নীল টুনিতে টুনটুনালো

নীল টুনিতে টুনটুনালে কোনো রানির নাক কাটা যায় কি না, তা ঠিক জানা যায় না। তবে সূর্যের আলোয় ঝলমল করতে থাকা বেগুনি-নীল রঙের এই পাখির সৌন্দর্যে সত্যিই মুগ্ধ হতে হয়।
শিমের লতায় বসে থাকা নীল টুনি। ছবি: কমল দাশ

নীল টুনিতে টুনটুনালে কোনো রানির নাক কাটা যায় কি না, তা ঠিক জানা যায় না। তবে সূর্যের আলোয় ঝলমল করতে থাকা বেগুনি-নীল রঙের এই পাখির সৌন্দর্যে সত্যিই মুগ্ধ হতে হয়।

বিশেষজ্ঞদের অভিমত, এ দেশে কমবেশি ৭২২ প্রজাতির পাখির দেখা মেলে। এর ভেতর সুন্দর পাখির সংখ্যা অনেক। কিন্তু অনেকেই মনে করেন এসব পাখির মধ্যে মধুচুষকি (নেকটারিনিইডি) পরিবারের পাখিরাই বেশি সুন্দর; বিশেষত মৌটুসিরা (সানবার্ড)।

গায়ের রঙ, ওড়ার ঢঙ, গানের ধরণ কিংবা বাসা তৈরি—এমন সবকিছুতেই মৌটুসিদের শৈল্পিক ও নান্দনিক গুণের পরিচয় পাওয়া যায়। আবার সার্বিক বিচারে মৌটুসিদের মধ্যে নীল টুনিকেই ধরা হয় সুন্দরতম হিসেবে। এর আরেক নাম দুর্গা টুনি। ইংরেজিতে ডাকা হয় পারপল সানবার্ড নামে।

প্রকৃতিতে প্রজাপতি ছাড়া আরেকটি 'উড়ন্ত সৌন্দর্য' হলো পাখি। নিসর্গসখা দ্বিজেন শর্মা যেমন বলতেন, শিশুমনে পাখি যে পরিমাণ বিস্ময়ের উদ্রেক করে, তার সমতুল্য আর কিছুই নেই।

ছবি: কমল দাশ

দ্বিজেন শর্মা রচিত 'গহন কোন বনের ধারে' গ্রন্থে লেখকের শৈশবে বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলের বনে-জঙ্গলে ঘুরে বেড়ানোর মধ্য দিয়ে প্রকৃতির সঙ্গে তার যে সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল তার অনুপুঙ্খ বর্ণনা পাওয়া যায়। সেখানে তিনি বলছেন, 'ফুল ও পাখির উদয় পৃথিবীতে বলা চলে এক সঙ্গে, প্রায় ১০-১২ কোটি বছর আগে। সৌন্দর্যে, বৈচিত্র্যে উভয়ই সমতুল- তবু পাখি ছোটদের এত মন ভোলায় কেন?...বনের যে মোহন মায়া আমাকে কাছে টানতো, সেটা পাখি ছাড়া আর কিছু নয়।'

এই গ্রন্থেরই আরেক জায়গায় বরেণ্য এ নিসর্গবিদকে বলতে শোনা যায়, 'বাগানের টিলায় ছিলো বুনো জামের গাছ, তাতে ফুল ফুটলে ঝাঁক ঝাঁক পাখি পড়তো, গাছটাকে দেখাতো রথের মেলার হকারের হাতে সোলার লাঠিতে গাঁথা রঙচঙে কাগুজে পাখির ঝলমলে ঝাড়ের মতোন।'

ওই বুনো জাম গাছে ফুলের মধু খেতে ঠিক কোন কোন পাখি ঝাঁক বেঁধে পড়ত, তার উল্লেখ পাওয়া যায় না দ্বিজেন শর্মার রচনায়। তবে এগুলোর ভেতর যে নীল টুনি ছিল, তা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়।

ছবি: কমল দাশ

কারণ ঢাকার রমনা, জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যান কিংবা শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের বড় গাছগুলোতে ঝেঁপে ফুল আসলে এখনো নীল টুনিসহ সিঁদুরে মৌটুসি, সবুজাভ মৌটুসি, বেগুনি গলা মৌটুসির মতো এ ধরনের পাখিদের মেলা বসে যায়। তখন একই গাছে, একসঙ্গে এত রঙের পাখি দেখলে তা রঙচঙে কাগুজে পাখির ঝলমলে ঝাড়ের মতনই দেখায়।

