এনআরবিসি ব্যাংক: কিছু কর্মকর্তার জন্য সন্দেহজনক পুরস্কার
অর্থপাচার, ঋণ অনিয়ম, অতিরিক্ত ব্যয় ও নিয়োগ সংক্রান্ত অনিয়মের অভিযোগে প্রায়ই খবরের শিরোনাম হয় এনআরবিসি ব্যাংক। ৭০০ কোটি টাকার ঋণ কেলেঙ্কারির অভিযোগে ২০১৭ সালে ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দেওয়া ও তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক দেওয়ান মুজিবুর রহমানকে অপসারণে হস্তক্ষেপ করতে হয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংককে।
তৎকালীন চেয়ারম্যান ফরাসত আলীকে বোর্ড থেকে পদত্যাগ করতে হয়। মুজিব ও ফরাসতকে পরিচালক পদ থেকে দুই বছরের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক নিষিদ্ধ করে এবং পরবর্তীকালে বোর্ড পুনর্গঠন করা হয়।
কিন্তু নতুন পর্ষদে চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পেয়েছেন এমন একজন, যার বিরুদ্ধে আগেই অনিয়মের অভিযোগ উঠেছিল এবং ব্যাংকটিতে এখনো অনিয়ম অব্যাহত আছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
ব্যাংকটির সভার কার্যবিবরণী এবং অভ্যন্তরীণ তদন্ত প্রতিবেদন, ব্যাংক স্টেটমেন্ট, বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন ও সুপ্রিম কোর্টের নথির শত শত পৃষ্ঠা গত ছয় মাস ধরে বিশ্লেষণ করে দ্য ডেইলি স্টার ব্যাংকটির অভ্যন্তরীণ অসংখ্য অনিয়ম, এমনকি অস্ত্র দিয়ে ভীতি সৃষ্টির করার মতো ঘটনার বিষয়েও জানতে পেরেছে।
চার পর্বের ধারাবাহিক প্রতিবেদনের তৃতীয় পর্বে তুলে ধরা হলো কীভাবে ব্যাংকটি কেন্দ্রীয় ব্যাংক এবং নিজেদের মানবসম্পদ নীতি লঙ্ঘন করে তাদের ২৭ কর্মকর্তার বেতন অস্বাভাবিক বৃদ্ধি করেছিল।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এক তদন্তে দেখা গেছে, দেশের ব্যাংকিং নিয়মের পাশাপাশি এনআরবিসি ব্যাংকের নিজস্ব মানবসম্পদ নীতিরও লঙ্ঘন করে ২০২২ সালে ব্যাংকটির অন্তত ২৭ জন কর্মীর বেতন বাড়ানো হয়েছে বিস্ময়কর পরিমাণে। কিছু ক্ষেত্রে ৭৫ শতাংশ পর্যন্তও বেড়েছে বেতন।
২০২২ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি এনআরবিসি ব্যাংকের একটি অফিস আদেশ অনুযায়ী, তিনজন সিনিয়র কর্মকর্তাকে একবারে ১৩টি পর্যন্ত ইনক্রিমেন্ট দেওয়া হয়েছিল।
দুই উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালকের বেতন বাড়ানো হয়েছে এক লাখ ২৫ হাজার টাকা থেকে এক লাখ ৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত, যা তাদের মূল বেতনের প্রায় ৬০ শতাংশ বেশি। অন্তত ১০ জন কর্মকর্তার বেতন ৫০ থেকে ৭৫ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে এবং বাকিদের বেড়েছে ১৮ থেকে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত।
এনআরবিসির অফিস আদেশে এই ২৭ জনের মোটা অংকের বেতন বৃদ্ধিকে 'ব্যাংকের লক্ষ্য অর্জনে ব্যতিক্রমী অবদান' হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে।
কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকের ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি অ্যান্ড কাস্টমার সার্ভিসেস ডিপার্টমেন্টের (এফআইসিএসডি) এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এ ধরনের ইনক্রিমেন্ট ব্যাংকিং আইনের পাশাপাশি এনআরবিসির নিজস্ব মানবসম্পদ নীতিমালারও লঙ্ঘন।
ব্যাংকটির নীতিমালার বরাত দিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, 'কর্তৃপক্ষ একজন কর্মীকে (প্রতি বছর) সর্বোচ্চ তিনটি ইনক্রিমেন্ট দিতে পারে।'
সেই সময়ে ব্যাংকটির মোট ৩ হাজার ৮০০ কর্মী ছিল।
ব্যাংকিং রেগুলেশন অ্যান্ড পলিসি ডিপার্টমেন্টের এক সার্কুলার অনুযায়ী, ইনক্রিমেন্ট অবশ্যই প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের মাঝে সর্বজনীনভাবে দেওয়া উচিত, নির্বাচিত কয়েকজনের জন্য নয়।
ওই ২৭ কর্মকর্তার ইনক্রিমেন্ট পরে প্রত্যাহার করা হয়। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক উল্লেখ করেছে যে 'এই অনিয়মের জন্য স্পষ্টভাবে ক্ষমতার অপব্যবহার করার পরও ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।'
দ্য ডেইলি স্টারের হাতে থাকা নথি থেকে এটা স্পষ্ট হয়েছে যে এই 'ব্যতিক্রমী অবদান' রাখা কর্মকর্তাদের মধ্যে অন্তত দু-একজন কীভাবে অনিয়মের সঙ্গে উল্লেখযোগ্যভাবে জড়িত ছিলেন।
তাদের একজন এনআরবিসি ব্যাংকের ক্রেডিট কার্ড ও ওভারড্রাফট (ওডি) অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচারে জড়িত ছিলেন।
তিনি হলেন ভাইস প্রেসিডেন্ট ও ব্যাংকের আর্থিক প্রশাসন বিভাগের প্রধান মো. জাফর ইকবাল হাওলাদার। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে তার বেতন ৩৯ শতাংশ বেড়ে এক লাখ চার হাজার টাকা থেকে এক লাখ ৪৪ হাজার ৬০০ টাকা হয়। যদিও সিদ্ধান্তটি পরবর্তীতে প্রত্যাহার করা হয়েছিল।
'অবদান'
বাংলাদেশ ব্যাংকের তদন্তে দেখা গেছে, এনআরবিসি শুধু অযাচিতভাবে তার বেতন বৃদ্ধিই করেনি, অযথা পদোন্নতিও দিয়েছে।
মো. জাফর ইকবাল হাওলাদার ২০১৩ সালে প্রিন্সিপ্যাল অফিসার হিসেবে যোগদান করেন। এক বছরের মধ্যে তাকে ব্যাংকের নিজস্ব মানবসম্পদ নীতিমালা ভঙ্গ করে ফার্স্ট অ্যাসিস্ট্যান্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট (এফএভিপি) হিসেবে পদোন্নতি দেওয়া হয়ে। অথচ, ব্যাংকটির মানবসম্পদ নীতি অনুযায়ী এই পদোন্নতির জন্য অন্তত দুই বছরের অভিজ্ঞতা বাধ্যতামূলক। একইভাবে এফএভিপি হওয়ার এক বছরের মধ্যে তাকে আবারও নীতি ভঙ্গ করে ভাইস প্রেসিডেন্ট (ভিপি) হিসেবে পদোন্নতি দেওয়া হয়।
তার ওভারড্রাফট ব্যাংক অ্যাকাউন্ট স্টেটমেন্টগুলো বিশ্লেষণ করে এক অদ্ভুত প্যাটার্ন দেখা যায়। তার ওডি অ্যাকাউন্টে বিপুল পরিমাণ অর্থ আসে, তারপর একই পরিমাণ অর্থ অন্য অ্যাকাউন্টে পাঠানো হয় বা ক্রেডিট কার্ড বিল হিসেবে প্রদান করা হয়েছে। এই লেনদেনগুলো কখনো একদিনের ব্যবধানে, আবার কখনো একইদিনে হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে যে অ্যাকাউন্ট থেকে তার অ্যাকাউন্টে টাকা এসেছে সেই একই অ্যাকাউন্টে আবার টাকা ফেরত পাঠানো হয়েছে।
