পাবনার ঐতিহাসিক ‘ভুট্টা আন্দোলন’
পাকিস্তানের ২৩ বছরের দুঃশাসনে ছোট-বড় নানা আন্দোলন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন হয় বাংলাদেশ। যেসব আন্দোলন সংগ্রাম নয় মাসব্যাপী মুক্তিযুদ্ধের ভিত রচনা করেছিল তার মধ্যে অন্যতম পাবনার 'ভুট্টা আন্দোলন'।
১৯৬৭ সালে তৎকালীন পাবনায় পাকিস্তান সরকারের নিম্নমানের রেশন সরবরাহের প্রতিবাদে শুরু হওয়া এ আন্দোলন প্রভাব ফেলে পুরো দেশে।
দিনটি ছিল ১৯৬৭ সালের ১৬ মার্চ, নিম্নমানের ভুট্টার আটা খেয়ে মারা যান হারু প্রামাণিক নামে এক দরিদ্র রিকশাচালক। বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত দরিদ্র ও শ্রমজীবী জনগোষ্ঠীর অনেকেই অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়।
খবরটি পুরো শহরে ছড়িয়ে পড়লে বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে পাবনার শ্রমজীবী সাধারণ মানুষ। এ ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে পুরো শহরে। তৎকালীন সময়ের প্রগতিশীল সব রাজনৈতিক দলের নেতা ও সাধারণ ছাত্ররা যুক্ত হয়ে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে পুরো পাবনায়।
বিক্ষুব্ধ জনতা শহরের মোড়ে মোড়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। বিক্ষুব্ধ শ্রমিক, সাধারণ মানুষ ও ছাত্র-জনতা পাবনা শহরের রূপকথা রোডে অবস্থিত তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের ফুড সেক্রেটারি ক্যাপ্টেন জায়েদির বাড়ির দিকে এগিয়ে যায়।
এ সময় আইয়ুব সরকারের একনিষ্ঠ ক্যাপ্টেন জায়েদি উত্তেজিত জনতাকে রোধ করতে তারা বাড়ি থেকে গুলিবর্ষণ শুরু করে।
গুলিবিদ্ধ হয়ে রাস্তার একজন মৃত্যুবরণ করেন, গুলিবিদ্ধ হন তৎকালীন ছাত্রলীগের শীর্ষ সংগঠক ও পরবর্তীতে আওয়ামী লীগ নেতা আহমেদ রফিকসহ অনেকে।
বিক্ষুব্ধ জনতার ওপর গুলির ঘটনা আরও বিক্ষুব্ধ করে তোলে জনতাকে। বিক্ষুব্ধ জনতা শহরের বন্দুকের দোকান লুট করে পাল্টা প্রতিরোধ গড়ার চেষ্টা করে। বিক্ষুব্ধ জনতা এক পর্যায়ে ক্যাপ্টেন জায়েদির বাড়িতে আগুন জ্বালিয়ে দেয়।
প্রশাসনের সহায়তায় ক্যাপ্টেন জায়েদি পরবর্তীতে পাবনা থেকে ঢাকায় চলে যান, দীর্ঘদিন তাকে আর পাবনায় দেখা যায়নি বলে জানান ঐতিহাসিকরা।
বিক্ষোভ দমনে তৎকালীন প্রশাসন পাবনা, ঈশ্বরদী ও সিরাজগঞ্জে ১৪৪ ধারা জারি করে, শুরু হয় গণগ্রেপ্তার। সাংবাদিক, রাজনীতিক, ছাত্রনেতা, শ্রমিকসহ প্রায় তিন শতাধিক মানুষকে আটক করা হয়।
পরবর্তীতে অনেকে জামিন পেলেও ২৯ জনকে রাজবন্দি হিসেবে দীর্ঘদিন আটক রাখা হয়।
পাবনায় সংগঠিত এ আন্দোলন দমাতে তৎকালীন আইয়ুব সরকার এক সরকারি প্রেস নোটে ভুট্টার আটা থেকে কোন বিষক্রিয়া হয়নি বলে দাবি করেন। তবে পাকিস্তান সরকারের এ দাবি দমাতে পারেনি পাবনার মানুষের ক্ষোভ।
