‘টাঙ্গাইলের তাঁতের শাড়ি’র স্বত্ত্ব ভারত নেওয়ার পর আমাদের ঘুম ভাঙলো কেন?

আমরা চাই বাংলাদেশ সরকার এখনই বিশ্ব মেধাসম্পদ সংস্থায় এ বিষয়ে অভিযোগ জানাক। যে যা খুশি দাবি জানালেই তো সেটা তার হয়ে যাবে না। আন্তর্জাতিক আইন বলে কি কিছু নেই?

যদি বলি 'দেশি পণ্য কিনে হও ধন্য' শ্লোগানটি বাজারে এসেছে টাঙ্গাইল শাড়ির হাত ধরে, তাহলে খুব একটা ভুল বলা হবে না। সেই আশির দশকে যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তাম, তখন খুব অল্প দামে ভালো শাড়ি বলতে আমাদের কাছে পরিচিত ছিল টাঙ্গাইলের শাড়ি।

ধনেখালি, পাছাপেড়ে, সুতার ও জরির চওড়া পাড়ের টাঙ্গাইল শাড়ি এ দেশের মেয়েদের কাছে খুব প্রিয়। সেসময়ে বাজারে ভারতীয় শাড়ির প্রাদুর্ভাব ছিল কম। কোনো কোনো দোকানে ভারতীয় শাড়ি থাকলেও দাম বেশি ছিল বলে অনেকেই খুব একটা কিনতো না।

এরও আগে সত্তরের দশকে বাবার হাত ধরে নিউমার্কেটে গিয়ে আম্মার জন্য শাড়ি কিনতাম—চেক চেক বুটি বুটি। টাঙ্গাইলের বড় বড় চেককাটা শাড়িতে সুতার বুটি তোলা থাকতো। সেই শাড়ি ছিল খুব জনপ্রিয়। আশির দশক থেকেই আড়ং, নিপুণ, তাঁতঘর, টাঙ্গাইল শাড়িকুটির, ভূষণ ইত্যাদি দোকানে ছিল টাঙ্গাইলের সুতি শাড়ির রমরমা ব্যবসা।

ক্রমশ টাঙ্গাইলের সিল্ক ও সুতি কোটা শাড়ি, মসলিন ও সিল্ক শাড়ি বাজারে জনপ্রিয়তার শীর্ষে উঠে গেল। ২০০ টাকা থেকে শুরু করে ১ হাজার ২০০, ১ হাজার ৫০০ টাকায় অনবদ্য সব ডিজাইনের শাড়ি পরেছি। এভাবেই গড়ে উঠলো বেইলি রোডের জমজমাট টাঙ্গাইলের শাড়ি পাড়া।

টাঙ্গাইল শাড়িকুটির গড়ে ওঠে মনিরা এমদাদের হাতে। তিনিই ১৯৮২ সালে একটি টিনশেডে এই দোকান শুরু করেছিলেন। অনেক কষ্ট করে টাঙ্গাইল থেকে তাঁতিরা মুনিরা দিদিমণির কাছে সেইসময় শাড়ি পৌঁছে দিতো।

এই টাঙ্গাইলের শাড়ি নিয়ে যখন বাংলাদেশ খুব গর্বিত এবং এর আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাজার সৃষ্টি করছে, ঠিক সেইসময় ভারত আচানক দাবি করে বসলো যে টাঙ্গাইলের শাড়ি পশ্চিমবঙ্গের সম্পত্তি। অথচ শাড়িটির নাম টাঙ্গাইলের শাড়ি, সেই টাঙ্গাইল বাংলাদেশের একটি জেলা। কাজেই এখানেই টাঙ্গাইল শাড়ির জন্মস্থান, পশ্চিমবঙ্গে নয়।

তাহলে ভারত এর স্বত্ত্ব দাবি করছে কোন যুক্তিতে এবং কেন? আর দাবি যদি করেই থাকে, তাহলে আন্তর্জাতিকভাবে তারা এটা প্রমাণ করবে কেমন করে?

