চট্টগ্রামে ৯০০ অটো-টেম্পু বাতিলের জরিপ ও সুপারিশ নিয়ে ক্ষোভ
চট্টগ্রামে নগরীর বিভিন্ন রুটে চলা ৯০০টি তিন চাকার অটো-টেম্পুর রুট পারমিট বাতিলের সুপারিশকে কেন্দ্র করে নগরীর পরিবহন খাতে বিশৃঙ্খলার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
টেম্পু চলাচল বাতিল হলে নগরীর ১৩টি রুটে যাত্রীদের ভোগান্তির সম্ভাবনা আছে এবং পরিবহন ব্যবস্থায় নৈরাজ্য সৃষ্টি হতে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
সম্প্রতি চট্টগ্রাম নগরের ব্যস্ত সড়কগুলোর বিভিন্ন সমস্যা সমাধানে টেম্পু চলাচল বন্ধসহ কিছু সিদ্ধান্ত নিয়েছে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন এলাকা যাত্রী ও পণ্য পরিবহন কমিটি (আরটিসি)। কমিটির সিদ্ধান্তে আপত্তি তুলেছে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন অটো-টেম্পু মালিক সমিতির নেতা ও পরিবহন সংশ্লিষ্টরা।
ইতোমধ্যে আরটিসি নগরীর গণপরিবহনের ওপর একটি জরিপ করেছে। ২০২২ সালে শুরু হওয়া এ জরিপের আওতায় নগরীর সবকয়টি রুটে চলাচলকারী যানবাহনকে আনা হয়।
জরিপ চালাতে সিএমপির উত্তর জোনে (ট্রাফিক) উপকমিশনার জয়নাল আবেদিনকে আহ্বায়ক করে আট সদস্যর কমিটি গঠন করা হয়। ট্রাফিকের দক্ষিণ জোনের উপকমিশনার নাসির উদ্দিনকে আহ্বায়ক করে হিউম্যান হলার ও পশ্চিম জোনের উপকমিশনার মোহাম্মদ তারেক আহম্মেদ আহ্বয়াক করে অটোটেম্পু জরিপ কমিটি গঠিত হয়।
২০২৩ সালের ২৩ মে আরটিসির এক সভায় নগরীর শৃঙ্খলা ফেরাতে জরিপের সুপারিশ উপস্থাপন করা হয়।
জরিপে কিছু অসঙ্গতি উঠে আসে। এর পরিপ্রেক্ষিতে আরটিসির সুপারিশের মধ্যে আছে—যেসব বাস, মিনিবাস, হিউম্যান হলার, ট্যাক্সি, টেম্পুর মডেল চিহ্নিত করা নেই, ইঞ্জিন নম্বর, চেসিস নম্বর ঘষামাজাসহ নানা ক্রটি আছে কিংবা জরিপের সময় হাজির করা হয়নি, সেসব যানবাহনের রুট পারমিট বাতিল করা।
সব মিলিয়ে ইঞ্জিন-চেসিস নম্বর না থাকা, ঘষামাজা থাকাসহ আরও কিছু কারণে প্রায় ৯০০ অটোটেম্পু বাতিলের সুপারিশ করা হয়েছে।
কিন্তু, জরিপটিকে 'মনগড়া ও উদ্দেশ্যেপ্রণোদিত' বলে দাবি করছে চট্টমেট্রো অটো টেম্পু মালিক সমিতির নেতা ও পরিবহন শ্রমিকরা। এ নিয়ে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কতৃর্পক্ষ (বিআরটিএ) বরাবর কয়েক দফা চিঠি চালাচালিও হয়েছে। গত ১৮ ফ্রেব্রুয়ারি সবশেষ আরটিসির সভাপতি সিএমপি কমিশনার বরাবর টেম্পুগুলোকে আগে দেওয়া ২০ বছর মেয়াদকাল পর্যন্ত চালু রাখার দাবি জানানো হয়েছে।
রুট পারমিট বাতিল ও ফিটনেস সনদ দিতে গড়িমসি করা হচ্ছে দাবি করে আজ রোববার চট্টমেট্রো অটো টেম্পু মালিক কল্যাণ সমিতি বিআরটিএ কার্যালয়ের সামনে মানববন্ধনও করে।
তাদের অভিযোগ, শুধু নির্দিষ্ট মডেলের কিছু অটোটেম্পুকে ঢালাওভাবে বাতিল করে দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া, জরিপ কমিটিতে অটোটেম্পুর কোনো প্রতিনিধিকেও রাখা হয়নি।
তারা বলছেন, রাস্তায় নতুন মডেলের গাড়ি নামানোর জন্য উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে এতগুলো অটোটেম্পু বাতিলের সুপারিশ করা হয়েছে।
টেম্পু কল্যাণ সমিতির নেতারা বলছেন, যে অজুহাতে টেম্পু বাতিলের সুপারিশ করা হয়েছে, সেই একই সমস্যা থাকলেও নগরীর বিভিন্ন রুটে চলছে বড় বাস ও হিউম্যান হলার চলছে। অথচ, জরিপে সেগুলোকে বাতিলের সুপারিশ করা হয়নি।
