয়েও জানতে পেরেছে।
চার পর্বের ধারাবাহিক প্রতিবেদনের শেষ পর্বে তুলে ধরা হলো এনআরবিসির ব্যবস্থাপনার শীর্ষ কর্তাদের খাবারের প্রবল রুচির তথ্য। তাদের খাবারের বিল দেখে বোঝা কঠিন যে, অফিস মিটিং চলাকালীন কেউ কীভাবে এত খাবার খেতে পারে।
এনআরবিসি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনার শীর্ষ কর্মকর্তাদের খাবারের রুচি প্রবল।
চার কর্মকর্তার উপস্থিতিতে ২০১৬ সালের ২৪ অক্টোবর এনআরবিসি ব্যাংক পর্ষদের নির্বাহী কমিটির ৫৬তম সভা অনুষ্ঠিত হয়। ওই চারজন হলেন নির্বাহী কমিটির তৎকালীন চেয়ারম্যান মো. মঞ্জুরুল ইসলাম, তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক দেওয়ান মুজিবুর রহমান এবং পরিচালনা পর্ষদের তৎকালীন সদস্য ফরাছত আলী ও লকিয়ত উল্লাহ।
দ্য ডেইলি স্টারের হাতে আসা বিলের কপি অনুযায়ী, গুলশানের কস্তুরী গার্ডেনে এই চার জনের মধ্যাহ্নভোজের জন্য ব্যাংকের খরচ হয়েছে ৪১ হাজার ৯১ টাকা।
বিলে ২০ প্লেট ভাত ও ১১৮ প্লেট তরকারির কথা উল্লেখ করা হয়েছে, যার মধ্যে আছে—১৮ প্লেট ফুল চিকেন ভুনা, ১৮ প্লেট চিতল কোফতা, ১৭ প্লেট গরুর মাংসের আচারি কারি, ১৬ প্লেট টাকি মাছের ভর্তা, ১৭ প্লেট বাতাশি মাছের কারি, ১৭ প্লেট মিক্সড সবজি ও ১৫ প্লেট ডাল।
বিলে দুই ক্রেট পানির বোতল ও ২০ বোতল কোকও ছিল। ওই চার জনের গাড়িচালক এই ভোজে অংশ নেননি এবং দুপুরের খাবারের জন্য তাদের প্রত্যেককে ৩০০ টাকা করে দেওয়া হয়।
তাদের মধ্যাহ্নভোজ বাবদ করা এই খরচ বিধিমালা বহির্ভূত, যেহেতু নির্বাহী কমিটির সভায় যোগদানের জন্য পরিচালকরা নিয়মিত ফি ছাড়া অন্য কোনো আর্থিক বা কোনো ধরনের সুবিধা নিতে পারেন না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তদন্তে দেখা গেছে, চার মাস পর ২০১৭ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি কার্যনির্বাহী কমিটির ৬১তম সভা অনুষ্ঠিত হয় এবং তখন আটজনের মধ্যাহ্নভোজে ৪৮ হাজার ৬৯১ টাকা খরচ হয়। তাদের খাবারের তালিকায় ছিল ১৬ প্লেট করে ইলিশ, চিংড়ি কারি, মাটন কড়াই, চিংড়ি ভর্তা ও ডাল এবং ১৭ প্লেট করে রূপচাঁদা, বাটার চিকেন ও ভাত।
সভায় সদস্যদের ফি, রিফ্রেশমেন্ট ও অন্যান্য আনুষঙ্গিক খরচসহ নির্ধারিত মোট বাজেটের চেয়ে ৪৫ হাজার ৬৭০ টাকা বেশি ব্যয় করা হয়।
এক মাস পর কার্যনির্বাহী কমিটির ৬২তম সভায় থাকা আট জনের মধ্যাহ্নভোজে ব্যয় হয় ৬৭ হাজার ১৩৭ টাকা।
ভাউচারে দেখা গেছে, কার্যনির্বাহী কমিটির ৬১ ও ৬২তম বৈঠকে বাংলাদেশ ব্যাংকের পর্যবেক্ষক মো. মাসুদ বিশ্বাসও উপস্থিত ছিলেন।
২০১৭ সালের ১৮ জুন ৫৫তম বোর্ড সভায় মধ্যাহ্নভোজের আয়োজন না করা হলেও সভায় উপস্থিত নয় সদস্য ৩৫ ঝুড়ি ফল পেয়েছেন, যার মূল্য দুই লাখ টাকার বেশি বলে বিলের কপি থেকে জানা গেছে।
রমজান মাসেও তাদের খাবারের পরিমাণ কমেনি।
২০১৯ সালের ২৮ মে পরিচালনা পর্ষদের ৮১তম সভায় অংশ নেওয়া আট পরিচালক নেন ইফতারের ৬০টি বক্স। বিল কপিতে দেখা গেছে, এর জন্য খরচ হয়েছে ৬২ হাজার ১০০ টাকা।
২০১৮ সালের ১২ ডিসেম্বর পরিচালনা পর্ষদের ৭৫তম সভা ও কার্যনির্বাহী কমিটির ৮০তম সভায় ১১ জনকে 'খাওয়াতে' ব্যয় হয় এক লাখ ১৬ হাজার ৫২৫ টাকা। রসিদে দেখা যায়, উপস্থিত ১১ জনের পরিবর্তে ৩৭ জনের জন্য দুপুরের খাবারের বিল করা হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি অ্যান্ড কাস্টমার সার্ভিসেস ডিপার্টমেন্টের (এফআইসিএসডি) এক তদন্তে ২০১৩ সাল থেকে ২০টি ব্যয়ের রেকর্ড পর্যালোচনা করে বলা হয়েছে, এসব ক্ষেত্রে ব্যাংকিং কোম্পানি আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন হয়েছে।
আইনে বলা হয়েছে, 'ব্যাংকের নির্বাহী বোর্ডের সভায় অংশগ্রহণের জন্য নিয়মিত ফি ব্যতীত কোনো ব্যাংক পরিচালক ব্যাংক থেকে কোনো আর্থিক বা অন্য কোনো সুবিধা গ্রহণ করতে পারবেন না।'
২০১৭ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত সময়ে ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ও কার্যনির্বাহী কমিটির আরও ১৩টি সভার ব্যয়ের তালিকা দেখেছে ডেইলি স্টার। সেগুলোর সবগুলোতেই খাবার বাবদ বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করতে দেখা গেছে।
'এই ধরনের উচ্চ ব্যয় আমানতকারীদের জন্য ক্ষতিকারক' উল্লেখ করে এফআইসিএসডি নিয়ন্ত্রণ ও নীতি বিভাগকে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ করেছে।
বিষয়টি নিয়ে এনআরবিসি ব্যাংকের চেয়ারম্যান তমাল পারভেজ, কয়েকটি সভা যার সভাপতিত্বে হয়, বলেন, এটি ব্যাংকের ঐতিহ্য।
তিনি বলেন, 'অন্যান্য ব্যাংকের খবর নিয়ে দেখুন, দেখবেন তারা লাখ লাখ টাকা খরচ করছে। এক্ষেত্রে আমার ব্যাংক সর্বনিম্ন অর্থ ব্যয় করে।'
'আমি এই বিষয়ে ব্যবস্থা নিয়েছি এবং নির্দেশ দিয়েছি যাতে বোর্ড সভা চলাকালীন ১২ জন বোর্ড সদস্য ও অন্যান্য তিনজনসহ সর্বোচ্চ ১৫ জনের জন্য খাবারের আয়োজন করা হয়', বলেন তমাল পারভেজ।
Comments