ভারতের এই অদ্ভূত দাবির কারণে টাঙ্গাইল শাড়ি নিয়ে হঠাৎ পরিস্থিতি গরম হয়ে উঠেছে। ইতোমধ্যে ভারতের ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য (জিআই) হিসেবে টাঙ্গাইল শাড়িকে নিবন্ধন করে নিয়েছে। কাজেই বিষয়টি নিয়ে চলছে তুমুল আলোচনা-সমালোচনা।

ভারতীয় শাড়ির বাজার বিশ্বজুড়ে খুবই জমজমাট। প্রতিটি প্রদেশের রয়েছে আলাদা আলাদা শাড়ি। তাই প্রশ্ন জাগছে হঠাৎ করে বাংলাদেশের টাঙ্গাইল শাড়িকেও তাদের কেড়ে নিতে হচ্ছে কেন? এটাই কি তবে কবিগুরুর ভাষায়, 'এ জগতে হায় সেই বেশি চায়, আছে যার ভুরি ভুরি।'

ভারতের সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজ থেকে দেওয়া পোস্টে দাবি করা হয়, টাঙ্গাইলের শাড়ির উৎপত্তি ভারতের পশ্চিমবঙ্গে। তারা দাবি করেছে 'টাঙ্গাইল শাড়ি পশ্চিমবঙ্গ থেকে উদ্ভূত একটি ঐতিহ্যবাহী হাতে বোনা মাস্টারপিস। এর মিহি গঠন, বৈচিত্র্যময় রঙ এবং সুক্ষ জামদানি মোটিফের জন্য বিখ্যাত এই অঞ্চলের সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের প্রতীক।'

এই শিল্পের সঙ্গে যারা সম্পৃক্ত তারা বলেছেন, এই শাড়ির উৎপত্তিস্থল হিসেবে সুনির্দিষ্টভাবে উঠে আসছে পাথরাইল, নলশোধা, ঘারিন্দাসহ টাঙ্গাইলের এমন ২২-২৩টি গ্রামের নাম। একসঙ্গে একে 'বাইশগ্রাম' বলে চিহ্নিত করা হতো। এসব গ্রামই ঠিকানা ছিলো তাঁতিদের। যাদের পদবি ছিল 'বসাক'। এই বসাকদের অনেককে আমরা ব্যক্তিগতভাবে চিনি। ঈদে-পর্বণে আমরা কেউ কেউ বসাক পল্লীতে গিয়ে একসঙ্গে অনেক শাড়ি কিনে আনি, দামে কম পাই বলে।

সেই তাঁতি ভাইরাই আমাদের বলেছেন, শুধু বাংলাদেশের এই বাজারেই তারা শাড়ি বিক্রি করেন না, পশ্চিমবঙ্গেও তাদের শাড়ির ব্যাপক চাহিদা। ট্রাক ভরে তারা রপ্তানি করেন। তারা এও জানিয়েছেন, ভারতের বাংলা সিরিয়ালের অভিনেত্রীদের কাছে তাদের শাড়ির অনেক চাহিদা। কারণ, দক্ষিণ ভারতের সুতি পাড়ের শাড়ির দাম অনেক বেশি পড়ে যায়। সেই তুলনা বাংলাদেশের শাড়ি সস্তা। তাই বাংলাদেশ থেকে সেদেশে শাড়ি রপ্তানি হয়।

প্রায় ২০০ বছরের প্রাচীন করটিয়া হাট টাঙ্গাইল শাড়ি বিক্রির প্রধান কেন্দ্র। আছে বাজিতপুরের হাট। ঈদ মৌসুমে এই হাটগুলোতে কয়েকশ কোটি টাকার শাড়ি বেচাকেনা হয়। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পাইকাররা এসে এখান থেকে শাড়ি কিনে থাকেন। হাটে শাড়ির দাম কম পড়ে বলে অনেকে ব্যক্তিগত উদ্যোগেও এখানে গিয়ে লটে শাড়ি কিনে আনেন। টাঙ্গাইল শাড়ির এই সুদীর্ঘ ঐতিহ্য ও ইতিহাস কবে থেকে ভারতের হলো এটা খুবই অস্পষ্ট। টাঙ্গাইলের শাড়ি বাংলাদেশের অন্যতম পুরনো একটি কুটির শিল্প।