অ্যাকাউন্টের ব্যালেন্স শূন্য থাকলেও ওভারড্রাফট অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে একজন গ্রাহক ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে খরচ করতে পারেন, বিল পরিশোধ করতে পারেন। এই ধরনের অ্যাকাউন্ট প্রতি বছর রিনিউ করা হয়। যার অর্থ হচ্ছে, ব্যাংকের কাছে এমন অ্যাকাউন্টের স্বাভাবিক বা অস্বাভাবিক সব ধরনের লেনদেনের সুনির্দিষ্ট তথ্য রয়েছে।
জাফরের ওডি অ্যাকাউন্টটি ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে খোলা হয়। কিন্তু ২০১৭ সালে বর্তমান চেয়ারম্যান পারভেজ তমাল দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই লেনদেনের এই প্যাটার্ন দেখতে পাওয়া যায়।
২০১৬ সালে পরিচালক থাকাকালীন 'বোর্ডের অন্যান্য সদস্য ও কর্মকর্তাদের ভয় দেখানোর জন্য' বন্দুকধারী একজনকে নিয়ে বোর্ডরুমে ঢুকেছিলেন পারভেজ তমাল। ব্যাংকের একাধিক কার্যবিবরণী অনুযায়ী, সেইসময়ে বেনামি ঋণ নিয়ে ব্যাংক থেকে ৬৪ কোটি টাকা পাচারের অভিযোগে পারভেজসহ আরও কয়েকজনের বিরুদ্ধে তদন্ত করছিল বোর্ড।
পারভেজ বন্দুকধারীকে বোর্ডরুমে আনার স্বপক্ষে বলেন, বন্দুকধারী তার দেহরক্ষী। এমনকি কোনো ধরনের অর্থ পাচারে তার কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই বলেও দাবি করেন তিনি।
দ্য ডেইলি স্টার জাফরের সঙ্গে সম্পর্কিত ছয়টি ক্রেডিট কার্ড ও পাঁচটি ব্যাংক অ্যাকাউন্টের লেনদেন বিশ্লেষণ করেছে, যা থেকে লেয়ারিংয়ের বিষয়টি সামনে এসেছে।
২০১৫ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে তিনি তার অ্যাকাউন্ট ও ক্রেডিট কার্ড দিয়ে কয়েক কোটি টাকার লেনদেন করেছেন।
এই প্রতিবেদনের জন্য শুধু মাত্র সেই লেনদেনের তথ্য দেখা হয়েছে যেগুলো ২০১৭ সাল থেকে ২০২২ সালের মধ্যে হয়েছে এবং একই দিনে বা পরবর্তী দিনে প্রতিবারে ১ লাখ টাকার বেশি লেনদেন হয়েছে।
প্যাটার্নে এমন অসংখ্য লেনদেন দেখা যায়, যেখানে জাফরের অ্যাকাউন্টে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ প্রদান করা হয়েছে এবং তারপরে তিনি কিছু সময় পরই সেই টাকা আবার পরিশোধ করে দিয়েছেন।
আয়ের সঙ্গে বেমানান
ব্যাংকের নিজস্ব মানি লন্ডারিং অ্যান্ড টেররিস্ট ফাইন্যান্সিং রিস্ক ম্যানেজমেন্ট নীতি অনুসারে, 'লেয়ারিং হলো অর্থ পাচার প্রক্রিয়ার দ্বিতীয় পর্যায়, যেখানে অবৈধ তহবিল বা সম্পদ স্থানান্তর করা হয়, ছড়িয়ে দেওয়া হয় এবং সেগুলোর উত্স গোপন করা হয়। জটিল লেনদেনের জালে আর্থিক ব্যবস্থায় তহবিল লুকিয়ে রাখা যেতে পারে।'
নীতিতে বলা হয়েছে, সন্দেহজনক লেনদেনের একটি সূচক হলো 'গ্রাহকের ব্যবসা বা পেশার সঙ্গে মানানসই নয় এমন ঘন ঘন নগদ লেনদেন।'
জাফরের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। তার অ্যাকাউন্ট ও ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকার লেনদেন করা হয়েছে। অথচ, এই লেনদেনের তুলনায় তার ব্যাংক থেকে পাওয়া মাসিক বেতন বহুগুণ কম।
তার অ্যাকাউন্টে টাকা এসেছে মূলত দুটি উপায়ে। একটি হচ্ছে ওয়্যার ট্রান্সফার, নগদ বা চেক জমার মাধ্যমে সরাসরি তার অ্যাকাউন্টে টাকা স্থানান্তর। অপরটি হচ্ছে তার অনেকগুলো ক্রেডিট কার্ডের মধ্যে যেকোনোটিতে টাকা জমা করা।
