‘কিংস পার্টি’ ও আবারও সাকিব বিতর্ক
বিতর্ক এবং সাকিব আল হাসান যেন সমার্থক শব্দে পরিণত হচ্ছে।
গত ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত বিএনপিবিহীন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের টিকিটে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন।
যদিও বারবার নানাবিধ বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে যাওয়ার কারণে তাকে যাতে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন দেওয়া না হয়, সে জন্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেকেই দাবি তুলেছিলেন। বাংলাদেশের আর কোনো তারকার ক্ষেত্রে এমনটি ঘটেনি।
আরেক ক্রিকেট তারকা মাশরাফিকে নিয়ে কখনোই এই ধরনের বিতর্ক ওঠেনি বা তাকে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন না দেওয়ার দাবি উঠেনি। বরং তিনি যে আসনের সংসদ সদস্য, সেখানে তিনি অত্যন্ত জনপ্রিয়। এখন পর্যন্ত তার বিরুদ্ধে কোনো দুর্নীতি বা অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া যায়নি।
বিপরীতে, সাকিব আল হাসান বারবারই বিতর্কিত হয়েছেন, সমালোচিত হয়েছেন। অথচ বিশ্ব যে কয়জন মানুষের জন্য বাংলাদেশকে চেনে, সাকিব আল হাসান তাদের অন্যতম। একসময় তাকে নিয়ে এরকম স্লোগানও মানুষ দিয়েছে, 'বাংলাদেশের জান, সাকিব আল হাসান'। অথচ সেই আকাশচুম্বী জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব বারবারই গণমাধ্যমের সংবাদ শিরোনাম হচ্ছেন নেতিবাচক খবরের কারণে। সঙ্গত কারণেই তিনি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ট্রলেরও শিকার হয়েছেন।
সাকিব সবশেষ সংবাদ শিরোনামে হয়েছেন মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিনের সঙ্গে একটি ছবির কারণে। গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে যাওয়া যে ছবিতে দেখা যাচ্ছে, একটি ফরম হাতে হাস্যোজ্জ্বল সাকিব দাঁড়িয়ে আছেন মেজর হাফিজের পাশে।
খবরে বলা হচ্ছে, ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে তিনি মেজর হাফিজের কাছে গিয়েছিলেন বিএনপির কিছু সাবেক নেতাকে নিয়ে গঠিত 'কিংস পার্টি' হিসেবে পরিচিতি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে (বিএনএম) যোগ দিতে। যদিও এর আগে থেকেই আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাওয়ার ব্যাপারে সাকিব বেশ তৎপর ছিলেন। কিন্তু অনেকে মনে করছেন, শেষমেষ তিনি নৌকার টিকিট পাওয়ার বিষয়ে নিজেও যে সংশয়ে ছিলেন, বিএনএমে যোগ দিতে যাওয়ার এই ছবিটি তার প্রমাণ।
এ বিষয়ে সংবাদ সম্মেলনে মেজর হাফিজ দাবি করেছেন, নির্বাচনের আগে কয়েকজন সাবেক সামরিক কর্মকর্তা সাকিবকে তার কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন বিএনএমএ যোগ দেওয়ার জন্য। সাকিবকে বলা হয়েছিল যে মেজর হাফিজও এই দলে যোগ দেবেন। কিন্তু মেজর হাফিজ শেষ পর্যন্ত এই দলে যোগ দেননি। তিনি বলেন, বিএনএমে যোগ দেওয়ার ব্যাপারে তার ওপর ভীষণ চাপ ছিল। কিন্তু ৩২ বছর একটি দল করার পরে সেটি থেকে বেরিয়ে যাওয়া সহজ নয়।
এ বিষয়ে ক্ষমতাসীন দলের অবস্থান জানতে সাংবাদিকরা প্রশ্ন করলে দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, দলীয় মনোনয়ন পেতে প্রাথমিক সদস্যপদ থাকতে হয়। নির্বাচনের আগে সাকিব আওয়ামী লীগের প্রাথমিক সদস্য হয়েছেন। তারপর মনোনয়ন পেয়েছেন। এর আগে তিনি অন্য কোনো দলে যোগ দিতে গিয়েছিলেন কি না বা তিনি অন্য কোনো দলের সদস্য হয়েছিলেন কি না, সেটি তার জানা নেই।
