নিত্য দিনের বাজারে অমর্যাদাকর পরিস্থিতি

ছবি: সুমন আলী/স্টার

দেশের অধিকাংশ বাজারে কেনাকাটায় প্রায় তুচ্ছতাচ্ছিল্য ব্যবহার পান ক্রেতারা। এমন করে মর্যাদা হারানোর বড় ক্ষেত্র হয়ে উঠেছে নিত্য দিনের বাজার। হরদম চলে সহিংস আচরণ। কেনাবেচার ক্ষেত্রে ন্যূনতম সহনশীলতা নেই। বিক্রেতা সুযোগ পেলেই ক্রেতার ওপর চড়াও হচ্ছেন, এমন পরিস্থিতি প্রায় সর্বত্র। সম্প্রতি বাংলা ট্রিবিউনে একটি প্রকাশিত সংবাদ ''একটা মুরগি কেনার মুরাদ নাই, প্যান্ট-শার্ট পরে ভাব দেখাইতে আইছে'' ভাইরাল হয়েছে। এটি একটি ঘটনা, এ রকম অনেক ঘটনা আছে।  

বাজার বড়ো অচেনা হয়ে গেলো। বাজারের বিক্রেতাদের ঔদ্ধত্য, হুম্বি-তুম্বি অসহনীয় পর্যায়ে গেছে। ক্রেতাদের তুচ্ছ জ্ঞান করতে তারা স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছেন। ক্রেতাদের প্রত্যাখ্যান করছেন। নিলে নেন, না নিলে যান- এমন প্রকাশ নিত্য ব্যাপার।

নাগরিক অধিকার ভোগের এক বিশেষ পরিসর বাজার। এটি আত্মসম্মান, পছন্দ, সামর্থ্য ও রুচির সমষ্টি। সবার জন্য সহনশীল ও যৌক্তিক বাজারের চাওয়া বেশিকিছু নয়। আজকের বাজার ক্রেতার আয়-রোজগারের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়।  বাজারে থাকবে অবাধ প্রবেশাধিকার ও সামর্থ্য অনুযায়ী কেনাকাটার সুযোগ। ন্যায্যবাজার চাওয়া মোটেও ইউটোপিয়া নয়। কিন্তু কোথায় সেই প্রত্যাশিত পরিবেশ ?

বাজারে যেতে সংকোচ কাজ করে, দুশ্চিন্তা পেয়ে বসে। এ দুশ্চিন্তা তিনটি বিষয় ঘিরে; এক. বিক্রেতার সঙ্গে পণ্যের দরদাম করতে গিয়ে অপমানের আশঙ্কা; দুই. পরিবারের সদস্যদের চাহিদা অনুযায়ী পণ্য কিনতে না পারার অক্ষমতা; তিন. সংসারের অভিভাবক হিসেবে বাজারের কাছে ছোট হয়ে যাওয়া।

আজ মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত, শ্রমজীবী-খেটে খাওয়া মানুষ বড় অসহায়। ব্যাগ হাতে তারা দুরুদুরু বুকে চলেন, অতৃপ্তি নিয়ে ফিরেন। কারণ, পরিবারের সদস্যদের পছন্দ ও চাহিদামাফিক কেনাকাটা সম্ভব হচ্ছে না। কেনা যাচ্ছে না গরুর মাংস বা ইলিশ। বাজার শেখাচ্ছে কিভাবে খাদ্যাভাবে পরিবর্তন আনতে হবে। কীভাবে গরুর মাংসের পরিবর্তে ফার্মের মুরগির মাংস কিনতে হবে। গিলা-কলিজা, ভাঙা ডিমের দামও দশ থেকে পনের গুণ বেড়েছে। বাজার বড়ই অস্থিতিশীল। 

গত কয়েকদিন আগে ত্রিশ টাকা কেজির আলু হঠাৎ চল্লিশ টাকা হয়ে গেলো। আবার একশ দশ টাকা কেজির পিয়াজ দুয়েকদিনে মধ্যে ষাট টাকায় নেমে এলো। কথা হলো বাজার ক্রেতার অনুকূলে নেই। 
বাজার পরিস্থিতি আগুনসদৃশ্য। এ আগুন বেইলি রোডের কাচ্চি ভাইয়ের রেস্টুরেন্টের আগুন না, কিংবা বঙ্গবাজারের আগুন না বেইলি রোডের?  বঙ্গবাজারের আগুনে মুহুর্তেই পুড়ে যায় জীবন, পণ্য ও স্বপ্ন ও সম্ভাবনা। অন্যদিকে, আজকের বাজার তুষের আগুনের মতো তিলে তিলে খাচ্ছে ক্রেতাদের।  

