দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সফল, ব্যর্থ বাংলাদেশ

মূল্যস্ফীতি, রিজার্ভ, অর্থবছর, আইএমএফ,
বাংলাদেশের একটি বাজারের সাধারণ দৃশ্য। স্টার ফাইল ফটো

করোনা মহামারি ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে উচ্চ মূল্যস্ফীতির সঙ্গে লড়াই করছে পুরো বিশ্ব। তবে, দক্ষিণ এশিয়ার বেশিরভাগ দেশ ২০২৩ সালে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সফল হলেও বাংলাদেশ পারেনি। বরং বাংলাদেশের জন্য মূল্যস্ফীতির লাগাম টেনে ধরা কঠিন হয়ে উঠেছে।

অথচ স্বাধীনতার পর সবচেয়ে খারাপ অর্থনৈতিক সংকটে পড়া শ্রীলঙ্কাও ভোক্তা মূল্য নিয়ন্ত্রণে আনতে পেরেছে।

নভেম্বরে বাংলাদেশের গড় ভোক্তা মূল্য সূচক (সিপিআই) ছিল ৯ দশমিক ৪২ শতাংশ। এই উচ্চ মূল্যস্ফীতি বাংলাদেশিদের জীবনযাপনকে চ্যালেঞ্জিং করে তুলেছে। এমনকি সাম্প্রতিক মাসগুলোতে বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন পণ্যের দাম কমলেও বাংলাদেশে উচ্চ মূল্যস্ফীতি অব্যাহত আছে।

বাংলাদেশে বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ কারণ মিলিয়ে গত দেড় বছরে মূল্যস্ফীতি বেড়েছে।

বাহ্যিক কারণগুলোর মধ্যে আছে- ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ শুরুর পর সরবরাহ ব্যবস্থা বিঘ্নিত হওয়া এবং পণ্যে উচ্চ দাম। অভ্যন্তরীণ কারণগুলোর মধ্যে আছে- গত বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে মার্কিন ডলারের বিপরীতে টাকার ২৮ শতাংশ অবমূল্যায়ন, বৈদেশিক মুদ্রার ঘাটতি, ৩০ শতাংশ রিজার্ভ কমে যাওয়া।

দেশের বেশ কয়েকজন অর্থনীতিবিদ ও বিশ্লেষক অন্যান্য দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মতো আর্থিক নীতি ব্যবহার না করার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংককে দায়ী করেছেন। বাজারে পর্যাপ্ত সরবরাহ নিশ্চিত করতে না পারায় সরকারের বিলম্বিত প্রতিক্রিয়ারও সমালোচনা করেছেন তারা।

দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর সিপিআই ডেটা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, শ্রীলঙ্কার মূল্যস্ফীতি কমেছে এবং পাকিস্তানের ভোক্তা মূল্য ৩০ শতাংশে অপরিবর্তিত আছে। ভারত, ভুটান, মালদ্বীপ ও নেপালে পণ্যের দাম কমেছে। আফগানিস্তানের মূল্যস্ফীতি নেতিবাচক পর্যায়ে নেমে এসেছে।

চলতি বছরের জানুয়ারিতে শ্রীলঙ্কার মূল্যস্ফীতি ছিল ৫১ দশমিক ৭ শতাংশ এবং ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে ছিল ৭৩ শতাংশ।

পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, পাকিস্তানের সিপিআই গত মাসে ২৯ দশমিক ২৩ শতাংশে নেমে এসেছে, যা মে মাসে ১২ মাসের সর্বোচ্চ ৩৭ দশমিক ৯৭ শতাংশ ছিল।

যথাযথ ব্যবস্থা নিয়ে ভারত মূল্যস্ফীতি জানুয়ারির ৬ দশমিক ৫২ শতাংশ থেকে নভেম্বরে ৫ দশমিক ৫৫ শতাংশে নামিয়ে এনেছে। জানুয়ারিতে নেপালের মূল্যস্ফীতি ছিল ৭ দশমিক ২৬ শতাংশ এবং নভেম্বরে ৫ দশমিক ৩৮ শতাংশে নামিয়ে এনেছে।

মালদ্বীপের মূল্যস্ফীতি জানুয়ারিতে ছিল ৩ দশমিক ৯৯ শতাংশ, অক্টোবরে তা কমে হয় ২ দশমিক ৬৪ শতাংশ। ভুটানের মূল্যস্ফীতি ২০২৩ সালের প্রথম মাসে ছিল ৪ দশমিক ৯৯ শতাংশ, তবে অক্টোবরে তা বেড়ে হয়েছে ৫ দশমিক ০৭ শতাংশ।

