খরচ কমানোর শেষ উপায়, কম ভাড়ার বাসা খুঁজছে মানুষ
বাড়িওয়ালার কাছ থেকে নোটিশ পেয়ে এস এম লাইজুর রহমান বিশ্বাসই করতে পারছিলেন না, আগামী জানুয়ারি থেকে তাকে বাসা ভাড়া ৩ হাজার টাকা বেশি দিতে হবে।
তিনি বলেন, 'সবকিছুর দাম বেশি। এমনিতেই সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছি। এর মধ্যে প্রতি মাসে বাড়তি ৩ হাজার টাকা খরচ করা সম্ভবই না।'
৭ সদস্যের পরিবারের জন্য রাজধানীর মিরপুরের ইস্টার্ন হাউজিংয়ে যখন লাইজুর বাসা নিয়েছিলেন, তখন ভাড়া ছিল ২৬ হাজার টাকা। এরপর থেকে প্রতি বছর ভাড়া বৃদ্ধি পেয়ে বর্তমানে ৩০ হাজার টাকায় এসে দাঁড়িয়েছে, যা জানুয়ারি থেকে হবে ৩৩ হাজার টাকা।
সার্বিক পরিস্থিতিতে তাকে বাধ্য হতে হয় কম ভাড়ায় নতুন কোনো বাসা খুঁজে নিতে।
তিনি বলেন, 'অনেক খুঁজে ২৫ হাজার টাকার মধ্যে একটি বাসা পেয়েছি। নতুন বাসাটি ৩ রুমের, রুমগুলোও ছোট। কিন্তু এটা ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না। কারণ যেটুকু আয় করি তা দিয়ে সংসারের অন্য খরচও তো চালাতে হবে। শুধু বাসা ভাড়ায় তো আর সব টাকা শেষ করতে পারব না।'
এমন পরিস্থিতি ঢাকার একটি বড় অংশের ভাড়াটিয়ার, বিশেষ করে সীমিত আয়ের মানুষের। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে উদ্ভূত মূল্যস্ফীতি এবং অর্থনৈতিক পরিস্থিতির কারণে তারা বাধ্য হচ্ছেন কম ভাড়ার বাসা খুঁজতে।
নিত্যপণ্য মূল্য বৃদ্ধির পাশাপাশি বাড়ি ভাড়া ও সার্ভিস চার্জ বেড়ে যাওয়ায় এসব মানুষের সমস্যা আরও বেড়ে গেছে।
কিছু বাড়িওয়ালা বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানি, জ্বালানি, নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র, গৃহঋণের সুদ এবং রক্ষণাবেক্ষণ খরচ বৃদ্ধির কারণে তাদের বাড়ির ভাড়া ও সার্ভিস চার্জ বাড়িয়েছেন।
কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) মতে, গত ৩ বছরে (২০১৯-২০২১) ঢাকায় বাড়ি ভাড়া ১৫ দশমিক ৯০ শতাংশ বেড়েছে।
ক্যাবের তথ্য অনুযায়ী, রাজধানীর একটি ১ হাজার ২০০ বর্গফুট আকারের বাড়ির ভাড়া ২০১৯ সালে ছিল গড়ে ২৪ হাজার ৫৯০ টাকা, যা ২০২০ সালে ২৬ হাজার ৫২০ টাকায় এবং ২০২১ সালে ২৮ হাজার ৫০০ টাকায় দাঁড়িয়েছে।
তবে গত ১ বছরে কত মানুষ আগের চেয়ে কম ভাড়ার বাসায় উঠেছেন সে বিষয়ে কোনো তথ্য এই সংস্থার কাছে নেই।
দ্য ডেইলি স্টার মিরপুর, মোহাম্মদপুর, কল্যাণপুর, মগবাজার ও আজিমপুরের ২৩ জন বাসিন্দার সঙ্গে কথা বলে জানতে পেরেছে, তাদের মধ্যে ১৬ জন ইতোমধ্যেই বাসা ভাড়ার খরচ কমাতে বাসা বদলেছেন এবং ৬ জন বাসা খুঁজছেন।
এসব এলাকার বাসিন্দারা বলছেন, গত ৭-৮ মাসে তাদের আশেপাশের বাড়ির গেটে অনেক বেশি সংখ্যক 'টু-লেট' সাইনবোর্ড দেখতে পাচ্ছেন।
মিরপুরের ইস্টার্ন হাউজিংয়ের বাসিন্দা রফিকুল ইসলাম বলেন, 'মানুষ সাধারণত ডিসেম্বর ও জানুয়ারিতে বাসা বদলায়। কিন্তু গত ৭ মাস বা তারও বেশি সময় ধরে তুলনামূলকভাবে বেশি সংখ্যক টু-লেট সাইনবোর্ড দেখতে পাচ্ছি।'