বিক্রেতা আজ উত্তেজিত, যেনতেন উপায়ে ক্রেতার পকেট থেকে সর্বোচ্চ মুনাফা লুটে নিতে চান। সুযোগ পেলেই চড়াও হয় ক্রেতার ওপর। স্বস্তিদায়ক দরকষাকষির পরিবর্তে বাজার এখন তীব্র বিতর্ক । বিক্রেতার হাতে রয়েছে পণ্য, পুঁজি, যোগান ও নিয়ন্ত্রণ। ক্রেতার রয়েছে চাহিদা, স্বল্পটাকা এবং পারষ্পরিক বিচ্ছিন্নতা  (ক্রেতাদের ভেতর)। বিক্রেতা সংঘবদ্ধ ও সুশৃঙ্খল অন্যদিকে ক্রেতা অসংবদ্ধ ও বিশৃঙ্খল। বিক্রেতাদের পারষ্পরিক আলোচনার ভিত্তিতে পণ্যের মূল্য নির্ধারিত হয়। ক্রেতার পকেট কাটার ব্যাপারে বাজারের ব্যবসায়ীদের রয়েছে ইস্পাতকঠিন ঐক্য। দরকষাকষিতে একটি সহিংস মনোভাব দেখিয়ে মূহুর্তেই ক্রেতাকে অস্বস্তিকর পরিস্থিতির ভেতর ফেলে।  

 

বাজার ব্যবস্থায় সবচেয়ে প্রান্তে রয়েছে ক্রেতা। অন্যদিকে, বাজারের বড় প্রভাবক বিক্রেতা। দেনদরবারে তাদের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। পুঁজিকে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে তুলতে তারা তৎপর। চাঁদাবাজ, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা-কর্মী, স্থানীয়ভাবে নিযুক্ত এক দালাল শ্রেণি (যারা চাঁদা তোলার কাজটি করে থাকে) সঙ্গে সখ্য মিলিয়ে চলতে তারা অভ্যস্ত হয়ে উঠেছেন।

এ ধরনের অর্থনৈতিক তৎপরতা যাকে অর্থনীতির ভাষায় রেন্টসিকিং ইকোনোমি (চাঁদাবাজির অর্থনীতি) বলে। কিছু বাজারগুলো থেকে মূলত তিন ধরনের চাঁদাবাজি হয়; এক আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, দুই. স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা; তিন. চাঁদা তোলা এজেন্ট। বাজারে রাস্তার পাশে সবজির যে ভ্যানগাড়ি দাঁড়িয়ে থাকে তাকেও কমপক্ষে একশত থেকে দেড়শত টাকা চাঁদা দিতে হয়। 

বিদ্যমান বাজার ব্যবস্থা পিষে দিচ্ছে প্রান্তিক, মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তকে। সার্বিক বিবেচনায় জাতীয় অর্থনীতির অগ্রগতি ঘটলেও এর ভেতর সাধারণ মানুষদের মুখ দেখা যায় না।

চাঁদা দেওয়া না দেওয়া নীতি-নৈতিকতার বাইরে চলে গেছে। চাঁদা দেওয়া সহনশীলতার মধ্যে চলে এসেছে। বিক্রেতারা মেনে নিয়েছেন চাঁদা না দিলে তারা ব্যবসা করতে পারবেন না। প্রথম আলোর রাজশাহীর প্রতিনিধি আবুল কালাম আজাদ মাছ ভর্তি ট্রাকে চেপে রাজশাহী জেলার মোহনপুর উপজেলা থেকে গাবতলি পর্যন্ত এসে দেখেছেন কোথায় কতো টাকা চাঁদা দিতে হয়। ব্যবসায়ীরা নিজের পকেট থেকে চাঁদা দেন না। ক্রেতা তা গুণতে হয়-যা পণ্যের মূল্য বৃদ্ধির অন্যতম একটি কারণ।

