২০২৩ সালে স্থবির ছিল জ্বালানি খাত, এ বছর কি ঘুরে দাঁড়াবে?

বর্জ্য বিদ্যুৎ, সৌর বিদ্যুৎ, মন্ত্রিসভা কমিটি, আ হ ম মুস্তফা কামাল,
প্রতীকী ছবি/সংগৃহীত

বিদায়ী বছরে মার্কিন ডলার সংকট বাংলাদেশের বিদ্যুৎ খাতে সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলেছিল। কারণ পরিস্থিতি সামলাতে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস ও কয়লা আমদানি কমিয়েছিল সরকার। এতে চাহিদা বাড়লেও উৎপাদন বাড়েনি। ফলে গরমের সময়ে বাসাবাড়ি ও শিল্প কারখানায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা লোডশেডিং দেখা গেছে।

বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর কাছে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) বকেয়া দাঁড়িয়েছে ২৫ হাজার কোটি টাকা। এতে বিদ্যুৎকেন্দ্র সচল রাখতে বেসরকারি উৎপাদনকারীরা ফার্নেস অয়েল আমদানি করতে না পেরে বিপাকে পড়েন।

একইভাবে, একমাত্র জাতীয় পেট্রোলিয়াম আমদানিকারক বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন তাদের সরবরাহকারীদের বিল পরিশোধে সমস্যায় পড়ে। অন্যদিকে পায়রায় দেশের বৃহত্তম কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রটি জ্বালানি সংকটের কারণে কয়েক সপ্তাহ বন্ধ ছিল।

কয়লা সংকটে বেশ কয়েক দফায় বন্ধ থাকে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রও।

যদিও ২০২৩ সাল বিদায় নিয়েছে, তবে দুঃসংবাদ হলো জ্বালানি খাতের সংকট নতুন বছরে দূর হওয়ার সম্ভাবনা নেই। কারণ বর্তমান পরিস্থিতির জন্য দায়ী কারণগুলো এখনো রয়েই গেছে।

যেমন- গত রোববার বাংলাদেশের মোট বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ২১ দশমিক ৮২ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে, যা ২০২১ সালের আগস্টে ছিল ৪০ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ ডলার সংকটের কারণে আমদানি চাপ অব্যাহত থাকবে।

তাই বৈশ্বিক কোম্পানিগুলো এ বছর জ্বালানির দামে স্থিতিশীলতার পূর্বাভাস দিলেও মার্কিন ডলারের সংকট এ বছরও বাংলাদেশের জন্য মূল সমস্যা হতে চলেছে।

বিদ্যুৎ উৎপাদন, কারখানা পরিচালনা, পরিবহন সচল রাখা, এমনকি রান্নার জন্য প্রাথমিক জ্বালানির আমদানি বিল পরিশোধে সরকারি ও বেসরকারি খাতগুলো সময়মতো ডলার পাবে কিনা তা নিয়ে উদ্বেগ আছে।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) কেমিক্যাল অ্যান্ড ম্যাটেরিয়াল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ডিন অধ্যাপক ম তামিম বলেন, 'বিদ্যুৎ খাতে ডলারের ঘাটতি ছাড়া আমাদের বড় কোনো সমস্যা নেই।'

তিনি বলেন, বিশ্বব্যাপী জ্বালানির চাহিদা কমেছে, ফলে এর দাম চলতি বছরে কমবেশি অপরিবর্তিত থাকবে বলেই ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে।

চাহিদা মেটাতে বাংলাদেশ এলএনজি, ফার্নেস অয়েল, ডিজেল ও কয়লাসহ আমদানি করা প্রাথমিক জ্বালানির ওপর নির্ভরশীল।

বছরে প্রায় ৭৫ লাখ টন পেট্রোলিয়াম পণ্য ব্যবহৃত হয়, যার মধ্যে আমদানি করতে হয় ৯২ শতাংশ। আমদানিকৃত জ্বালানির ২০ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহৃত হয়।

এছাড়া দেশে বছরে প্রায় ৮৫০ বিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উৎপাদিত হয় এবং প্রায় ২৮০ বিসিএফ এলএনজি আমদানি করা হয়। মোট ব্যবহৃত গ্যাসের প্রায় ৪০ শতাংশ বিদ্যুৎ খাতে ব্যবহার হয়।

