পিটিয়ে মানুষ হত্যার একটি মর্মান্তিক দৃশ্য

পরিবারের সঙ্গে সাইফুল ইসলাম রাসেল। ছবি: সংগৃহীত

মেঝেতে নিশ্চল পড়ে ছিলেন সাইফুল ইসলাম রাসেল। তার মুখ থেকে রক্ত ঝরছিল, মুখে, শরীরে আঘাতের চিহ্ন।

দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আফতাব উদ্দিন রাব্বি ও তার প্রায় ২৫ জন সহযোগী তাকে ঘিরে নির্বিকার বসে ছিলেন।

দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের শুভাঢ্যা ইউনিয়নের দ্বিতল ভবন পারভীন টাওয়ারের নিচতলায় রাব্বির 'টর্চার সেল-কাম-অফিসে' গিয়ে এই দৃশ্য দেখতে পান রাসেলের স্ত্রী ইতি আক্তার রিয়া।

রিয়া জানান, গত ১০ জানুয়ারি রাত সাড়ে ১২টার দিকে কেউ তাকে ফোন করে জানায়, রাব্বি তার স্বামীর ওপর নির্যাতন চালাচ্ছে। তিনি যত দ্রুত সম্ভব সেখানে যান।

'রাসেলের শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল এবং আমার সঙ্গে কথাও বলতে পারছিল না।' গত মঙ্গলবার তেলঘাটে খেজুরবাগ বড়ইটোলার বাসা থেকে দ্য ডেইলি স্টারকে রিয়া বলেন, 'রাসেলকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার অনুমতির জন্য আমি রাব্বির কাছে কাকুতি-মিনতি করি। রাব্বি রাসেলের বন্ধু ছিল।'

রাব্বি তাকে বলেছিল, রাসেলকে আগে ২০ লাখ টাকা ফেরত দিতে হবে। তবে রাসেল কীভাবে তার কাছে ওই টাকা পাওনা ছিল তা তিনি বলেননি।

'আমি তাকে বলেছিলাম যেভাবেই হোক আমি টাকা ফেরত দেব, এমনকি যদি আমাকে আমার এবং আমাদের একমাত্র মেয়ের কিডনিও বিক্রি করতে হয় তাও ফেরত দেব, তারপরও যত তাড়াতাড়ি সম্ভব রাসেলকে হাসপাতালে নিয়ে যান। রাব্বি কোনো কথাই গ্রাহ্য করেনি।'

রাসেল অজ্ঞান হয়ে গেলে রাব্বি তার লোকদের রিয়ার কাছ থেকে ফোন কেড়ে নেওয়ার নির্দেশ দেয় যাতে সে কাউকে ফোন করে এ ঘটনা জানাতে না পারে।

এরপর রাত ২টার দিকে রাব্বির অফিস থেকে প্রায় ৩০০ গজ দূরের বাসায় গিয়ে রাসেলের চেক বই এনে রাব্বির হাতে দেন রিয়া।

এরপর রাব্বি তার সহযোগীদের নির্দেশ দেন রাসেলকে বাসায় দিয়ে আসতে।

'একটা চটের বস্তায় করে ওরা ওকে আমাদের বাড়িতে নিয়ে আসে। দুপুর ১টা পর্যন্ত তারা ওই বাড়ি পাহারা দিলেও চিকিৎসক রাসেলকে মৃত ঘোষণা করার সঙ্গে সঙ্গে তারা পালিয়ে যায়।'

রিয়া বলেন, 'তাদের মধ্যে চার জন আমার মেয়েকে একটি ঘরে এবং আমি ও আমার স্বামীকে অন্য ঘরে রাখে এবং অস্ত্র নিয়ে দরজায় দাঁড়িয়ে থাকে যাতে আমি কাউকে ডাকার সাহস না পাই।'

তারা পালিয়ে যাওয়ার পর রাসেলের পরিবারের লোকজন তাকে স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসকও তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

রাসেলকে পিটিয়ে অচেতন করার পর কার্যালয়ে নির্বিকার ক্ষমতাসীন দলের নেতারা। ছবি: ইতি আক্তার রিয়ার সৌজন্যে