আরেকটি বিষয় হলো পণ্য পরিবহন ব্যবস্থা। উৎস থেকে পণ্য বাজারে আনতে পরিবহন ব্যয়, চাঁদা, কাঁচাপণ্য নষ্ট হয়ে যাওয়ায় পণ্যের মূল্য বেড়ে যায় বলে বিক্রেতারা দাবি করেন। মাঠের পণ্যমূল্যের সঙ্গে ঢাকার বাজারের পণ্যমূল্যের আকাশ-পাতাল পার্থক্য। সম্প্রতি যমুনা টেলিভিশনের এক খবরে বলা হয়েছে-বগুড়ায় এক মণ বেগুণ আশি টাকায় বিক্রি হচ্ছে আর ঢাকায় এক কেজি বেগুণ বিক্রি হচ্ছে আশি টাকায়। অন্যদিকে, যুগান্তরে প্রকাশিত এক খবরে বলা হয়েছে, দেড়শ টাকার তরমুজে সাড়ে ছয়শ টাকা লাভে ঢাকায় বিক্রি হচ্ছে।

মধ্যস্বত্ত্বভোগীরা বাজারের সারবত্তাটুকু তুলে নিচ্ছেন। উৎপাদন বা বিপণনের সঙ্গে কোনো সম্পৃক্ত না থেকেও সহজেই মুনাফার সিংহভাগ পকেটে পুরছেন। মধ্যস্বত্ত্বভোগীদের পাশাপাশি বাজার নিয়ন্ত্রণে রয়েছে অনেকগুলো অদৃশ্য হাত। এ অদৃশ্য হাত নিয়ন্ত্রণ বা ভোক্তা অধিকার সুরক্ষায় কোনো কার্যকর কাঠামো গড়ে উঠলো না। 

বিদ্যমান বাজার ব্যবস্থা পিষে দিচ্ছে প্রান্তিক, মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তকে। সার্বিক বিবেচনায় জাতীয় অর্থনীতির অগ্রগতি ঘটলেও এর ভেতর সাধারণ মানুষদের মুখ দেখা যায় না। জাতীয় প্রবৃদ্ধির পরিসংখ্যানগত অর্জন শুনতে ভালো কিন্তু তা সাধারণ মানুষের জীবন স্পর্শ করে না। 

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো কর্তৃক প্রকাশিত খাদ্যনিরাপত্তা পরিসংখ্যান ২০২৩-এ দেখা গেছে,  গ্রামের ২৬ ভাগ মানুষ মৌলিক চাহিদা মেটাতে ঋণের চক্রে পড়েছেন। ঢাকার নবোদয় এলাকার মুদী ব্যবসায়ী সিরাজুল ইসলাম এ তথ্যের সঙ্গে ভিন্ন মত প্রকাশ করে বলেন, নগর দরিদ্রের ৮০ ভাগ আজ ঋণগ্রস্ত। দৈনন্দিন জীবনযাপনের জন্য অর্জিত আয় দিয়ে চলতে তাদের হিমশিম খেতে হচ্ছে। সমাজের স্বল্পআয়ের মানুষদের আয় বাড়েনি বরং অনেকাংশে কমেছে। তারা আত্মীয়-স্বজন, পাড়া প্রতিবেশীদের কাছ থেকে ধার-দেনা করে কষ্টে দিন পার করছেন। শহরের দরিদ্রদের আয়ের বড় অংশ ব্যয় হয়- বাসাভাড়া, খাবার ও চিকিৎসায়। এ তিনটি খাতের মধ্যে সমন্বয় করতে অন্যের কাছ থেকে টাকা কর্জ করতে হচ্ছে।
 
ক্ষুধা মেটানোটাই আজ মুখ্য হয়ে উঠেছে। সুষম খাবারের কথা  তো দূরের ব্যাপার। অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, জীবনযাত্রার মান বেড়ে যাওয়ার নিম্ন আয়ের মানুষের পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ কমে গেছে। বাজারে খাবার আছে অথচ মানুষ তা কিনতে পারছে না। মানুষের ক্রয় ক্ষমতা কমে গেলে বাজারে পণ্য থাকলেও তা কেনা সম্ভব নয়।

নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন তার দ্য পোভার্টি অ্যান্ড ফেমেইন গ্রন্থে দেখিয়েছেন, ১৯৪৩ সালে দুর্ভিক্ষের সময় পর্যাপ্ত খাবার ছিল; কিন্তু খাদ্যবণ্টন ও সরবরাহ ব্যবস্থা ছিল না। তিনি আরও উল্লেখ করেন, তেতাল্লিশের ডিসেম্বরে খাদ্যের ফলন ছিল অন্যান্য বছরের তুলনায় বেশি কিন্তু সাধারণ মানুষের সামর্থ্য না থাকায় তারা চাল কিনতে পারেনি।

সাহিত্যিক ও সাংবাদিক শৈলেন সরকার ''দুর্ভিক্ষের সাক্ষী-১৯৪৩-এর মন্বন্তরের ৭৫ বছর পার করা ৫০ জনের বয়ান'' শীর্ষক গ্রন্থে দুর্ভিক্ষের কারণ, বাজারব্যবস্থা, চালের মূল্য, বাঁচা-মরার লড়াই, রাষ্ট্রের ভূমিকা, রাজনীতি, ব্যক্তি-পারিবারিক সম্পর্কের ঠুনকো চিত্র, লুটপাট ও দুর্ভিক্ষের সুবিধাভোগীদের কথা তুলে ধরেছেন।

দেশে ভিক্ষার অভাব নেই, নেই দুর্ভিক্ষ। কিন্তু খাদ্যঅধিকার দারুণভাবে সংকুচিত হয়েছে। মানুষ চাহিদামাফিক খাবার খেতে পারছে না। যারা ওএমএসের চাল খান এমন অনেক নিম্ন আয়ের মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এ চালের ভাত পেটে থাকে না, দ্রুত হজম হয়ে যায়। রাতে রান্না করা ভাত সকালে পানি হয়ে যায়। পেটে গ্যাস হয়। তাহলে শরীরের জন্য সুষম খাদ্য কোথায় পাওয়া যাবে? সুষম খাদ্য ছাড়া কী কায়িক ও পরিশ্রমী মানুষের কর্মক্ষমতা ধরে রাখা সম্ভব? 

খাদ্যপরিস্থিতি ''মাংস খাওয়া না-খাওয়ার রাজনীতি ও অর্থনীতি শিরোনামে ২২ নভেম্বর ২০২২-এ প্রথম আলোয় এক কলামে উন্নয়ন অর্থনীতিবিষয়ক গবেষক মাহা মির্জা পুষ্টিবিদের উদ্বৃত্তি দিয়ে বলেন, মানবদেহের জন্য দৈনিক ২ হাজার ৪০০ ক্যালরি আবশ্যক। এটা একেবারেই ন্যূনতম হিসাব। একজন কৃষক বা স্টিল কারখানার একজন শ্রমিক ঘণ্টায় ৪০০ ক্যালরি খরচ করেন। ... বীজতলা তৈরি, বীজ বোনা বা ধান কাটার মতো কাজগুলো এখনো বহু কৃষক হাতেই করেন। ইন্ডাস্ট্রিগুলোও এখানে কায়িক শ্রমনির্ভর।

অথচ আজ প্রায় ক্যালরি শূন্য শ্রমবাজার সৃষ্টি হতে যাচ্ছে দেশে। খাদ্যঅধিকার সংকুচিত হওয়ায় কেবল শারীরিক নয় মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে মানুষের ওপর। ঢাকার মোহাম্মদপুর এলাকার সবজি বিক্রেতা মো. দেলোয়ার জানালেন, প্রতিরাতে তাকে ঘুমের জন্য ষোল টাকার ঔষধ খেতে হয়। স্বাভাবিক ঘুম নেই, নেই শান্তি! 

 একচেটিয়া, অসম ও অমর্যাদাকর বাজার ব্যবস্থা ক্রেতার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে গেলো। এ বাজার রুখতে হবে। ভোক্তা অধিকার সুরক্ষায় রাষ্ট্রকে এগিয়ে আসবে হবে।

Comments

The Daily Star  | English

Teknaf customs in limbo as 19 mt of rice, authorised by AA, reaches port

The consignment of rice weighing 19 metric tonnes arrived at Teknaf land port on Tuesday evening with the documents sealed and signed by the Arakan Army

3h ago