ঢাকায় এখনো যেখানে ১৫ টাকায় একবেলা খাওয়া যায়

কারওয়ান বাজার কাঁচামালের আড়তের ফুটপাতে রুটি-সবজির দোকান। ছবি: প্রবীর দাশ/স্টার

দুই বছর আগেও ঢাকা শহরে যে পরোটার দাম ছিল ৫ টাকা, সেটি এখন বিক্রি হয় ১০ টাকায়। যেসব রেস্তোরাঁয় পরোটার দাম বাড়েনি সেসব রেস্তোরাঁয় পরোটা আকারে ছোট হয়েছে। যে সবজির দাম ছিল ১০ টাকা সেটি এখন বিক্রি হয় ২০-৩০ টাকায়।

কোভিড-১৯ মহামারির পর থেকে পেঁয়াজ, রসুন থেকে শুরু করে মৌসুমি সবজি, ভোজ্যতেল এমনকি জ্বালানির দাম অনেকটাই বেড়েছে। এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে হোটেল-রেস্তোরাঁয় খাবারের দাম। ক্রেতা হারানোর ঝুঁকি বিবেচনায় যেসব রেস্তোরাঁয় সেভাবে দাম বাড়াতে পারেনি সেখানে খাবারের মান ও পরিমান কমেছে।

দ্রব্যমূল্যের এই ঊর্ধ্বগতিতে দুবেলা ভাতের বদলে রুটি-সবজি খেয়ে দিন কাটাচ্ছেন রিকশাচালক জিতেন চন্দ্র দাস (৩৬)।

রাজধানীর তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল এলাকায় রিকশা চালান তিনি। কয়েক বছর আগেও দিনে দুবেলা রিকশা চালাতে পারতেন। এখন শারীরিক অসুস্থতার কারণে এক বেলা চালান।

প্রতিদিন দুপুর ও রাতে দুবেলা কারওয়ান বাজার কাঁচামালের আড়তের ফুটপাতে একটি খাবার দোকানে খেতে আসেন জিতেন। এই দোকানে ১০ টাকায় রুটি ও ৫ টাকায় সবজি খেতে তার মতো অনেকেই ভিড় করেন।

তার ভাষায়, 'এক বেলা রিকশা চালিয়ে যে টাকা পাই তাতে খরচ বেশি করার সুযোগ নাই। ভাত খেতে গেলে কমে হলেও প্রতিবেলায় ৬০ টাকা লাগে আর একটু ভালো খেতে গেলে ১০০ টাকার নিচে হয় না।'

কারওয়ান বাজারে কাঁচামালের আড়তের ফুটপাতের রুটি-সবজির দোকানগুলোতে সারাদিনই ক্রেতার ভিড় থাকে। ছবি: প্রবীর দাশ/স্টার

দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতির মধ্যেও কারওয়ান বাজারের ফুটপাতের দোকানে ১৫ টাকায় রুটি ও সবজি দিয়ে পেট ভরানো যায়।

দীর্ঘ ৩০ বছর ধরে দোকানটি চালাচ্ছেন বাবুল মিয়া ও তার স্ত্রী রাহেলা। এই দম্পতি জানান, প্রতিদিন ১৫ থেকে ২০ কেজি আটার রুটি বানিয়ে বিক্রি করেন তারা। সপ্তাহে ৭ দিনই সকাল ৮টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত দোকান খোলা থাকে।

'প্রথম যখন দোকান চালু করি তখন এক টাকায় রুটি বিক্রি করতাম। আমি আর আমার স্ত্রী মিলে দোকান চালাই। প্রতিদিন সকাল ৮টা পর্যন্ত ফুটপাতের এই জায়গায় আড়ত বসে। সে কারণে আমরা ৮টা পর্যন্ত অপেক্ষা করি। আড়তের মালামাল সরে গেলে খাবার বিক্রি শুরু হয়। রাত ১০টায় উঠে যাই,' দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন বাবুল মিয়া।

শুধু বাবুল-রাহেলা নন, একই ফুটপাতে ১৫ টাকায় রুটি-সবজি বিক্রি করেন শাহজাহান-ফাতেমা দম্পতিও। দীর্ঘ ১২ বছর ধরে দোকান চালাচ্ছেন তারা।

ফাতেমা বেগম দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমি ও আমার স্বামী করোনার ৬-৭ মাস আগেও প্রতিদিন ৮ থেকে ১০ কেজি আটার রুটি বিক্রি করতাম। তখন একটি রুটি ও এক বাটি সবজির দাম ছিল ১০ টাকা। এই চার বছরে দাম বাড়িয়ে ১৫ টাকা করেছি। ক্রেতাদের চাহিদার কথা ভেবেই এর চেয়ে বেশি বাড়াইনি। দাম কম রাখায় বিক্রি বেড়েছে। এখন প্রতিদিন ১৬ থেকে ২০ কেজি আটার রুটি বিক্রি করি।'