বাসা বদলে সহায়তাকারী প্রতিষ্ঠানগুলো বলছে, মানুষের বাসা বদলানোর পরিমাণ বেড়েছে।
এমনই একটি প্রতিষ্ঠান বেঙ্গল মুভার্সের মালিক রেদোয়ান হোসেন বলেন, 'গত ৬-৭ মাস ধরে কম ভাড়ার বাসা নেওয়া মানুষের সংখ্যা বেড়েছে।'
খরচ কমানোর উপায়
বেশ কিছু ভাড়াটিয়া দ্য ডেইলি স্টারকে জানান, তারা খাবার খরচ কমিয়েছেন এবং অতি জরুরি জিনিসপত্র ছাড়া অন্য কিছু কিনছেন না। তারপরও দৈনন্দিন খরচ মেটানো তাদের জন্য কঠিন হয়ে পড়েছে।
গত জুলাইয়ে মোহাম্মদিয়া হাউজিং থেকে মোহাম্মদপুরের তাজমহল রোডের একটি কম ভাড়ার বাসায় উঠেছেন ২ সন্তানের জননী ফারজানা মাহবুবা। ৩ রুমের বর্তমান বাসার জন্য তাকে ভাড়া দিতে হচ্ছে ১৮ হাজার টাকা।
তার আগের বাসায় ছিল ৪টি রুম ছিল এবং ভবনটিতে লিফট ছিল।
৪ বছর আগে চাকরি ছেড়ে দেওয়া ফারজানা বলেন, 'বাসা ভাড়া ও অন্যান্য সার্ভিস চার্জসহ প্রতি মাসে ২৪ হাজার টাকা দিতে হতো। নতুন বাসায় আসার পর ৬ হাজার টাকা খরচ কমেছে।'
ফারজানার স্বামী বিদেশ থেকে যে টাকা পাঠান এবং তার যা সঞ্চয় ছিল, তা দিয়েই তিনি সংসার চালান।
পুরান ঢাকার নবাবপুরে ইলেকট্রনিক্স সামগ্রী বিক্রেতা রফিউল আলমেরও একই অবস্থা।
মাসে ২২ থেকে ২৫ হাজার টাকা আয় করে তিনি সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছিলেন। বাধ্য হয়ে গত ১ অক্টোবর তিনি ৩ রুমের বাসাটি ছেড়ে খিলগাঁওয়ের দক্ষিণ গোরান এলাকায় একটি ২ রুমের বাসায় উঠেছেন। রুম কম হওয়ার পাশাপাশি তার এই বাসার রুমগুলোও আগের বাসার চেয়ে ছোট।
তিনি বলেন, 'নতুন বাসার ভাড়া ১০ হাজার টাকা। আগের বাসার ভাড়া ছিল সাড়ে ১২ হাজার টাকা। ঢাকায় পরিবারের জন্য খরচ ছাড়াও গ্রামে বসবাসরত আমার বৃদ্ধ বাবা-মায়ের জন্য টাকা পাঠাতে হয়। নতুন বাসায় এসে ভাড়ার যে আড়াই হাজার টাকা কম লাগছে সেটা অন্য কাজে লাগাতে পারছি।'
মিরপুরের একজন বেসরকারি চাকরিজীবী শামীম আহমেদ বলেন, 'এভাবেই যদি সবকিছুর খরচ বাড়তে থাকে, দাম বাড়তে থাকে, তাহলে শেষ পর্যন্ত গ্রামের বাড়িতে চলে যাওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় থাকবে না।'
জীবনের মানের ওপর প্রভাব
ক্যাব সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, ঢাকাবাসীদের অনেকেই কম ভাড়ার বাসায় উঠতে বাধ্য হচ্ছেন এবং এর ফলে তাদের জীবনযাত্রার মানের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।
তিনি নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দামে লাগাম টানানোর এবং মানুষের ওপর বোঝা কমানোর উপায় হিসেবে আরও কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরির পরামর্শ দেন।
তিনি বলেন, 'সরকার অনেক আগেই বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণের জন্য একটি আইন প্রণয়ন করেছে। কিন্তু তাতে কোনো কাজ হয়নি।'
১৯৯১ সালে বাংলাদেশ বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইন প্রণয়ন করা হয়, যেন বাড়ি ভাড়া সাশ্রয়ী হয়। ভাড়া বৃদ্ধিতে কিছু বিধিনিষেধ আরোপ করা হয় এই আইনে।
Comments