'আমার স্বামীকে যদি আরও আগে হাসপাতালে নিতে দেওয়া হতো, তাহলে হয়তো ও বেঁচে থাকত… আমি ন্যায় বিচার চাই।'

রিয়া জানান, এ ঘটনায় আমার মেয়ে ষষ্ঠ শ্রেণির শিক্ষার্থী জান্নাতুল ফেরদৌস অ্যাঞ্জেল ভয়ে-আতঙ্কে চুপ হয়ে গেছে।

ঘটনার পরদিন ১১ জানুয়ারি রাব্বি ওর তার সহযোগী ১২ জনের নামে ও অজ্ঞাত আরও ১০-১৫ জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়। মামলার বাদী রাসেলের বাবা বীর মুক্তিযোদ্ধা তোফাজ্জল হাওলাদার।

যদিও রিয়া বলেন, 'আমার শ্বশুর, যিনি এই ঘটনা সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানেন না, তাকে অভিযোগকারী করা হয়েছে।'

বিস্তারিত উল্লেখ না করে তিনি বলেন, মামলার পর থেকে বিভিন্ন মহল থেকে চাপ ও ভয়ভীতির সম্মুখীন হচ্ছেন তিনি।

এদিকে বাবাকে নিয়ে থানায় যাওয়া রাসেলের ভাই হৃদয় হাওলাদার বলেন, 'পুলিশ আমাদের কথা শোনার চেষ্টাই করছিল না এবং নিজেরাই মামলা রুজু করেছে। তাদের নিজস্ব বক্তব্য দিয়ে এবং আমার বাবাকে বাদী বানিয়েছে। এমনকি আমরা এটাও জানি না তারা কী লিখেছে। তবে আমরা জানি যে তারা প্রথমে অভিযুক্তদের পক্ষেই ছিল। তবে ঘটনার ভিডিও ফেসবুকে ভাইরাল হওয়ার পর তারা তাদের অবস্থান ও মামলা পাল্টিয়েছে।

মামলার প্রাথমিক বিবরণ অনুযায়ী, রাসেল ১০ জানুয়ারি সকাল ৮টার দিকে বাসা থেকে বের হন এবং ঘণ্টাখানেক পর রাব্বির সঙ্গে তাকে দেখা যায়। শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত হওয়ার পর তাকে বাড়িতে পাঠানো হয়, তার পরে তার স্ত্রী তাকে হাসপাতালে নিয়ে যান, যেখানে তাকে মৃত ঘোষণা করা হয়।

রিয়া যে ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন কিংবা বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার আগে রাসেলের নিথর দেহ যে বস্তায় ভরে রাখা হয়েছিল তা বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়নি।

তবে পারিবারিক ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, ৯ জানুয়ারি রাত ১০টা সাড়ে ১০টার দিকে রাসেলকে কিছু লোক তুলে নিয়ে যায় এবং তার মৃত্যুর বীভৎস ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার আগ পর্যন্ত তার মৃত্যুর কোনো তদন্ত হয়নি।

ঢাকা জেলা পুলিশ সুপার মো. আসাদুজ্জামান গতকাল বুধবার তার কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে জানান, রাব্বিসহ ১১ জনকে আটক করা হয়েছে। কবে তাদের আটক করা হয়েছে তা তিনি স্পষ্ট করেননি।

ঝিনাইদহের মহেশপুর উপজেলার বাঁশবাড়িয়া বাজার থেকে রাব্বি এবং তার চার সহযোগী সজিব, রাজিব, হীরা ও ফিরোজকে গ্রেপ্তার করা হয়।

ভোলার লালমোহন থেকে আলমগীর ওরফে ঠান্ডু, আমির, রনি, দেলোয়ার ওরফে দেলু, শিপন, মাহফুজ ও রতন শেখকে গ্রেপ্তার করা হয়।

পরে ঢাকার একটি আদালত নয় জনকে তিন দিনের রিমান্ডে দেন এবং অন্য তিন জন - সজিব, আমির এবং আলমগীর দুটি পৃথক বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে হত্যার সঙ্গে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেন।

এসপি আসাদুজ্জামান বলেন, রাব্বির নামে চাঁদাবাজি করতেন রাসেল এবং রাব্বি ও তার সহযোগীদের শেয়ার না দিয়েই সব আত্মসাৎ করেন। যে কারণে তাদের মধ্যে বিবাদ হয়।