ব্রিটিশ আমল থেকে এই শাড়ি বাংলাদেশে বোনা হয়। ১৯০৬ সালে মহাত্মা গান্ধীর স্বদেশি আন্দোলনের লক্ষ্য ছিল ইংল্যান্ডের তৈরি কাপড় ও পণ্য বর্জন। সেই ডাকে আপামর জনসাধারণের সাড়া দিয়েছে। মায়ের দেওয়া মোটা কাপড় মাথায় তুলে নেওয়ার লক্ষ্যে সেই সময়ে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে তাঁত শিল্প প্রসার লাভ করেছিল। কুমিল্লার খদ্দরসহ তাঁতশিল্পের এই প্রসার ব্রিটিশ আমলে অর্থাৎ পাকভারত উপমহাদেশে শুরু হয়েছিল বলে কি আজকে মেনে নিতে হবে যে টাঙ্গাইল শাড়ি পশ্চিমবঙ্গের?

টাঙ্গাইলের তাঁতিরা এই ব্যবসার উপরই নির্ভরশীল। সবচেয়ে পুরনো তাঁতি সম্প্রদায় হলো টাঙ্গাইলের পাথরাইলের বসাক সম্প্রদায়। এখনো বসাকদের তাঁতিপাড়া সবাই একনামে চেনেন। বসাকরাই বলেছেন, দেশভাগ ও মুক্তিযুদ্ধের সময় তাদের অনেকেই ভারতে চলে গেছেন। কেউ কেউ পরেও গেছেন। তারা সেখানে নানাধরণের কাজে জড়িত হলেও এখনো শাড়ি বুননের কাজ করেন।

ভারত কেন টাঙ্গাইলের তাঁতের শাড়িকে নিজেদের বলে দাবি করছে, এর উত্তর পাওয়া গেল বিবিসি বাংলার রিপোর্টে। বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁতশিল্প নিয়ে গবেষণা করেন নিলয় কুমার বসাক। তিনিও ওই তন্তুবায় সম্প্রদায়ের উত্তর প্রজন্ম। তিনি বলেছেন, '১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর বসাক সম্প্রদায়ের বড় অংশই ভারতে চলে যান। তাদের ভিড়টা বেশি হয় নদীয়া জেলার ফুলিয়া গ্রাম এবং পূর্ব বর্ধমানের ধাত্রী গ্রাম ও সমুদ্রগড়ে।' তাদের বদৌলতে নদীয়া ও পূর্ব-বর্ধমানে 'টাঙ্গাইল শাড়ি' পরিচিতি লাভ করে বলে তিনি মনে করেন।

কিন্তু, প্রশ্ন উঠছে উৎপত্তিস্থল টাঙ্গাইলের নাম ধারণ করার পরও ভৌগলিকভাবে অন্য স্থানের পণ্য হিসেবে বিবেচনা করা যায় কি না? এর জবাবে গবেষক নিলয় বসাক বলেছেন 'দেশভাগের বলি হয়ে ভারতে চলে এলেও "টাঙ্গাইল" শব্দটি ছিল বসাক তাঁতিদের অস্থিমজ্জাগত। ফলে উদ্বাস্তু এই তাঁতিরা নিজেদের বয়নীকৃত শাড়ির নাম বা বয়ন কৌশল পরিবর্তন করার কথা কল্পনাও করেননি।'

