৪৬ বছর পর ভোট দেওয়ার সুযোগ পেলেও উৎসাহ নেই অস্ট্রেলিয়া প্রবাসীদের
১৯৭২ সালের গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের অনুচ্ছেদ ২৭ অনুযায়ী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রবাসী বাংলাদেশিরা তাদের নিজ নির্বাচনী এলাকায় ভোট দিতে পারেন। ডাকবিভাগের পোস্টাল ব্যালট সেবার মাধ্যমে তারা ভোট দিতে পারবেন।
বাংলাদেশের নির্বাচনে ভোট দেওয়ার ইচ্ছার কথা অনেক বছর ধরেই সরকারের কাছে জানিয়ে আসছিলেন প্রবাসী বাংলাদেশিরা। বিভিন্ন সময়ে দেশের সরকার প্রধানরা বিদেশ সফরে এলে তাদের কাছেও নিজেদের অধিকার আদায়ের কথা সরাসরি জানিয়েছেন তারা।
প্রবাসী বাংলাদেশি ভোটারের সংখ্যা যদি ৭০ লাখ হয়ে তাখে, তাহলে তাহলে জাতীয় সংসদের ৩০০ নির্বাচনী এলাকায় গড়ে প্রায় ২৩ হাজার করে প্রবাসী ভোটার রয়েছেন। যা বাংলাদেশের জনসংখ্যার চার থেকে পাঁচ শতাংশের মধ্যে।
বাংলাদেশের উচ্চ আদালত ১৯৯৮ সালে প্রবাসী বাংলাদেশিদের ভোটাধিকারকে সংবিধান স্বীকৃত বলে ঘোষণা দেন।
তারপরও কেটে যায় ২০ বছর। অবশেষে ২০১৮ সালের ৩০ নভেম্বর একটি নির্দেশনা জারি করে বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন।
নির্বাচন কমিশনের তৎকালীন যুগ্ম সচিব ফরহাদ আহাম্মদ খান স্বাক্ষরিত স্মারকপত্রে বলা হয়, 'বাংলাদেশি নাগরিক যারা বিদেশে বসবাস করেন তারা জাতীয় নির্বাচনে ভোট দিতে পারবেন।'
প্রবাসীদের দাবী আদায় হতে দীর্ঘ ৪৬ বছর সময় লাগলেও বিশ্বের ১৫৭টি দেশে বসবাসরত প্রায় দেড় কোটি প্রবাসী বাংলাদেশি ভোটাধিকার পাওয়ায় আনন্দিত।
আগামীকাল ৭ জানুয়ারি রোববার বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এবারের নির্বাচন নানা কারণে দেশে-বিদেশে আলোচিত, সমালোচিত ও প্রশ্নবিদ্ধ।
দীর্ঘ ৪৬ বছর পর ভোটাধিকার পেলেও ভোট দেয়ার বিষয়ে তেমন আগ্রহী নয় অধিকাংশ অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী বাংলাদেশি।
অস্ট্রেলিয়ায় বিভিন সুত্রের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী অধিকাংশ বাংলাদেশি ভোটার হিসেবে এবার তাদের নাম নিবন্ধন করেননি। প্রায় শতাধিক প্রবাসীর সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। এবারের নির্বাচন নিয়ে তাদের কোনো উৎসাহ উদ্দীপনা নেই। অধিকাংশ প্রবাসীই জানিয়েছেন, এবারের নির্বাচনটি হচ্ছে সম্পূর্ণ একতরফা ভাবে। কারা বিজয়ী হবেন তা যদি আগে থেকেই জানা হয়ে যায় তাহলে সেটি নিয়ে আগ্রহের কিছু থাকে না।
অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী নাট্যকার, কথাসাহিত্যিক ও গবেষক শাহান আরা জাকির পারুল বলেন, 'নির্বাচন মানেই একটা অন্যরকম উৎসব উৎসব ভাব দেখেছি ছোটবেলা থেকেই। নানারকম খাবারদাবার রেডি করে সারা রাত ধরে টিভিতে খবরাখবর দেখতাম। মজার মজার অনুষ্ঠান থাকতো টিভিতে। আবার হরতাল অবরোধও দেখেছি। সব মিলিয়ে অন্যরকম একটা পরিবেশ সৃষ্টি হতো। আনন্দ আনন্দ ভাব ছিলো।'