কীভাবে এত সস্তায় বিক্রি করেন, জানতে চাইলে শাহজাহান বলেন, 'আমরা কিছু ক্ষেত্রে সাশ্রয় করি। যেমন—লাল আটা নিই। খুচরা বাজারে এই আটা ৪৫ থেকে ৫০ টাকা বিক্রি হলেও আমরা পাইকারি দরে ৩৮-৪০ টাকায় পাই। সবজি কিনি ভোরবেলায়। যখন আড়তে বেচা-কেনা শেষ হয়ে যায় তখন অনেক ভাঙা, ফাটা সবজি থাকে। ওগুলো কম দামে পাওয়া যায়।'

শাহজাহান আরও বলেন, 'ট্রাকে করে আনার সময় অনেক সবজি চাপে ফেটে যায়। এগুলো ঠিকঠাকভাবে কেটে পরিষ্কার করে রান্না করা যায়। বাজারে ফুলকপির দাম ৩০-৪০ টাকা, আমরা কিনি ১০-১২ টাকায়। বাঁধাকপি ও মিষ্টিকুমড়াও কম দামে পাওয়া যায়। তবে খাবারের স্বাদ নিয়ে কখনো কোনো ক্রেতার অভিযোগ পাইনি।'

অন্যদিকে, বাসা থেকে সবজি রান্না করে আনায় ও মাটির চুলায় রুটি বানানোর কারণে গ্যাস বা কেরোসিনের খরচও নেই তাদের।

শাহজাহান বলেন, 'সবজিটা আমরা বাসা থেকে নিয়ে আসি। কিছু সময় পর পর গরম করে নিই। আর রুটিটা মাটির চুলায় ক্রেতাদের সামনেই সেঁকা হয়। গ্যাসে রান্না করতে হলে দুদিনেই একটা সিলিন্ডার চলে যেত। দিনে ৮০০ টাকার গ্যাস লাগত। এখন আমরা ২০০ টাকায় লাকড়ি নিই, অনেক সময় তিন দিনও চলে। এ লাকড়িটা মূলত কারওয়ানবাজারসহ বিভিন্ন জায়গায় ভাঙাচোরা যেসব কাঠ, বোর্ড পাওয়া যায় সেগুলোই। দিনে ৫০ থেকে ১০০ টাকার বেশি লাগে না।'

তিনি জানান, দৈনিক আড়াই হাজার টাকার বিক্রি হলে ৮০০ টাকার মতো লাভ হয় তাদের।

তবে পরিশ্রমের তুলনায় এই লাভ খুবই সামান্য। কারণ প্রতিদিনই এই দম্পতিকে সকাল ৮টায় দোকান চালু করে রাত ১০টা পর্যন্ত চালাতে হয়। দুজনকেই সারাদিন দোকানের সব কাজ সামাল দিতে হয়। কাউকে কাজে রাখবেন সেই উপায়ও নেই। একজন প্লেট ধুয়ে দেয় তো অন্যজন রুটি সেঁকেন—এভাবেই সমস্ত কাজ করেন এই দম্পতি।

এর পাশেই আরেক বিক্রেতা ২০ টাকায় রুটি-ভাজি বিক্রি করেন। দাম অন্যদের চেয়ে পাঁচ টাকা বেশি কেন জানতে চাইলে নূরে আলম বলেন, 'এক মাস ধরে অন্যদের দেখাদেখি দোকানে বসছি। আগে বেকার ছিলাম। আমি অন্যদের তুলনায় ভালো আটা ব্যবহার করি। সাদা আটার দাম একটু বেশি। দিনে আমার মোটামুটি ৫০০ টাকার মতো লাভ হয়।'

এই দোকানগুলোতে যারা খেতে আসেন তারা সবাই নিয়মিত গ্রাহক। মূলত রিকশাচালক, দিনমজুর, কুলি, ফুটপাতের হকার ও ভ্যানচালকই তাদের ক্রেতা। অনেকে ফুটপাতে বসে খান, অনেকে আবার প্যাকেটে করে বাসায় নিয়ে যান।

শুধু রুটি-সবজিই নয়, কারওয়ান বাজারের এই দোকানগুলোতে পাওয়া যায় ডিম ও গুড়। কেউ গুড় দিয়ে রুটি খান, কেউ খান ডিম দিয়ে।

রিকশাচালক রফিকুল ইসলাম বলেন, 'আমি কয়েক বছর ধরেই এখানে খাই। সবসময় চেষ্টা করি এক বেলা এখানে খেতে। প্রতিদিন পারি না। মাঝে মাঝে এদিকের যাত্রী পেলে আসি। দুপুরের খাওয়ার জন্য দুইটা রুটি-সবজির দাম ২৫ টাকা পড়ে। আর সঙ্গে ডিম ভাজা খেলে আরও ২০ টাকা দিতে হয়।'

খাবারের মান নিয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'হোটেলের খাবারের মতোই স্বাদ। ২৫-৩০ টাকার সবজির সঙ্গে পাঁচ টাকার সবজির তুলনা হয় না। কিন্তু খাওয়া যায়। এখানে খেয়ে কারো পেট খারাপ হয়েছে এমনটা কখনো শুনিনি।'

Comments

The Daily Star  | English
The Indian media and Bangladesh-India relations

The Indian media and Bangladesh-India relations

The bilateral relationship must be based on a "win-win" policy, rooted in mutual respect, non-hegemony, and the pursuit of shared prosperity and deeper understanding.

13h ago