কিন্তু এ ব্যাপারে ভিন্ন মত পোষণ করেন বাংলাদেশের ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের (বিসিক) বিপণন শাখার মহাব্যবস্থাপক অখিল রঞ্জন তরফদার। তিনি এ খবরে 'বিস্মিত' হয়ে বলেন, এটা যৌক্তিক নয়। এটার নামই কিন্তু জিওগ্রাফিক্যাল, অর্থাৎ, ভৌগোলিক অবস্থানের ওপর ভিত্তি করে এই পণ্যটার স্বীকৃতি। এখানে ব্যক্তির কোনো বিষয় নেই। যারা আগে চলে গেছেন, তারা এমন দাবি করে করলে এটা একটু খটকাই লাগে। শাড়িটার উৎপত্তিস্থল যেহেতু টাঙ্গাইলে, এখানেই এর উৎকর্ষ সাধিত হয়েছে, তাই এই স্থানের ভিত্তিতেই এটার স্বীকৃতি হওয়া উচিত। মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালেয়ের এই বিষয়ক গবেষক সুব্রত ব্যানার্জি ও সুমনা শারমিনও এই ধারণাটাকেই সমর্থন করেন। অবশ্য, নিলয় কুমার ও হরিপদ বসাকও এ বিষয়ে বিতর্কের অবকাশ থেকে যায় বলে মনে করেন। (সূত্র: বিবিসি বাংলা)

বাংলাদেশ তাঁত বোর্ডের সদস্য গাজী মো. রেজাউল করিম গণমাধ্যমকে বলেছেন, টাঙ্গাইল শাড়ি একটি বাংলাদেশি পণ্য। এর উৎপত্তি পশ্চিমবঙ্গ বলে করা দাবিটি পুরোপুরি মিথ্যা। হরিপদ বসাক টাঙ্গাইলের তাঁতিদের বংশধর। তার জন্ম ও বেড়ে ওঠা 'পূর্ব বাংলা'য় হলেও বর্তমানে বসবাস করছেন পশ্চিম বঙ্গের নদীয়ায়। তিনি জানিয়েছেন, '২০১১ সালেও ভারতের পক্ষ থেকে একবার টাঙ্গাইল শাড়ির জন্য জিআই আবেদন করা হয়েছিল। সেই আবেদনটি বাতিল হয়ে গিয়েছিল। তারপরও চেষ্টা চালিয়ে গেছে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ। ফল পেয়েছে ২০২৪ সালে এসে।'

এতদিন ধরে ভারত যদি এই চেষ্টা চালিয়ে যায়, তাহলে আমরা কেন এর বিন্দু-বিসর্গও টের পেলাম না? বিষয়টি ভারত নিয়ে নেওয়ার পর আমাদের ঘুম ভাঙলো কেন? আমরাতো স্পষ্টতই জানি টাঙ্গাইল শাড়ির ইতিহাস। অবিভক্ত ময়মনসিংহের মহকুমা টাঙ্গাইলের নামানুসারে এই শাড়ি টাঙ্গাইল শাড়ি পরিচিতি লাভ করে। যতোই তাঁতিরা মাইগ্রেশন করুন, যতোই নদীয়ায় গিয়ে টাঙ্গাইলের শাড়ি তৈরি করুন না কেন, টাঙ্গাইল শাড়ি কোনোভাবেই পশ্চিমবঙ্গের হতে পারে না।

আমরা চাই বাংলাদেশ সরকার এখনই বিশ্ব মেধাসম্পদ সংস্থায় এ বিষয়ে অভিযোগ জানাক। যে যা খুশি দাবি জানালেই তো সেটা তার হয়ে যাবে না। আন্তর্জাতিক আইন বলে কি কিছু নেই?

শাহানা হুদা রঞ্জনা, যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও কলাম লেখক

 

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)

Comments

The Daily Star  | English
Impact of esports on Bangladeshi society

From fringe hobby to national pride

For years, gaming in Bangladesh was seen as a waste of time -- often dismissed as a frivolous activity or a distraction from more “serious” pursuits. Traditional societal norms placed little value on gaming, perceiving it as an endeavour devoid of any real-world benefits.

18h ago