চট্টগ্রাম অটোটেম্পু মালিক কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক সাইদুল ইসলাম রনি দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'জরিপে আমাদের কোনো প্রতিনিধি ছিল না। এখন যেসব গাড়ি বাতিলের সুপারিশ করা হচ্ছে, আরটিসি কতৃর্পক্ষই সে গাড়িগুলোর মেয়াদকাল ২০ বছর নির্ধারণ করে দিয়েছিল। কিন্তু, এখন মেয়াদকাল শেষ হওয়ার আগেই গাড়িগুলো চলাচল বন্ধের শঙ্কা তৈরি হয়েছে।'
'ইঞ্জিন নম্বর, চেসিস নম্বরে ঘষামাজা থাকলে তাহলে কীভাবে বিআরটিএ আমাদের রুট পারমিটসহ অনান্য অনুমোদন দিলো এতদিন, রাজস্ব নিল কীভাবে,' প্রশ্ন করেন তিনি।
তিনি আরও বলেন, 'আমাদের এই গাড়িগুলো গ্যাসচালিত ও পরিবেশবান্ধব। আমাদের দুর্ঘটনার তেমন ইতিহাসও নেই। এ ছাড়া তেলের দাম বাড়ার পর যেখানে অন্যান্য গণপরিবহনে সর্বনিম্ন ভাড়া ১০ টাকা, আমাদের এই গাড়িগুলো এখনো সর্বনিম্ন ভাড়া পাঁচ টাকা রাখা হয়েছে, ভাড়া বাড়ানো হয়নি।'
সাইদুল ইসলাম বলেন, 'দিনে লাখো মানুষ আমাদের গাড়ি ব্যবহার করছেন, স্বল্প আয়ের মানুষজন আমাদের গাড়ির জন্য রাস্তায় অপেক্ষা করেন।'
সমিতির অর্থ সম্পাদক ফারুক মিয়া ডেইলি স্টারকে বলেন, 'টেম্পু বাতিলের সুপারিশ করা হয়েছে। কিন্তু এখানে ঘষামাজা হয়েছে কি না বা খোদাই করে কিছু লেখা হয়েছে কি না কিংবা চেসিস পরিবর্তন হয়েছে কি না, তা বিশেষজ্ঞ মতামত ছাড়াই ঢালাওভাবে বলা হচ্ছে, যা জরিপকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।'
'শুধু চট্টগ্রামে আরটিসির জরিপ আছে, যা বাংলাদেশের অন্য কোনো বিভাগে নেই। আমাদের গাড়িগুলো অপ্রশস্ত সড়কে চলাচল করে। এসব সড়কে বড় বাস কিংবা হিউম্যান হলার চলার জায়গা নেই। এই গাড়ি তুলে দিয়ে তিন চাকার ছোট গাড়ি নামলে কিংবা বড় গাড়ি নামলে তা হবে আত্মঘাতী। এখানে অন্যভাবে নতুন গাড়ি নামাতে ডিলারদের কারসাজি হচ্ছে,' দাবি করেন তিনি।
বহদ্দার থেকে চকবাজার-নিউমার্কেট রুটে চলা অটোটেম্পুর যাত্রী ফজলুল করিম মানিক ডেইলি স্টারকে বলেন, 'টেম্পুর ভাড়া কম, সহজে যাওয়া যায়। বেশি ছোট গাড়ি নামলে কিংবা হিউম্যান হলার নামলে সড়কে চাপ বাড়বে। সড়কে সঠিক ব্যবস্থাপনা কেউই নিশ্চিত করতে পারেনি আজ পর্যন্ত। তাই যাত্রীদের স্বার্থের কথা আগে চিন্তা করতে হবে।'
আরেক যাত্রী আসাদুজ্জামান রিপন বলেন, 'আমি নিউমার্কেট, চকবাজার, বায়েজিদ এলাকায় চলাচল করি। ভাড়া বেশি বাসে। টেম্পুর মাধ্যমে দ্রুত যাওয়া যায়। তবে এখন হুট করে টেম্পু বন্ধ করে দিলে তা সামাল দেওয়াই চ্যালেঞ্জিং হবে।'
আরটিসি জরিপের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে নগরীর অক্সিজেন মোড় থেকে চকবাজার হয়ে বারেক বিল্ডিং মোড় (এক নম্বররুট) পর্যন্ত ১৪০টি গাড়ি চলাচল করছে, যেখানে বাতিলের সুপারিশ হয়েছে ১৩৭টি। বায়েজিদ থেকে দুই নম্বর গেট টাইগার পাস পর্যন্ত (দুই নম্বর রুট) ১৫০টি গাড়ি চলাচল করছে, যেখানে বাতিলের সুপারিশ হয়েছে ৯৪টি, নিউমার্কেট থেকে দেওয়ানহাট হয়ে হালিশহর পর্যন্ত (তিন নম্বর রুট) ৯৪টি গাড়ি চলাচল করছে, সেখানে বাতিলের সুপারিশ হয়েছে সবকয়টি।