নীল টুনির মূল খাদ্য বিভিন্ন ফুলের মধু, ছোট ছোট পোকা, ফুলের ভেতরের সূক্ষ্ম রেণু, তাল-খেজুরের রস ইত্যাদি। শিমুল-পলাশ ফুলের প্রতি এদের আসক্তি বেশি। আর লম্বা ঠোঁটটি ফুলের ভেতরে ঢুকিয়ে দিয়ে যখন এরা মধু পান করে, তখন এক নান্দনিক দৃশ্যের জন্ম হয়। হামিংবার্ডের মতোই শূন্যে স্থির থেকে ফুলের মধু খেতে পারে এরা।

পাখিবিশারদ শরীফ খান জানাচ্ছেন, পুরো ঢাকা শহরেই এই পাখিরা আছে। এমন কোনো পাড়া-মহল্লা-পার্ক-উদ্যান নেই, যেখানে এদের পাওয়া যাবে না। রাজধানীর ব্যস্ততম এলাকাতেও এদের ডাক শোনা যায়। রোদ পড়লে পুরুষ নীল টুনির চকচকে বেগুনি–নীল রঙ ঝলসে ওঠে। পুরো শরীরটা একই রঙের। তবে লেজ ও পাখার উপরিভাগে কালোর আধিক্য বেশি। লেজের দৈর্ঘ্য ০৩.০৩ সেমি। সদাসতর্ক চোখ। সুচালো ঠোঁটের অগ্রভাগটা নিম্নমুখী, রং কালো। ঠোঁটের দৈর্ঘ্য ২ সেমি। পা-ও কালো।

শরীফ খানের মতে—আমুদে, খেলুড়ে ও ফুর্তিবাজ এমন পাখি বাংলাদেশে আর দ্বিতীয়টি নেই। পুরুষটি পছন্দ করে উঁচু জায়গা। ঢাকা শহরে যেমন ছাদবাগানের ফুল-ফল গাছের শীর্ষদেশে বা কোনো উঁচু গাছের মগডালে বসে গান গায়। ধাতব গলাটাকে ওরা বিশ্রাম দিতে চায় না।

ছবি: কমল দাশ

আবার চাইলে সময় ও কারণভেদে এদের গাওয়া গানও আলাদাভাবে চিহ্নিত করা যায়। কোনোটা বাসা বাঁধার গান, কোনোটা ডিম পাড়ার গান, ডিম ফুটে ছানা বেরোনোর গান কিংবা ছানাদের খাওয়ানোর গান।

পুরুষ নীল টুনির তুলনায় স্ত্রী টুনির চেহারা অনেকটা ম্লান। অনেকটা জলপাই-বাদামি রঙের। পুরুষ টুনির বেগুনি–নীল রঙ ফোটে প্রেমের মৌসুমে। প্রজনন মৌসুম চলে গেলে দেখতে প্রায় স্ত্রী টুনির মতোই দেখায়।

মাঘের শেষভাগ থেকে বৈশাখের শুরু পর্যন্ত নীল টুনির বাসা বানানোর মৌসুম। এরা বাড়িঘরের গাছপালাতেই বাসা বানায়। ফুলের বাগানগুলো যেমন এদের চমত্কার 'খাদ্যভূমি', তেমনি বাগানবিলাসসহ অন্যান্য লতানো গাছ এদের বাসা বানানোর আদর্শ স্থান। বাড়ির প্রবেশপথের কাছে ৪ থেকে ৫ ফুট উচ্চতায়ও এদের বাসা দেখা যায়।

নীল টুনি মানুষের কাছাকাছি থাকতেই বেশি পছন্দ করে। শহর-বন্দর-গ্রাম-বন-জঙ্গল—সবখানেই দেখা যায়। বাংলাদেশ ছাড়া দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য, ইরান, চীন প্রভৃতি দেশে বিস্তৃত। দেহের দৈর্ঘ্য ১০ সেন্টিমিটার, যার মধ্যে ঠোঁটটিই ৪ সেন্টিমিটার।

সম্প্রতি চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের বারৈয়াঢালা জাতীয় উদ্যান থেকে নীল টুনির ছবিগুলো তুলেছেন কমল দাশ

Comments

The Daily Star  | English

Is the govt secretly backing wrongdoers?

BNP acting chairman Tarique Rahman yesterday questioned whether the government is being lenient on the killers of Lal Chand, alias Sohag, due to its silent support for such incidents of mob violence.

1h ago