ঘটনা যাই হোক, এই ছবিটি দেশের 'কিংস পার্টি'র ইতিহাসে একটি কেসস্টাডি হয়ে থাকবে। স্মরণ করা যেতে পারে, ফখরুদ্দীন-মইনউদ্দিনের নেতৃত্বাধীন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে 'কিংস পার্টি' শব্দযুগল বেশ আলোচিত হয়।
'কিংস পার্টি' মানে রাজার দল। রাজা মানে ক্ষমতাসীনদের অনুগত দল, যারা ভোটে অংশ নিয়ে কতটি আসন পেল, তারচেয়ে বড় কথা তারা ভোটকে জায়েজ করার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখে। সামরিক বাহিনী যেহেতু সরাসরি রাজনীতি করতে পারে না, সেজন্য অনেক সময় তাদের পৃষ্ঠাপোষকতায় এমন কিংস পার্টি গড়ে তোলা হয়। যাদেরকে নিয়ে নানাবিধ উদ্দেশ্য হাসিলের চেষ্টা হয়।
সৈয়দ ইবরাহিমের বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি ছাড়াও আলোচিত ওয়ান ইলেভেনের পর জরুরি অবস্থার সময়ে যেসব দল গঠিত হয়, তার মধ্যে ছিল ফেরদৌস আহমেদ কোরেশীর নেতৃত্বে প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক দল (পিডিপি), বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা প্রশিকার তৎকালীন চেয়ারম্যান কাজী ফারুক আহম্মদের ঐক্যবদ্ধ নাগরিক আন্দোলন, জাতীয় পার্টির সাবেক নেতা শেখ শওকত হোসেন নীলুর নেতৃত্বে ন্যাশনাল পিপলস পার্টি (এনপিপি) ইত্যাদি। যদিও কল্যাণ পার্টি ছাড়া অন্য দলগুলো এখন আর আলোচনায় নেই।
সেই ধারাবাহিকতায় এবার দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে বিএনপির সাবেক কিছু নেতাকে নিয়ে গঠিত বিএনএম এবং তৃণমূল বিএনপি নামে যে দুটি দল নিবন্ধন পায় ও নির্বাচনে অংশ নেয়, তাদেরকেও 'কিংস পার্টি' বলে অভিহিত করা হয়। সৈয়দ ইবরাহিমের কল্যাণ পার্টি সরকার পতনের 'এক দফা' দাবিতে বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে থাকলেও তারা নতুন গঠিত দুটি কিংস পার্টির সঙ্গে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেয়।
যদিও সৈয়দ ইবরাহিম ছাড়া কিংস পার্টির আর কোনো নেতাই কোনো আসন থেকে জয় পাননি। সাকিব বা মেজর হাফিজও কোনো কিংস পার্টির প্রার্থী হয়ে নির্বাচনে অংশ নিলে যে জয়ী হতেন, সেই সম্ভাবনা ক্ষীণ। অবশ্য সেটি অন্য তর্ক।
২.
সাকিবের 'কিংস পার্টি'তে যোগ দেওয়ার খবর নিয়ে সারা দেশে যখন তোলপাড়, তখন আরও একটি খবর সামনে এসেছে। সেটি হলো ভারতে বেটিং কেলেঙ্কারির তদন্তে এসেছে তার বোনের নাম। খবরে বলা হয়, ভারতে তোলপাড় ওঠা মহাদেব বেটিং অ্যাপ কেলেঙ্কারির তদন্তে সাকিবের ছোট বোন জান্নাতুল হাসান রিতুর নাম এসেছে।
ইন্ডিয়া টুডের একটি প্রতিবেদনের বরাতে খবরে বলা হয়, বেটিং কেলেঙ্কারিতে গ্রেপ্তার হওয়া দুই ব্যবসায়ী সুরজ চোখানি ও গিরিশ তালরেজা তদন্তকারীদের জানিয়েছেন, বাংলাদেশে একটি বেটিং অ্যাপে তাদের বিনিয়োগ আছে, তাদের সঙ্গে এতে বিনিয়োগের অংশিদারিত্ব আছে সাকিবের বোন জান্নাতুলেরও।
গত বছর সেপ্টেম্বর থেকে মহাদেব বেটিং অ্যাপ ভারতে আলোচনায়। এই গেমিং (জুয়া খেলার) প্ল্যাটফর্মের বিপুল আর্থিক দুর্নীতি খুঁজে পায় ভারতের কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা (ইডি)। তাতে উচ্চ পর্যায়ের অনেকের নাম উঠে আসে। এই তদন্তের জন্যই গ্রেপ্তার করা হয় গিরিশ ও সুরুজকে।
প্রশ্ন উঠতে পারে, সাকিবের বোনের নাম যদি কোনো বেটিং কেলেঙ্কারির তদন্তে বেরিয়ে আসে, সেখানে সাকিবের দায় কী? বাস্তবতা হলো, এখানে সাকিবের বোন যদি যুক্ত হয়েও থাকেন, তার নেপথ্যে সাকিবের যুক্ত থাকা অসম্ভব নয়।
স্মরণ করা যেতে পারে, ২০১৯ সালের অক্টোবরে সব ধরনের ক্রিকেট থেকে সাকিবকে দুই বছরের জন্য নিষিদ্ধ করেছিল আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কাউন্সিল (আইসিসি)। তার বিরুদ্ধে তিনটি অভিযোগ এনে আইসিসি এই নিষেধাজ্ঞা দেয়। প্রধান অভিযোগ, ফিক্সিংয়ের প্রস্তাব পেয়ে সেটি প্রত্যাখ্যান করলেও আইসিসি কিংবা বিসিবিকে না জানানো। যদিও দোষ স্বীকার করার কারণে তার এক বছরের শাস্তি স্থগিত করা হয়।