'তাকে শিক্ষা দেওয়ার জন্য, রাব্বি ও তার লোকজন তাকে অফিসে ডেকে নিয়ে সারারাত তার ওপর নির্যাতন চালায়। তারা তার চুলও কেটে দেয়। একপর্যায়ে রাসেল তার জীবন ভিক্ষা চাইলেও অজ্ঞান না হওয়া পর্যন্ত তারা তাকে নির্যাতন করতে থাকে,' বলেন এসপি।

শুভাঢ্যা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি বাছের উদ্দিনের ছেলে ও ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক ও শুভাঢ্যা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ইকবাল হোসেনের ভাতিজা রাব্বি পারিবারিক প্রভাবে স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতা হয়েছেন।

রাসেল রাব্বির বাবা ও চাচারও ঘনিষ্ঠ ছিলেন।

স্থানীয়রা বলছেন, রাব্বি এলাকার একজন অপরাধী এবং বিশেষ করে সেখানকার ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে চাঁদাবাজির জন্য পরিচিত।

কেউ যদি কারও কাছ থেকে টাকা ফেরত পাওয়ার জন্য তার সাহায্য চায় এবং তার অংশ হিসাবে একটি পরিমাণ নেয় তবে তিনি সালিশও করেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় অন্তত ১৫ জন ব্যবসায়ী জানান, যারা তার কথা অমান্য করার দুঃসাহস দেখায় তাদেরও সে নির্যাতন করে।

রাসেলের মৃত্যুর পর রাব্বিকে সংগঠন থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে।

রাব্বির পরিবার ঘটনাটি ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করলেও ফেসবুকে নির্যাতনের ফুটেজ ছড়িয়ে পড়লে তা ব্যর্থ হয়।

একটি ভিডিওতে রাসেলকে রাব্বিকে অনুরোধ করতে শোনা যায়, 'আব্বা, তুমি আমার বাবা। আব্বা, আব্বা, আব্বা... আমাকে বাঁচাও।' এসময় কয়েকজনকে তার হাত বাঁকিয়ে পেছনের দিকে টেনে নিয়ে যেতে দেখা যায়।

অপর একটি ভিডিওতে দেখা যায়, রাসেল মেঝেতে পড়ে আছেন এবং এক ব্যক্তি তাকে মারধর ও গালাগাল করছেন।

ভিডিওগুলো নির্যাতিনকারীরা নিজেরাই রেকর্ড করেছে।

শুভাঢ্যা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ইকবাল হোসেন বলেন, রাসেল তার ঘনিষ্ঠ ছিলেন। তার ভাতিজা যা করেছে তা ঠিক করে নাই।

স্থানীয়রা জানান, দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মোহাম্মদ মাসুদুর রহমানসহ অন্যান্য পুলিশ কর্মকর্তারা রাব্বীর অফিসে নিয়মিত যাতায়াত করতেন।

গত ৫ জানুয়ারি রাব্বি তার ফেসবুক প্রোফাইলে ইন্সপেক্টর মাসুদুর রহমানের সঙ্গে নিজের ও সহযোগীদের একটি ছবি পোস্ট করেন, যার ক্যাপশনে লেখা ছিল, 'মাসুদুর রহমান মামার সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোচনা হচ্ছে,' বলেন এসপি আসাদুজ্জামান।

যোগাযোগ করা হলে মাসুদুর বলেন, 'আমি কখনোই তার (রাব্বির) অফিসে যাইনি। ছবিটা কোথা থেকে এসেছে আমি জানি না।'

অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (কেরানীগঞ্জ সার্কেল) শাহাবুদ্দিন কবির বলেন, রাব্বিসহ ১২ জনকে মঙ্গলবার আটক করা হয়েছে। এদিকে রাব্বির অফিসে যাওয়ার অভিযোগ ওঠায় এবং তাদের একসঙ্গে ফেসবুকে ছবি পাওয়ায় পরিদর্শক মাসুদুরকে প্রত্যাহার করা হয়েছে।

Comments

The Daily Star  | English
NBR to become separate specialised agency

NBR officials withdraw complete shutdown programme

However, the non-cooperation programme with the NBR chairman will continue

1h ago