নাক ডাকার কারণ ও সমাধান কী
নাক ডাকা এমন একটি সমস্যা যেটি শুধু নিজের জন্যই বিব্রতকর নয়, আশপাশের মানুষও এর ফলে বিড়ম্বনায় পড়েন। এর আছে নানা স্বাস্থ্য ঝুঁকিও। নারী-পুরুষ সব বয়সের মানুষই নাক ডাকার সমস্যায় ভুগতে পারেন। বাচ্চাদের ক্ষেত্রেও নাক ডাকার সমস্যা হতে পারে। শীতকালে বাড়তে পারে এটি।
নাক ডাকার কারণ ও সমাধান সম্পর্কে জেনে নিন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের হেড-নেক সার্জারি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. মো. হাসানুল হক নিপুনের কাছ থেকে।
নাক ডাকার কারণ
ডা. হাসানুল হক বলেন, নাক থেকে ফুসফুস পর্যন্ত যে জায়গাটা আছে, সেখানে বাতাস প্রবাহ হয়। যেকোনো কারণে যদি শ্বাসের রাস্তায় বাতাস প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হয় তাহলেই একজন ব্যক্তির ঘুমের ভেতর নাক ডাকা শুরু হয়। বিভিন্ন কারণে নাক ডাকার সমস্যা হতে পারে। যেমন-
১. স্থূলতা, অত্যাধিক ওজন হলে অনেকে নাক ডাকেন।
২. নাকের বিভিন্ন সমস্যা যেমন- নাকের হাড় যদি কারো বাঁকা থাকে, নাকের ভেতর যদি পলিপ থাকে, নাকে মাংসের বৃদ্ধি থাকলে নাক ডাকতে পারেন।
৩. অত্যাধিক চর্বি জমার কারণে যদি মুখের ভেতর জায়গা কমে যায়।
৪. শ্বাসনালীতে বিভিন্ন ধরনের টিউমার হয়। যদি কারো সেই ধরনের টিউমার থাকে তাহলে নাক ডাকতে পারেন।
৫. জিহ্বার পেছনের অংশে যদি টিউমার থাকে তাহলেও নাক ডাকতে পারেন।
৬. কারো যদি অনেক বড় টনসিল থাকে।
৭. বাচ্চাদের ক্ষেত্রে আরেক ধরনের টনসিল আছে, তাকে বলে এডিনয়েড। সেই এডিনয়েড যদি বড় থাকে সেক্ষেত্রে বাচ্চারাও নাক ডাকতে পারে।
নাক ডাকলে যা যা ঘটে
যিনি ঘুমের মধ্যে নাক ডাকেন তিনি সাধারণত সমস্যাটি বুঝতে পারেন না। তার আশেপাশে থাকা ব্যক্তিরাই বিষয়টি প্রথম বুঝতে পারেন। বিভিন্ন লক্ষণ রয়েছে, যেমন-
১. ঘুমের মধ্যে হঠাৎ শ্বাস বন্ধ হয়ে যাবে, জোরে জোরে শব্দ করে নাক ডাকতে থাকবে।
২. ঘুমের মধ্যে গোঙানির মত শব্দ হবে।
৩. নাক ডাকা সমস্যার কারণে অসম্পূর্ণ ঘুম হবে।
৪. দিনের বেলায় ঘুম ঘুম, ঝিমুনি ভাব থাকবে।
৫. অবসাদগ্রস্ততা ও দুর্বলতা দেখা দেবে।
৬. ধীরে ধীরে স্মৃতিশক্তি হ্রাস পাবে।
৭. যৌনক্ষমতা হ্রাস পাবে।
৮. মেজাজ খিটখিটে হয়ে যাবে।
৯. নাক ডাকেন যারা তারা সাধারণত মুখ হা করে ঘুমান। মুখের ভেতর শুকনো ভাব হবে ঘুমের মধ্যে। বারবার ঘুম ভাঙবে, উঠে পানি খেতে হবে।
১০. নাক ডাকার কারণে ঘুমে ব্যাঘাত হয়, এতে শরীরে অক্সিজেন সরবরাহ কমে যায়। ফলে অন্যান্য শারীরিক সমস্যা দেখা দেবে।
নাক ডাকার ঝুঁকি
ডা. হাসানুল হক বলেন, মানুষের মধ্যে ভ্রান্ত ধারণা আছে। অনেকে বলেন, নাক ডাকা মানে সুখনিদ্রা। এটি সম্পূর্ণ ভুল। নাক ডাকা একটি রোগ এবং মারাত্মক রোগের উপসর্গ। শরীরে যে রোগ বাসা বাঁধছে নাক ডাকা তার একটা লক্ষণ। নাক ডাকার ফলে শরীর বিভিন্ন ঝুঁকিতে পড়তে পারে। যেমন-
১. নাক ডাকার সমস্যার কারণে শরীরে অক্সিজেন সরবরাহ কমে যায়, এতে করে হৃদরোগের ঝুঁকি বেড়ে যায়। এমনকি ঘুমের মধ্যে হার্ট অ্যাটাকও হতে পারে যেকোনো সময়।
২. মস্তিষ্কে অক্সিজেন সরবরাহ কমার কারণে ব্রেন স্ট্রোক হতে পারে।
৩. ক্লান্তি, বিরক্তি ও মাথাব্যথা হবে।
৪. অল্পতেই রেগে যেতে পারেন। মুড সুইং হবে।
স্লিপ অ্যাপনিয়া ও নাক ডাকার সময় জাগিয়ে দেওয়া কি ঠিক?