টাকা বিভিন্নভাবে বের হয়েছে—যে অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা এসেছে সেখানেই আবার ফেরত পাঠানো হয়েছে, এনআরবিসি বা অন্য ব্যাংক অ্যাকাউন্টে গেছে, জাফরের নামে ক্রেডিট কার্ডে টাকা পাঠানো হয়েছে, একজন ব্যক্তির নামে চেক দেওয়া হয়েছে, ঋণের কিস্তি পরিশোধ করা হয়েছে।
২০১৮ ও ২০২০ সালের মধ্যে এমন সাতটি ঘটনা ঘটেছে যেখানে একটি ক্রেডিট কার্ড থেকে তার অ্যাকাউন্টে টাকা এসেছে এবং একই দিনে বিল হিসেবে তিনি অন্য ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে অর্থ খরচ করেছেন বা টাকা ট্রান্সফার করেছেন।
২০১৮ সালের ৯ জুলাই তিনি তার ক্রেডিট কার্ড থেকে ওভারড্রাফট অ্যাকাউন্টে পাঁচ লাখ টাকা স্থানান্তর করেন এবং কার্ড দিয়ে চার লাখ ৫৪ হাজার টাকার বিল পরিশোধ করেন। তিনি ২০২০ সালের ১১ থেকে ১৩ মে একই কাজ বারবার করেছেন। এই তিন দিনে অ্যাকাউন্টে নিয়েছেন ১৪ লাখ ৯০ হাজার টাকা এবং পরবর্তী দিনে চারটি ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে ১৩ লাখ ৪০ হাজার টাকা প্রদান করেছেন।
২০১৭ সালে চারটি এবং ২০২০ সালে এমন একটি উদাহরণ রয়েছে, যেখানে বিভিন্ন ক্রেডিট কার্ড থেকে তার ওডি অ্যাকাউন্টে টাকা এসেছে এবং তিনি একই দিনে বা পরবর্তী দিনে এই ব্যাংক অ্যাকাউন্টে টাকা পাঠিয়েছেন।
এ ছাড়া, ২০১৭-২০১৮ সালে চারটি ঘটনা ঘটেছে, যেখানে ব্যাংকের প্রধান শাখার সঙ্গে আরেকটি এনআরবিসি অ্যাকাউন্ট থেকে জাফরের ওডি অ্যাকাউন্টে অর্থ পাঠানো হয়েছে এবং তিনি একই দিনে একই অ্যাকাউন্টে অর্থ পাঠিয়েছেন।
দুদক ও বাংলাদেশ ব্যাংকের তদন্ত
জাফর ও ব্যাংকের ট্রেজারি বিভাগের ফার্স্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট মো. জমির উদ্দিনের মধ্যে একই দিনে ১৪টি বড় অংকের অর্থ লেনদেন হয়েছে।
২০২১ সালের ১৩ এপ্রিল জাফর তার ওডি অ্যাকাউন্ট থেকে জামিরকে ৫ লাখ টাকা ট্রান্সফার করেন এবং একই পরিমাণ টাকা জামির তাকে ফেরত দেন দুদিন পরে। ২০২১ সালের ১৮ এপ্রিল জামির ১ লাখ টাকা করে পাঁচটি আলাদা ট্রানজেকশনে টাকা পান এবং তারপরে তিনি জাফরের ওডি অ্যাকাউন্টে ৫ লাখ টাকা স্থানান্তর করেন।
২০১৭ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে জাফর কমপক্ষে ৪১টি লেনদেনের মাধ্যমে জামির উদ্দিনকে অন্তত ৯৭ লাখ টাকা দিয়েছেন, যেখানে জামির একই দিনে বা পরবর্তী এক বা দুই দিনের মধ্যে জাফরকে অন্তত ৭০ লাখ টাকা ফেরত দিয়েছেন।
জাফর পাঁচটি ঋণ অ্যাকাউন্টে অন্যদের ঋণের কিস্তিও পরিশোধ করেছেন। তিনি এনআরবিসি ব্যাংকের একটি ঋণ অ্যাকাউন্ট থেকেও টাকা পাচ্ছিলেন, যেটি তার নামে ছিল না। তিনি ২০২০ ও ২০২১ সালে ১২টি লেনদেনে মোট ২৭ লাখ টাকা পেয়েছিলেন।
জাফর জানান, এনআরবিসি ব্যাংকে তার একটি সুরক্ষিত ওডি অ্যাকাউন্ট রয়েছে। সেখান থেকে তিনি টাকা তুলতে এবং জমা করতে পারেন।
তিনি বলেন, 'আমি অন্যদের হয়ে পেমেন্ট করেছি। এটা করেছি আমাদের ডিজিটাল পণ্যের ব্যবহার জনপ্রিয় করতে। যাদের হয়ে আমি টাকা দিয়েছি তাদের মধ্যে অনেকেই জানেন না যে কীভাবে আমাদের ব্যাংকিং অ্যাপ ব্যবহার করতে হয়।'