ঐতিহাসিক ভুট্টা আন্দোলনে অংশ নেওয়া তৎকালীন ছাত্রনেতা মো. মোক্তার হোসেন দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, তৎকালীন খাদ্য সংকটে নিম্ন আয়ের মানুষের কাছে রেশনের গুরুত্ব ছিল অনেক বেশি। রেশনে সরবরাহকৃত বিষাক্ত ভুট্টার আটা খেয়ে একজন রিকশাচালকের মৃত্যু আর অনেক নিম্নআয়ের মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়লে সাধারণ শ্রমিক শ্রেণির মানুষ বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে।
পরিস্থিতির ভয়াবহতা সাধারণ মানুষের এ আন্দোলকে পাবনার সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে ফলে দল-মত, জাতি, ধর্মের সব বিভেদ ভুলে সর্বস্তরের মানুষ ঝাপিয়ে পড়ে এ আন্দোলনে।
তৎকালীন আইয়ুব সরকারের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে সেদিন সাধারণ মানুষের এ বিক্ষোভ গণআন্দলনে রূপ নেয় বলে জানান তিনি। একজন সচেতন ছাত্র হিসেবে সেদিন এ আন্দোলনে অংশ নিয়ে কারাবরন করলেও এর মধ্য দিয়ে পাবনার মানুষ পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ আওয়াজ তুলতে পারে যা তৎকালীন সময়ে পাকিস্তান সরকারের মাথা ব্যথার কারণ হয়ে যায় বলে মনে করেন তিনি।
লেখক ও সাংবাদিক মোস্তফা সতেজ বলেন, বিভিন্ন ঐতিহাসিকের লেখা থেকে পরবর্তীতে জানা গেছে তৎকালীন সময়ে রেশনের খাবার খেয়ে কুষ্টিয়ায় ৬ জন, খুলনায় দুই জন আর কুমিল্লা ও পাবনায় ১ জন করে ১০ জনের মৃত্যু হয়। সব জায়গায় ক্ষোভ থাকলেও পাবনায় ক্ষোভ বিক্ষোভে রূপ নেয় এবং পরবর্তীতে সেটা গণআন্দোলনে পরিণত হয়।
ভুট্টার আন্দোলন নিয়ে সংবাদ দৈনিক আজাদ পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশের জেরে ধরে তৎকালীন প্রখ্যাত সাংবাদিক আনোয়ারুল হককে বাসা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। প্রায় দুই বছর বিনা বিচারে আটক রাখা হয় তাকে। আর একজন সাংবাদিক হাসনাতুজ্জামানকেও গ্রেপ্তার করা হয়।
সে সময়ের শীর্ষ স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও বাম সংগঠনের বেশিরভাগ নেতাকে জেলে বন্দি করে রাখা হয়।
পাবনার বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ অধ্যাপক শিবজিত নাগ বলেন, ভুট্টা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে পাবনার মানুষ সেদিন মুক্তিযুদ্ধের জন্য সংগঠিত হওয়ার প্রাথমিক ধাপ অর্জন করে।
সাধারণ মানুষের ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ কীভাবে একটি শক্তিশালি গোষ্ঠীর ভিত কাঁপিয়ে দিতে পারে সে শিক্ষা পরবর্তীতে পাবনার মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রেরণা ছিল বলে মনে করেন প্রবীণ এ শিক্ষাবিদ।
আগামী প্রজন্মের কাছে মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সঠিকভাবে তুলে ধরতে হলে ভুট্টা আন্দোলনের ইতিহাস সংরক্ষণ করা প্রয়োজন বলে মনে করেন প্রবীণ এ শিক্ষাবিদ।
Comments