বাড়ি ভাড়া বেড়ে যাওয়ায় বাড়তি চাপ

রাজধানীর বনশ্রী এলাকায় বাড়ি বদলাচ্ছে এক পরিবার। ছবি: শেখ এনামুল হক

চলতি অর্থবছরের অক্টোবর থেকে ডিসেম্বরে দেশে বাড়ি ভাড়া গড়ে পাঁচ দশমিক ৮৯ শতাংশ বেড়ে যাওয়ায় নিম্ন ও মধ্যম আয়ের মানুষদের ওপর বাড়তি চাপ তৈরি হয়েছে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) বাড়ি ভাড়া সূচকে (এইচআরআই) বলা হয়েছে—২০২৩-২৪ অর্থবছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে বাড়ি ভাড়া আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় শূন্য দশমিক শূন্য তিন শতাংশ পয়েন্ট বেড়েছে।

এই প্রবৃদ্ধি আগের প্রান্তিকের তুলনায় কম। তখন বাড়ি ভাড়ার গড় বৃদ্ধি ছিল ছয় দশমিক ৮১ শতাংশ।

পাকা, আধা-পাকা এবং কাঁচা ও ঝুপড়িঘর—এই তিন ধরনের বাড়ির ভাড়া নিয়ে পরিসংখ্যান ব্যুরো বাড়ি ভাড়ার হালনাগাদ তথ্য প্রকাশ করেছে।

এইচআরআইয়ের তথ্য অনুসারে, গত অক্টোবর-ডিসেম্বর কাঁচাঘর বিভাগে ভাড়া সবচেয়ে বেশি বেড়েছে। সূচক বেড়ে হয়েছে ১১২ দশমিক ৪৭। এটি এর আগের বছরে একই সময়ের তুলনায় প্রায় সাড়ে ছয় শতাংশ বেশি।

একইভাবে, টিনেরঘর বিভাগের দ্বিতীয় প্রান্তিকে সূচক বেড়েছে ১১০ দশমিক ৮১। এটি আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় ছয় দশমিক চার শতাংশ বেশি।

ভোক্তা মূল্য সূচকের খাবার-বহির্ভূত বিভাগে বাড়ি ভাড়া অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। ক্রমবর্ধমান বাড়ি ভাড়া নিম্ন ও নির্দিষ্ট আয়ের মানুষের ওপর চাপ বাড়াচ্ছে। চলমান মূল্যস্ফীতির সঙ্গে এটি বাড়তি চাপ তৈরি করছে।

ঢাকার খিলগাঁওয়ে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরিজীবী মোস্তাফিজুর রহমান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমাকে বলা হলো জানুয়ারি থেকে ভাড়া ১৪ শতাংশ বেড়ে ১২ হাজার টাকা হবে। ফলে আমার চার সদস্যের পরিবারের ওপর আর্থিক চাপ বেড়ে গেছে।'

বাংলাদেশ ভাড়াটিয়া পরিষদের সভাপতি বাহারানে সুলতান বাহার ডেইলি স্টারকে বলেন, 'ইচ্ছামতো ভাড়া বাড়িয়ে ভাড়াটিয়াদের চাপে ফেলার সুযোগ বাড়িওয়ালাদের আছে। কারণ দেশে বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইন, ১৯৯১ থাকলেও বাস্তবে এর তেমন প্রয়োগ নেই।'

আইন অনুসারে, কোনো বাড়ির ভাড়া নির্ধারিত পয়েন্ট অতিক্রম করলে চুক্তিতে অন্যকিছু উল্লেখ না থাকলে অতিরিক্ত ভাড়া আদায়যোগ্য হবে না।

আইনের ৩ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, একটি নির্দিষ্ট এলাকায় একজন নিয়ন্ত্রক ও উপ-নিয়ন্ত্রক থাকবে। তাদেরকে ভাড়া নির্ধারণের ক্ষমতা দেওয়া হবে।

'কিন্তু আমরা এর বাস্তবায়ন দেখতে পাইনি' বলেন মন্তব্য করেন ভাড়াটিয়া পরিষদের সভাপতি।

স্থানীয় প্রতিষ্ঠান বিপ্রপার্টির তথ্য অনুসারে—ঢাকার বসুন্ধরা আবাসিক, ধানমন্ডি, বনশ্রী ও রামপুরায় বাড়ি ভাড়া বেড়েছে সর্বোচ্চ ১৪ থেকে ২০ শতাংশ পর্যন্ত।

একইভাবে বাড্ডা, মিরপুর ও মোহাম্মদপুর এলাকায় বাড়ি ভাড়া বেড়েছে সাত থেকে আট শতাংশ।