'দেশের বাইরে থাকায় এখন সেটা আর ঠিক অনুভব করতে পারিনা। যেখানেই থাকি দেশে সুষ্ঠু গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় নির্বাচনের আগের দিনের সেই শান্তিপূর্ণ ও সুন্দর ইমেজ ফিরে আসুক, এটাই প্রত্যাশা', যোগ করেন তিনি।
অস্ট্রেলিয়া বাংলাদেশ জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মোহাম্মদ আব্দুল মতিন বলেন, 'প্রধান বিরোধী দল বিএনপি নির্বাচনে না থাকায় সরকারি দল আওয়ামী লীগের কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী নেই ভোটের মাঠে। যার ফলে একতরফা নির্বাচন হচ্ছে দেশে। প্রধান বিরোধী দল ছাড়া নির্বাচন অত্যন্ত দু:খজনক। তবে আমার মতে, বিএনপির উচিৎ ছিল নির্বাচনে অংশ নেয়ার পাশাপাশি আন্দোলন চালিয়ে যাওয়া।'
'সরকারের উচিত ছিল, একতরফা নির্বাচন না করে কিছুটা ছাড় দিয়ে প্রধান বিরোধী দল বিএনপিকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার ব্যবস্থা করা, তাহলেই এই নির্বাচন গ্রহনযোগ্য হতো', যোগ করেন তিনি।
বিজ্ঞানী, গবেষক, ঔপন্যাসিক ও সংগঠক ড. রতন কুন্ডু বলেন, 'বিগত দিনগুলোর ঘটনা পরম্পরায় আমার কাছে মনে হচ্ছে এবারের নির্বাচন হবে খুবই চ্যালেঞ্জিং। মনে হচ্ছে নির্বাচনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগই নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় আসীন হবে। তবে তার পরবর্তীতে বঞ্চিত দলগুলো আরো সুসংহত হয়ে নির্বাচন পরবর্তী একটি প্রতিবিপ্লব অথবা গৃহযুদ্ধে লিপ্ত হতে পারে।'
'আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতেও অনেক দল-উপদল জন্ম নেবে। বিশেষ করে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা অন্য নামে আরেকটি সংগঠনের ব্যানারে একত্রিত হতে পারে', যোগ করেন তিনি।
টেলিওজ কমিউনিকেশনের প্রধান নির্বাহী ও পেশায় প্রকৌশলী জাহাঙ্গীর আলম বলেন, 'গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, সুষ্ঠু নির্বাচন এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা একটি দেশের সার্বিক উন্নয়নের জন্য খুবই জরুরি। দেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে মনে হচ্ছে বহুদলের অংশগ্রহণে উৎসবমুখর নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়েছে। টেকসই উন্নয়ন ও উন্নত জাতি হিসেবে বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে হলে আমাদের নেতাদের ভিন্নমত ও দলকে গুরুত্ব দিয়ে একসঙ্গে কাজ করে সামনে এগিয়ে যাওয়ার সক্ষমতা অর্জন করতে হবে। দেশের সচেতন নাগরিক হিসেবে এটাই আমাদের প্রত্যাশা।'
বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব নিউ সাউথ ওয়েলসের সাবেক সভাপতি এ কে এম ফজলুল হক শফিক এবারের নির্বাচন নিয়ে বলেন, 'আমি আসলে এটাকে কোনও নির্বাচন বলে মনে করি না। এখানে পছন্দ করার সুযোগ নেই। যেখানে জাতীয় নির্বাচনে বৃদ্ধ বাবা তার ছেলের কাঁধে চড়ে ভোটকেন্দ্রে যেতেন সেখানে এবার ভোটারদের কেন্দ্রে আনার জন্য নানান কৌশল অবলম্বন করছে সরকার। যা সত্যিই দুর্ভাগ্যজনক।'
আকিদুল ইসলাম : অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী লেখক, সাংবাদিক
Comments