ঘুমের মধ্যে কিছু সময়ের জন্য শ্বাস প্রশ্বাস বন্ধ হয়ে যাওয়াকেই বলে অবস্ট্রাকটিভ স্লিপ অ্যাপনিয়া। যাদের এই সমস্যা আছে তারাই ঘুমের মধ্যে নাক ডাকেন। আবার নাক ডাকার সমস্যা যাদের আছে তাদেরই স্লিপ অ্যাপনিয়া হয়। একটি অপরটির পরিপূরক।
অনেক সময় নাক ডাকার মাঝখানে অনেকের স্লিপ অ্যাপনিয়া হয়। ২০ থেকে ৩০ সেকেন্ডের জন্য শ্বাস-প্রশ্বাস একেবারে বন্ধ হয়ে যায়। ১০ থেকে ১২ বার অ্যাপনিক কন্ডিশনে চলে যেতে পারেন অনেকে। এই অবস্থায় ওই ব্যক্তিকে ডেকে দিলে শরীরে কোনো খারাপ প্রভাব পড়বে না জানান ডা. হাসানুল হক। বরং ডেকে দিলে নাক ডাকার কারণে যে অ্যাপনিয়া ছিল সেটি ঠিক হয়ে যাবে। তিনি আবারও শ্বাস নেওয়া শুরু করবেন।
নাক ডাকার চিকিৎসা ও প্রতিরোধে করণীয়
যারা অত্যাধিক নাক ডাকেন তাদের অবশ্যই একজন নাক কান গলা বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হতে হবে। নাক, গলা ভালো করে বিভিন্ন পরীক্ষার মাধ্যমে রোগ বের করতে হবে। প্রয়োজনে এমআরআই, সিটিস্ক্যানসহ বিভিন্নভাবে পরীক্ষা মাধ্যমে সমস্যা শনাক্ত করতে হবে।
কোন লেভেলে সমস্যাটা হচ্ছে, নাকের সামনের দিকের অংশের কারণে হচ্ছে নাকি পেছনের দিকের অংশের কারণে সেটি নির্ধারণ করতে হবে। প্রয়োজনে পলিসমনোগ্রাফি পরীক্ষার মাধ্যমে অবস্ট্রাকটিভ স্লিপ অ্যাপনিয়া শনাক্ত করতে হবে।
এ ছাড়া নাক ঠিক থাকলেও শারীরিক অবস্থা কী আছে, গলা ও নাকের আশেপাশে চর্বি জমে আছে কি না, অতিরিক্ত ওজন আছে কি না সেটি দেখতে হবে এবং সেই অনুযায়ী চিকিৎসা দিতে হবে বলে জানান ডা. হাসানুল হক।
যারা নিয়মিত অ্যালকোহল ও ধূমপান করেন তাদেরও নাক ডাকার সমস্যা হতে পারে। তাদের এসব এড়িয়ে চলতে হবে। নাকের হাড় বাঁকা, পলিপ বা টিউমারের কারণে নাক ডাকলে সেই অনুযায়ী সমস্যা চিহ্নিত করে চিকিৎসা দিতে হবে।
নাকের স্প্রে, বিভিন্ন ওষুধ ও ফিজিক্যাল অ্যাক্টিভিটির মাধ্যমে সমস্যা সমাধান করা যেতে পারে। আর না কমলে পরিস্থিতি অনুযায়ী সার্জারি করার কথা বলেন এই চিকিৎসক।
নাক ডাকা প্রতিরোধে সচেতনতা বাড়াতে হবে, নাক ডাকা একটি রোগ সেটি বুঝতে হবে। ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে, ব্যায়াম, শারীরিক ক্রিয়াকলাপ বাড়াতে হবে, ধূমপান, অ্যালকোহল বাদ দিতে হবে। নাকের পলিপ, সাইনোসাইটিসের সমস্যা থাকলে দ্রুত চিকিৎসা করতে হবে জানান ডা. হাসানুল হক।
Comments