বিপ্রপার্টির মহাব্যবস্থাপক খান তানজিল আহমেদ মনে করেন, 'ঢাকায় বাড়ি ভাড়া বেড়ে যাওয়ার পেছনে মূল কারণ যোগাযোগ ব্যবস্থা ও বাড়তি সুযোগ।'

যেহেতু ঢাকায় অবকাঠামোগত পরিবর্তন চলছে সেহেতু ভালো যোগাযোগ ব্যবস্থা থাকা আবাসিক এলাকাগুলোয় বাড়ির চাহিদা বেশি। এটি বাড়ি ভাড়ার সামগ্রিক বৃদ্ধিতে অবদান রাখছে।

তিনি ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে ও মেট্রোরেল রাজধানীর কয়েকটি এলাকায় বাড়ি ভাড়ায় বেশ প্রভাব ফেলেছে।'

'উচ্চ মূল্যস্ফীতির মধ্যে বাড়ি ভাড়া বৃদ্ধি ভাড়াটিয়াদের কাছে টার্নিং পয়েন্ট হয়ে দাঁড়িয়েছে' উল্লেখ করে কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহ-সভাপতি এস এম নাজের হোসেন ডেইলি স্টারকে বলেন, 'কম ও নির্দিষ্ট আয়ের মানুষ যখন খাবার ও খাবার-বহির্ভূত পণ্যের বাড়তি দামের কারণে সমস্যায় ডুবে আছে তখন বাড়ি ভাড়ার বাড়তি টাকা যোগাতে তারা অন্য খরচ কমাতে বাধ্য হচ্ছেন।'

আয় না বাড়ায় খরচ কমাতে অনেকে তাদের পরিবারের সদস্যদের গ্রামে পাঠিয়ে দিচ্ছেন।

এ ছাড়াও, মূল্যস্ফীতির চাপে সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় ধার-দেনা করে চলার সুযোগও কমে গেছে। অনেকের কাছেই তাই খরচ কমানো ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই।

তিনি আরও বলেন, গত এক বছরে ভোগ্যপণ্যের দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাওয়ায় মানুষ বিপাকে পড়েছেন। সাধারণ মানুষের কথা চিন্তা করে সরকারকে মূল্যস্ফীতি কমাতে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে।'

তার মতে, 'বাড়ি ভাড়া আইন বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ উদাসীন থাকায় আইনটি সম্পূর্ণ নিষ্ক্রিয়। এর কারণ হতে পারে যে তারা বাড়িওয়ালাদের বিরক্ত করতে চান না।'

রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সাবেক সহ-সভাপতি কামাল মাহমুদ ডেইলি স্টারকে বলেন, 'কাঁচামাল ও নির্মাণ খরচ বৃদ্ধি বাড়ি ভাড়া বাড়ানোর ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছে।'

'ফলে বাড়ির মালিকরা ভাড়াটিয়াদের কাছ থেকে বেশি ভাড়া আদায় করছেন। এতে বছরের পর বছর ধরে সাবলেটের সংখ্যা বাড়ছে।'

নির্মাণ সামগ্রীর মূল্যবৃদ্ধির কারণে নতুন বাড়িগুলোর ভাড়া আরও বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে বলেন মনে করেন তিনি।

পরিসংখ্যান ব্যুরোর নির্মাণ সামগ্রীর দামের সূচক অনুসারে, গত ডিসেম্বরে নির্মাণ খরচ ছয় দশমিক ৪৬ শতাংশ বেড়েছে। এটি সরকারি-বেসরকারি নির্মাণ প্রকল্পগুলোকে ব্যয়বহুল করে তুলেছে।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের রিসার্চ ফেলো তৌফিকুল ইসলাম খান ডেইলি স্টারকে বলেন, 'বাড়ি ভাড়ার উচ্চ প্রবৃদ্ধি মূল্যস্ফীতির ধারাবাহিক প্রভাবের বহিঃপ্রকাশ।'

ব্যুরোর তথ্যে দেখা গেছে, 'আধা-পাকা, কাঁচা ও ঝুপড়িঘরের ভাড়া বৃদ্ধির হার পাকাঘরের তুলনায় বেশি।'

তৌফিকুল ইসলাম খান বলেন, 'এই বাড়তি খরচ কম আয়ের পরিবারগুলোর বোঝা দ্বিগুণ করে দেয়। কম আয়ের পরিবারগুলোকে সহায়তা দেওয়ার দাবি খুবই বাস্তবসম্মত। তবে দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে সহায়তা দেওয়ার ক্ষেত্রে সরকারের সক্ষমতা খুব কম।'

Comments