অন্যান্য ব্যাংকে তার ঋণ রয়েছে এবং নিয়মিত সেগুলো পরিশোধ করতে হয় জানিয়ে তিনি বলেন, 'বেতন ছাড়া আমার আয়ের আর কোনো উৎস নেই। আমার মাসিক খরচ প্রায় ১ লাখ টাকা।'
জামির দাবি করেন, জাফরের সঙ্গে তার প্রতিটি লেনদেনই খুব সাধারণ।
তিনি বলেন, 'আমি ক্রেডিট কার্ডের বিল পরিশোধ করতে তার কাছ থেকে টাকা নিতাম। এরপর টাকা তুলে তাকে দিয়ে দিতাম। তিনি আমার ঘনিষ্ঠ সহকর্মী, তাই তার কাছ থেকে ধার নিতাম।'
ব্যাংকের চেয়ারম্যান পারভেজ তমাল জানান, তারা এসব লেনদেনের বিষয়ে অবগত আছেন এবং তারা বিষয়টি তদন্ত করছেন।
তিনি বলেন, 'বাংলাদেশ ব্যাংক ও দুর্নীতি দমন কমিশনও (দুদক) তার ব্যাংক স্টেটমেন্ট সংগ্রহ করেছে। যদি তার সুরক্ষিত ওডি অ্যাকাউন্ট বা তার ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে কোনো বেআইনি লেনদেন বা অর্থ পাচার হয়ে থাকে, তাহলে সেটা তদন্তে উঠে আসবে।'
বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও বাংলাদেশের পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, সন্দেহজনক লেনদেন বন্ধ করা ব্যাংকগুলোর দায়িত্ব।
তিনি বলেন, 'এই ধরনের লেনদেন পর্যবেক্ষণ করা তাদের উপর নির্ভর করে এবং তারা এই দায়িত্ব এড়াতে পারে না।'
শাস্তিযোগ্য অপরাধ
বড় অংকের বেতন বৃদ্ধি পাওয়া অপর কর্মকর্তা হলেন অ্যাসিসট্যান্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট (এভিপি) ও রূপপুর শাখার প্রধান মো. রাশেদ উল আলম। তার বেতন বেড়েছিল ৫৮ শতাংশ। অর্থাৎ, তিনি একসঙ্গে ১২টি ইনক্রিমেন্ট পেয়েছিলেন।
এই বেতন বৃদ্ধির চার বছর আগে পাপা রোমা নামে একটি কোম্পানিকে তিনি এমন একটি জমি জামানত হিসেবে দেখিয়ে পাঁচ কোটি টাকা ঋণ মঞ্জুর করেন, যেটি তখনও ওই গ্রাহকের মালিকানাতেই ছিল না। বাংলাদেশ ব্যাংকের তদন্তে উঠে এসেছে, ঋণ পাওয়ার পর গ্রাহক যে 'কারণে' ঋণ নিয়েছিল সেই কাজে ব্যবহার না করে ঋণের টাকা দিয়ে ওই জমি কেনেন।
মো. রাশেদ উল আলম কোনো অনিয়ম করেননি দাবি করে বলেন, 'আসলে জমির দাম ব্যাংকের আনুমানিক মূল্যের চেয়ে অনেক বেশি।'
বাংলাদেশ ব্যাংকের এফআইসিএসডি উল্লেখ করেছে, ২০১৯ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি এনআরবিসির ৭৮তম বোর্ড সভায় পাপা রোমা নামে একটি কোম্পানির জন্য ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল হিসেবে পাঁচ কোটি টাকা অনুমোদন দিয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে শর্তাবলীর মধ্যে ১৭৩ দশমিক পাঁচ ডিসিমাল জমি জামানত হিসেবে রাখার কথা ছিল। কিন্তু ওই সময় জমিটি পাপা রোমার মালিক সাইফুর রহমানের ছিলেন না।
প্রতিবেদনে দেখা যায়, পাপা রোমা ২০১৯ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি ও ৪ এপ্রিল যথাক্রমে আড়াই কোটি টাকা ও দুই কোটি টাকা জমির দুটি প্লটের মালিককে হস্তান্তর করেন। ২০১৯ সালের ৭ এপ্রিল জমির দলিল হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এটি আইনের লঙ্ঘন ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ এবং একে ঋণ জালিয়াতি হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
Comments