২০১৪ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত সাকিব নিষিদ্ধ হয়েছিলেন মোট চারবার। ২০১৪ সালে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে দ্বিতীয় ওয়ানডে চলার সময় টিভি ক্যামেরায় অশালীন অঙ্গভঙ্গি করে তিন ম্যাচ নিষিদ্ধ হন। একই বছর তখনকার প্রধান কোচ চন্দিকা হাতুরুসিংহের সঙ্গে বাজে ব্যবহারের জন্য সাকিবকে ছয়মাস নিষিদ্ধ করা হয়। এরপরই ২০১৯ সালে ঢাকা প্রিমিয়ার লিগে (ডিপিএল) আবাহনী লিমিটেডের বিপক্ষে মেজাজ হারিয়ে আবারও তিন ম্যাচ নিষিদ্ধ হন।
খেলার মাঠে মেজাজ ঠিক রাখতে না পারা; উদ্ধত আচরণ করা কিংবা ম্যাচ ফিক্সিংয়ের ষড়যন্ত্রের খবর গোপন রাখার মতো বিষয়গুলোর বাইরেও সাকিব আরও যেসব কারণে সংবাদ শিরোনাম হয়েছেন, সেগুলো বাংলাদেশের আর কোনো ক্রিকেট তারকাকে নিয়ে হয়নি। বলা হয় তার এসব নেতিবাচক সংবাদের পেছনে রয়েছে 'টাকা'।
এমন খবরও বেরিয়েছে যে, পুঁজিবাজারে ব্যবসা করার জন্য সাকিব যে ব্রোকারেজ হাউজের ব্যবসা খুলেছেন, সেই কোম্পানির নিবন্ধনের সময় তার বাবার নামটিই ভুল দিয়েছেন। সাকিবের বাবার নাম খন্দকার মাসরুর রেজা। কিন্তু গণমাধ্যমে প্রকাশ হওয়া মোনার্ক হোল্ডিংস লিমিটেড কোম্পানির ফরম ১৫-তে তার বাবার নাম উল্লেখ করা হয়েছে কাজী আব্দুল লতিফ।
ওই সময় চার প্রতিষ্ঠানের শেয়ার কারসাজির তদন্তে বেরিয়ে আসে সাকিবের নাম। গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়, বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) ২০২১ সালের ৫ মে থেকে পরের বছরের ১০ মার্চ পর্যন্ত চারটি তদন্ত চালায়। তাতে দেখা যায়, শেয়ার কারসাজির সময় সাকিব ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে বেশ কয়েকবার বিপুল সংখ্যক শেয়ার লেনদেন করেছেন। কারসাজির সঙ্গে যুক্ত মোনার্ক হোল্ডিংসের চেয়ারম্যান তিনি।
অস্বীকার করার সুযোগ নেই, বাংলাদেশের ক্রিকেটে এ পর্যন্ত যত সফলতা এসেছে, সেখানে সাকিবের ভূমিকা অনন্য। শুধু তাই নয়, অনেক সফলতার পেছনে সাকিবের ভূমিকাই ছিল প্রধান। অথচ তার বিরুদ্ধে ম্যাচ পাতানোর উদ্দেশ্যে জুয়াড়িদের সঙ্গে যোগাযোগের অভিযোগ উঠেছে। আম্পায়ারের সঙ্গে তর্কে জড়িয়ে স্ট্যাম্পে লাথি মারা কিংবা স্ট্যাম্প তুলে আছাড় মারার ঘটনাও ঘটিয়েছেন এই অলরাউন্ডার।
বাংলাদেশ জাতীয় দলের একজন ক্রিকেটার হিসেবে সাধারণ মানুষের কাছে সাকিবের যেমন সর্বজন গ্রাহ্যতা থাকার কথা ছিল, সেখানে বিরাট ছন্দপতন ঘটে গেছে। সাকিব নিজে এটা কতটুকু টের পান এবং টের পেলেও তিনি সেটাকে কীভাবে মূল্যায়ন করেন, তা বিরাট প্রশ্ন।
তার ভাবমূর্তি কতটা খারাপ হয়েছে তার ছোট্ট উদাহরণ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষকের একটি ফেসবুক পোস্ট; যেখানে তিনি লিখেছেন—'সাকিববিহীন বাংলাদেশ জাতীয় দল কিন্তু বেশ ভালো করছে। সাকিব থাকুক সোনার ব্যবসা, পার্লামেন্ট, ইট-বালু-সিমেন্ট নিয়ে।' একজন বিশ্বমানের ক্রিকেটারের জন্য এরচেয়ে লজ্জার কিছু হতে পারে না।
মোদ্দা কথা, একজন মানুষের কাছে যদি সম্মান, আত্মসম্মান, দেশপ্রেম ও মানুষের ভালোবাসার চেয়ে টাকার মোহ ও লোভ বড় হয়ে যায়, তখন তার জন-অনুভূতি বোঝার ক্ষমতা লোপ পায়। একজন মানুষের সর্বোচ্চ ভালো থাকার জন্যই বা কত টাকার প্রয়োজন হয়? সাকিব আর কোনো নেতিবাচক সংবাদের শিরোনাম হবেন না—এটিই প্রত্যাশা।
লেখক: কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স এডিটর, নেক্সাস টেলিভিশন
Comments