বাংলাদেশে বিশ্ব ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, 'বাংলাদেশের নীতিনির্ধারকরা মূল্যস্ফীতির চাপ মোকাবিলায় যথাযথ উদ্যোগ নিতে অনেক সময় নিয়েছেন। ফলে, বছর জুড়ে দেশের শহর ও গ্রামে উচ্চ মূল্যস্ফীতি ছিল।'

গত বছরের জুন থেকে মূল্যস্ফীতি উচ্চ পর্যায়ে থাকলেও চলতি বছরের জুলাইয়ে এসে কঠোর হতে শুরু করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এ বছরের অক্টোবরে নিজেদের প্রচেষ্টা আরও জোরদার করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

নভেম্বরে কেন্দ্রীয় ব্যাংক রেপো রেট ৫০ বেসিস পয়েন্ট বাড়িয়ে ৭ দশমিক ৭৫ শতাংশ করেছে। যেন ঋণের সুদ বাড়ে এবং সঞ্চয়কারীরাও ভালো মুনাফা পেতে পারে। ২০২২ সালের মে মাস থেকে এই নীতি শুরু হওয়ার পর এ নিয়ে আটবার রেপো রেট বাড়ানো হয়।

মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে পলিসি রেট বাড়ানোর একদিন পর কেন্দ্রীয় ব্যাংকও ঋণের সুদহার বাড়িয়েছে। কিন্তু, ২০২০ সালের এপ্রিল থেকে চলতি বছরের জুন পর্যন্ত ঋণের সুদহার ৯ শতাংশে সীমাবদ্ধ রাখায় নীতি হার বৃদ্ধি মূলত অকার্যকর ছিল।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বলেন, 'অনেক দেশ আর্থিক নীতি ব্যবহার করে মূল্যস্ফীতির চাপ কমাতে সক্ষম হলেও বাংলাদেশের নীতিনির্ধারকরা তা করতে পিছপা হয়েছেন।'

জাহিদ হোসেন বাংলাদেশ ব্যাংকের উদ্যোগকে 'অনেক কম ও অনেক দেরি' বলে অভিহিত করেন।

তিনি উল্লেখ করেন, সরকার বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে বাজেট ঘাটতি পূরণ করেছে। তিনি এটাকে টাকা ছাপানোর সঙ্গে তুলনা করেন।

সরবরাহ ব্যবস্থা বিঘ্নিত হওয়ার জন্য তিনি বড় ব্যবসায়ীদের কারসাজিকে দায়ী করেন।

তিনি বলেন, 'খাদ্য সরবরাহ শৃঙ্খলের বড় ব্যবসায়ীরা দাম বাড়াতে নিয়ন্ত্রকদের নজর এড়িয়ে ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন। এছাড়া আমদানি নিয়ন্ত্রণ ও ডলারের ঘাটতিও সরবরাহ ব্যবস্থাকে বাধাগ্রস্ত করেছে।'

কেন্দ্রীয় ব্যাংক ঋণের সুদহারের সীমা প্রত্যাহার করে বাজারচালিত হারের দিকে অগ্রসর হয়েছে। তবে, ফাহমিদা খাতুন বলছেন, রাজস্ব নীতি সম্প্রসারণমূলক হলে আর্থিক নীতি সঠিকভাবে কাজ করবে না।

তিনি বলেন, 'রাজস্ব ও আর্থিক নীতির মধ্যে সমন্বয় থাকা উচিত।'

সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান বলেন, 'মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে এখন পর্যন্ত যেসব উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, তার কোনোটিই কাজ করছে না।'

তিনি আরও বলেন, শুধুমাত্র আর্থিক নীতি বাস্তবায়নই যথেষ্ট নয়, কারণ রাজস্ব নীতি একটি বড় ভূমিকা পালন করে।

'সঠিক বাজার ব্যবস্থাপনার অভাব মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধির অন্যতম প্রধান কারণ,' যোগ করেন তিনি।

এদিকে আইএমএফের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে বাংলাদেশে যে পরিমাণ মূল্যস্ফীতি দেখা গেছে, তার অর্ধেকই টাকার অবমূল্যায়নের কারণে হয়েছে।

তবে, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের মতে- অব্যাহত সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি, বাজার-ভিত্তিক বিনিময় হার নিশ্চিত করা, বিশ্বব্যাপী পণ্যের দাম হ্রাস ও ভালো ফসল উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রার কারণে আগামী মাসগুলোতে মূল্যস্ফীতি কমবে বলে আশা করা হচ্ছে।

সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার বলেছিলেন, জুনের মধ্যে মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশে নেমে আসবে।

(প্রতিবেদনটি ইংরেজি থেকে অনুবাদ করেছেন রবিউল কমল)

Comments

The Daily Star  | English

Mohakhali blockade halts Dhaka's rail link

Students of Titumir College waged protest to press home their demand for upgradation of their institution as a university

37m ago