কালুরঘাট থেকে আমতল পর্যন্ত (পাঁচ নম্বর রুট) ৭০টি গাড়ি চলাচল করছে, বাতিলের সুপারিশ হয়েছে ৫১টি। সাগরিকা থেকে ছোটপুল (ছয় নম্বর রুট) চলাচল করছে ১৫টি গাড়ি, বাতিলের সুপারিশ হয়েছে ১৩টি। কানুঙ্গপাড়া থেকে বহদ্দারহাট পর্যন্ত চলাচল করছে (আট নম্বর রুট) ৭৪টি গাড়ি, বাতিলের সুপারিশ করা হয়েছে সবকয়টি।
আলমাস থেকে ওয়াসা হয়ে এ কে খান পর্যন্ত চলাচল করছে ২০টি গাড়ি, সবকয়টি বাতিলের সুপারিশ করা হয়েছে। বহদ্দারহাট বাস টার্মিনাল থেকে মদুনাঘাট (১৪ নম্বর রুট) ৬০টি গাড়ি চলাচল করে, যেখানে সবকয়টি গাড়ির বাতিলের সুপারিশ হয়েছে। ফতেয়াবাদ থেকে অক্সিজেন হয়ে মেডিকেল গেট পর্যন্ত (১৬ নম্বর রুট) ৭০টি গাড়ি চলাচল করে, সেখানে ৬১টি গাড়ি বাতিলের সুপারিশ করা হয়েছে।
সমিতির সাধারণ সম্পাদক সাইদুল ইসলাম বলেন, 'আমাদের চালক-শ্রমিক মিলিয়ে হাজারো মানুষ এর সঙ্গে জড়িত। জরিপে বড় বাসগুলো, যারা টায়ার-চেসিস কিংবা ইঞ্জিন পরিবর্তন করেছে, তাদের বিষয়ে কিছুই বলা হয়নি। এমনকি খোদাইকৃত কিংবা অস্পষ্ট তালিকার আওতাও আনা হয়নি তাদের।'
জানতে চাইলে অটোটেম্পু জরিপ কমিটির আহ্বায়ক সিএমপির পশ্চিম জোনের উপকমিশনার (ট্রাফিক) মোহাম্মদ তারেক আহম্মেদ দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এখানে পক্ষপাতের কিছু নেই। আমরা অনেক ধরনের অসঙ্গতি পেয়েছি। গাড়ির বডির সঙ্গে চেসিসের মিল নেই, ঘষামাজা, অনেক গাড়ির চেসিস খোদাইকৃত পাওয়া গেছে। এগুলো বিআরটিএর অনুমতি ছাড়া করা হয়েছে।'
এসব গাড়ি তাহলে কীভাবে ২০২৩ সালে বিআরটিএ থেকে ফিটনেস সার্টিফিকেট কিংবা রুট পারমিট পেল, জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'আমাদের সঙ্গে তারাও (বিআরটিএ) ছিলেন। তবে কীভাবে তারা অনুমোদন দিয়েছেন, তারাই ভালো বলতে পারবেন। তবে তারা যখন আপত্তি জানিয়েছেন, তাই আমরা কিছু জিনিস ছাড় দিয়ে প্রায় ছয় মাস সময় দিয়েছি, যেন তারা বিআরটিএর মাধ্যমে ত্রুটিগুলো সারিয়ে নিতে পারেন।'
তিনি বলেন, 'সড়কে এখন বিভিন্ন জায়গায় ছোট থ্রি-হুইলার কিংবা অন্যগাড়ি চলছে এবং বিভিন্নভাবে রাস্তায় প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে। আমরা সড়ক থেকে ছোট গাড়িয়ে উঠিয়ে বড় এবং বেশি সংখ্যক যাত্রী পরিবহন করতে পারে এমন বিকল্প যানের কথা বলেছি। কোম্পানির মাধ্যমে বাসের যাত্রীসেবাকে একটি জায়গায় আনার কথা বলেছি।'
চট্টগ্রাম বিআরটিএর পরিচালক শফিকুজ্জামান ভূঞা সম্প্রতি বদলি হয়ে যাওয়ায় এ বিষয়ে তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
টেম্পু চলাচল বন্ধের বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম বিআরটিএর উপপরিচালক সৈয়দ আইনুল হুদা চৌধুরী ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এটি প্রক্রিয়াধীন একটি বিষয়। আরটিসি সুপারিশ করেছে। এটা বিআরটিসি কিছু নয়। তারপরও আমরা টেম্পু মালিকদের কারণ দর্শানোর নোটিশ দেবো। যদি তারা প্রমাণ করতে পারেন তারা সঠিক, তাহলে আর ঝামেলা থাকবে না।'
'অন্যদিকে সুপারিশ করলেই যে আবার বাতিল হয়ে যাচ্ছে এটিও নয়। তারপরও তাদের বক্তব্য অনুযায়ী কমিটির মাধ্যমে আলোচনা করে ব্যবস্থা নেব আমরা', যোগ করেন তিনি।
Comments