যেহেতু প্রাকৃতিক গ্যাস সারাদেশে সরবরাহ করা সম্ভব নয়, তাই রান্নার জন্য তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাস (এলপিজি) জনপ্রিয় হয়ে উঠছে, যার চাহিদার ৯৫ শতাংশ পূরণ করছে বেসরকারি সরবরাহকারীরা। গত বছর প্রায় ১৬ লাখ টন এই জ্বালানি আমদানি হয়েছে, যা আগের বছরের তুলনায় ৭-৮ শতাংশ বেশি।

বর্তমানে দেশের মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ২৫ হাজার ৯৫১ মেগাওয়াট এবং চলতি বছর আরও ৫ হাজার ৪৮০ মেগাওয়াট জাতীয় নেটওয়ার্কে যুক্ত হবে বলে আশা করা হচ্ছে।

গ্রীষ্মকাল শুরুর প্রথম মাস এপ্রিলে বিদ্যুৎ উৎপাদন হবে ১৭ হাজার ৮০০ মেগাওয়াট। ওই সময় শুধু সেচের জন্য বাংলাদেশের অতিরিক্ত ২ হাজার ৫৯০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ প্রয়োজন হবে।

জানুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত সেচ মৌসুমে সরকার প্রতিদিন ১ হাজার ৭৬০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস, ১ লাখ ৫৫ হাজার টন ফার্নেস অয়েল এবং ১৫ হাজার ৬০০ টন ডিজেল সরবরাহ নিশ্চিত করার পরিকল্পনা করেছে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, দেশে পর্যাপ্ত বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা আছে। কিন্তু মূল সমস্যা হচ্ছে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর জন্য প্রাথমিক জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিত করা।

গত ডিসেম্বরে এসঅ্যান্ডপি গ্লোবালের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, অর্থ ঘাটতি ও আমদানিকারক এবং সরকারের কাছে অর্থ বকেয়া থাকায় জাহাজ ও বিদ্যুৎকেন্দ্রে ব্যবহৃত হাই সালফার ফুয়েল অয়েল (এইচএসএফও) আমদানি কমিয়ে দিয়েছে এসঅ্যান্ডপি গ্লোবাল।

বাংলাদেশ ইন্ডিপেন্ডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসারস অ্যাসোসিয়েশনের (বিআইপিপিএ) সাবেক সভাপতি ইমরান করিমের উদ্ধৃতি দিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২৪ সালে বাংলাদেশ প্রায় ৩৫ লাখ টন ১৮০-সিএসটি এইচএসএফও আমদানি করবে, যা ২০২৩ সালের তুলনায় প্রায় ৯ শতাংশ কম।

চলতি সপ্তাহে বিআইপিপিএ'র সভাপতি ফয়সাল খান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ডলার ঘাটতির কারণে স্থানীয় ব্যাংকগুলো জ্বালানি আমদানির জন্য প্রয়োজনীয় ঋণপত্র খুলতে পারছে না। ব্যাংকগুলি বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ ও খুচরা যন্ত্রাংশ ক্রয় সম্পর্কিত ঋণপত্র নিষ্পত্তি করতেও লড়াই করছে।

তিনি বলেন, 'নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ উৎপাদন নিশ্চিত করতে বিদ্যুৎ খাতে বাংলাদেশ ব্যাংকের সহযোগিতা প্রয়োজন। আমরা আশা করি, মার্কিন ডলারের ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করতে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।'

২০২৪ সালে সরকারকে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলারের ঋণ কর্মসূচির শর্তের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে জ্বালানির স্বয়ংক্রিয় মূল্য প্রবর্তন করতে হবে। এজন্য বাংলাদেশকে সরকার নিয়ন্ত্রিত মূল্য নির্ধারণী কাঠামো থেকে সরে আসতে হবে।

বিদ্যুৎ খাতেও ভর্তুকি কমানোর পরিকল্পনা আছে, যা গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে মেটানোর পরিকল্পনা রয়েছে। চলতি অর্থবছরে ৩২ হাজার কোটি টাকা বিদ্যুৎ খাতের ভর্তুকি বাবদ রাখা হয়েছে।

তবে ২০২২-২৩ অর্থবছরে সরকারের বরাদ্দকৃত ২৩ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকির অংক বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৯ হাজার ৫৩৪ কোটি টাকায়। টাকার অবমূল্যায়ন, গ্যাসের দাম বৃদ্ধি এবং ভারত থেকে বেশি বিদ্যুৎ আমদানির কারণে এই খরচ বেড়েছে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, স্বয়ংক্রিয় মূল্য নির্ধারণী কাঠামোতে যাওয়ার অংশ হিসেবে স্থানীয়ভাবে গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে, যা মূল্যস্ফীতি আরও বাড়াতে পারে। ইতোমধ্যে বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতি রেকর্ড স্তরে পৌঁছেছে এবং কমার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।

ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির ব্যবসায় ও অর্থনীতি অনুষদের ডিন অধ্যাপক এ কে এনামুল হক বলেন, এই সিদ্ধান্ত মূল্যস্ফীতির ওপর প্রভাব ফেলবে।

'আমরা যদি স্বল্প বিরতিতে নিয়মিত দাম সমন্বয় করি, তাহলে অস্থিরতা বাড়বে এবং সরকার পরিস্থিতির নিয়ন্ত্রণ হারাতে পারে,' বলেন তিনি।

রিজার্ভ কমে যাওয়াকে তিনি বিপজ্জনক লক্ষণ বলে অভিহিত করেছেন।

তিনি বলেন, 'সরকার যে সমস্যায় পড়েছে, তা স্পষ্ট। তারা যদি তাদের প্রধান প্রধান নীতিনির্ধারণী প্রক্রিয়ায় পরিবর্তন না করে তাহলে এই সমস্যা আরও তীব্র হবে।'

তিনি আরও বলেন, 'সরকার যদি ভর্তুকির বোঝা কমাতে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম বাড়ায়, তাহলে পোশাকে মতো অন্যান্য খাতগুলোর জন্য সমস্যা তৈরি হতে পারে। কারণ তারা বিশ্ব বাজারে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়বে।'

অধ্যাপক এ কে এনামুল হকের মতে, 'আমরা যদি অলস বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো বন্ধ না করে দাম বাড়াই, তাহলে বোঝা আরও বাড়বে।'

বুয়েটের প্রকৌশল অনুষদের সাবেক ডিন ইজাজ হোসেন মনে করেন, রাতারাতি রিজার্ভ পরিস্থিতির উন্নতি হবে না।

তিনি বলেন, সরকার নির্বাচনের পর পর্যন্ত জ্বালানি তেলের দাম বাড়াবে না।

'কিন্তু সরকারকে অবশ্যই দাম বাড়াতে হবে, আর এই সিদ্ধান্তটি অর্থনীতিতে প্রভাব ফেলবে, যা মোকাবিলা করা চ্যালেঞ্জিং হবে। সুতরাং, এর জন্য কিছু মৌলিক সিদ্ধান্ত নেওয়া দরকার,' বলেন তিনি।

তিনি আরও বলেন, 'আমাদের প্রথম অগ্রাধিকার হওয়া উচিত ডলারের বিনিময় হার স্থিতিশীল করা।'

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত দুই বছরে মার্কিন ডলারের বিপরীতে টাকার মূল্য প্রায় ২৮ শতাংশ কমেছে।

বসুন্ধরা এলপি গ্যাস লিমিটেডের হেড অব স্ট্র্যাটেজি অ্যান্ড প্ল্যানিং জাকারিয়া জালাল বলেন, এলপিজি আমদানিকারকরা গত এক বছর ধরে ডলার ম্যানেজ করতে হিমশিম খাচ্ছেন।

'প্রয়োজনীয় ক্যাশ মার্জিন দেওয়ার পরেও আমরা ঋণপত্র খুলতে পারিনি। কিছু কোম্পানি আন্তর্জাতিক বাজার থেকে এলপিজি কিনতে পারছে না, এজন্য অন্য বড় কয়েকটি কোম্পানীর উপর নির্ভর করতে হচ্ছে,' বলেন তিনি।

তিনি আরও বলেন, ২০২৩ সালে এলপিজি খাতে বার্ষিক প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৭ থেকে ৮ শতাংশ।

জাকারিয়া জালাল জানান, বিকল্প জ্বালানি হিসেবে যানবাহনে ব্যবহৃত এলপিজির অটো-গ্যাস জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। কিন্তু, ফুয়েলিং স্টেশন স্থাপন করতে কিছু আমলাতান্ত্রিক সমস্যা রয়েছে। ২০২৪ সালে শিল্পখাতে এলপিজির ব্যবহার বাড়তে পারে, কারণ গ্যাস সংকটের মধ্যে সরকার এর জন্য বিধিমালা প্রণয়ন করছে।

Comments

The Daily Star  | English

Bangladesh at a historic crossroads: Dr Kamal Hossain

Eminent jurist Dr Kamal Hossain today said Bangladesh stands at a turning point of history following recent mass uprisings

1h ago