কুষ্টিয়া-২

নৌকা প্রতীকে জাসদের ইনু স্থানীয় আ. লীগের সমর্থন কতটা পাচ্ছেন

জাসদের ইনু
নৌকার প্রার্থী জাসদের সভাপতি হাসানুল হক ইনু (বামে) ও স্বতন্ত্র প্রার্থী মিরপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক কামারুল আরেফিন। ছবি: সংগৃহীত

সমঝোতার ভিত্তিতে নৌকা প্রতীক নিয়ে কুষ্টিয়া-২ (মিরপুর-ভেড়ামারা) আসন থেকে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন আওয়ামী লীগের শরিক দল জাসদের সভাপতি হাসানুল হক ইনু। একই আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক কামারুল আরেফিন।

এই আসনের স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের বেশিরভাগের সমর্থন ইনু নয়, কামারুল আরেফিনই পাচ্ছেন বলে অনেকে মন্তব্য করেছেন। গত সোমবার সংসদীয় এলাকাটির বেশ কয়েকটি জায়গা ঘুরে ভোটার ও অন্যান্য দলীয় নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে এমনটিই জানা গেছে।

স্থানীয় নেতাকর্মীদের ভাষ্য, ১৪ দলীয় জোটের প্রধান শরিক আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা শক্তভাবে হাল না ধরলে এই আসনের বিজয় নৌকা হারাতে পারে। সেক্ষেত্রে ট্রাক প্রতীক পাওয়া আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থী কামারুলের জয়ের সম্ভাবনাই বেশি। জয়ী যিনিই হোন না কেন, এই আসনে নির্বাচন যে ব্যাপক প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক হবে, সে বিষয়ে স্থানীয় নেতাকর্মীরা একমত।

কুষ্টিয়া-২ আসনে মোট আট প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। তাদের মধ্যে চারজন স্বতন্ত্র ও চারজন দলীয় প্রার্থী। তবে নির্বাচনে মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা তিনবারের সংসদ সদস্য হাসানুল হক ইনু ও আওয়ামী লীগ নেতা কামারুল আরেফিনের মধ্যেই হবে বলে মনে করছেন স্থানীয়রা।

গতকাল মঙ্গলবার ভেড়ামারার বাহাদুরপুর, চাঁদগ্রাম ও মোকারিমপুর এবং মিরপুরের ছাতিয়ান, বহলবাড়ীয়া ও সদরপুর ইউনিয়ন ঘুরে দেখা যায়—নৌকা, ট্রাক, লাঙ্গল, কেটলি ও মোড়াসহ প্রায় সব প্রতীকের পোস্টারই মোড়ে মোড়ে সাঁটানো আছে। তবে নির্দিষ্ট দুয়েকটি জায়গা ছাড়া সাধারণ মানুষের মধ্যে ভোট ঘিরে উৎসাহ দেখা যায়নি।

স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রায় দুই লাখ ৭১ হাজার ভোটার নিয়ে থাকা মিরপুরের মানুষ তাদের এলাকার সন্তান কামারুলকেই সংসদে দেখতে চান। আর এক লাখ ৮০ হাজার ভোটারের ভেড়ামারাবাসী এবারও এলাকার প্রার্থী হাসানুল হক ইনুকে জেতাতে জান।

গত ২৩ ডিসেম্বর ভার্চুয়ালি কুষ্টিয়ায় নির্বাচনী সভায় যোগ দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেখানে দলীয় নেতাকর্মীদের উদ্দেশে তিনি বলেন, 'ইনু ভাইও নৌকায় চড়ছেন। কাজেই নৌকা যেন দোল খেয়ে পড়ে না যায়, সেদিকে খেয়াল রাখবেন।'

'ভেড়ামারার লোকজন বারবার এমপি পেয়েছে। এবার আমরা চাই, আমাদের ঘরের ছেলে সংসদে যাক।'

শুরুতে কামারুলের পক্ষে সমর্থন বেশি থাকলেও এখন অনেকেই ইনুর পক্ষে আসছেন বলে জানিয়েছেন আওয়ামী লীগের কয়েকজন স্থানীয় নেতাকর্মী। তবে মিরপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আব্দুল হালিম, সাধারণ সম্পাদক সামিউল ইসলাম সানা ও উপজেলা চেয়ারম্যান আখতারুজ্জামান মিঠুর মতো স্থানীয় শীর্ষ অনেক নেতা কামারুলের সঙ্গে থেকেই ভোটসভায় বক্তব্য রাখছেন।

এ বিষয়ে হাসানুল হক ইনু ডেইলি স্টারকে বলেন, '১৪ দলীয় জোটের সবচেয়ে বড় দল আওয়ামী লীগ দলগতভাবে আমার সঙ্গে ভোট করছে। সেই দলের দুয়েকজন নেতা বা কর্মী বিচ্ছিন্ন-বিক্ষিপ্তভাবে ভোট করছেন। এটা দলীয় বিশৃঙ্খলা। এই বিশৃঙ্খলা জোটনেত্রী দলীয়ভাবে সমাধান করবেন।'

কামারুল আরেফিনের ভাষ্য, শুধু শীর্ষ নয়, আওয়ামী লীগের তৃণমূল পর্যায়ের নেতারাও তার সঙ্গেই আছেন। তাকেই ভোট দেবেন।

তিনি বলেন, 'প্রধানমন্ত্রী গণভবনে যেদিন আমাদের স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার কথা বলেন, সেদিনই মিরপুর ও ভেড়ামারা—দুই থানা আওয়ামী লীগের শতকরা ৯৫ ভাগ নেতাকর্মী একত্রিত হয়েছে। একত্রিতভাবেই কাজ করছে। বলতে পারি, তৃণমূলের শতভাগ নেতাকর্মী আমার সঙ্গে আছেন। ইউনিয়ন-ওয়ার্ডের নেতাকর্মীরাও আমার সঙ্গে আছেন। হয়তো বা থানা ও পৌরসভার দুয়েকজন এর বাইরে থাকতে পারেন।'

নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণার শুরুর দিকে স্থানীয় নেতাদের ইনুর পক্ষে না দেখা গেলেও এখন তাদের কেউ কেউ নৌকার পক্ষে মাঠে নেমেছেন।

তাদের মধ্যে আছেন মিরপুর পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি ও পৌর মেয়র এনামুল হক, মিরপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি রবিউল হক রবি, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আনোয়ারুল মালিথা, কুষ্টিয়া জেলা যুবলীগের সভাপতি রবিউল ইসলাম, মিরপুর পৌর যুবলীগের আহ্বায়ক হাসানুল খান তাপস, ভেড়ামারা আওয়ামী লীগের সভাপতি শফিউল ইসলাম কুব্বাত, সাবেক সাধারণ সম্পাদক আমিরুল ইসলাম, ভেড়ামারা পৌর আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মোকাদ্দেস হোসেন, ভেড়ামারা উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক রওশন জামিল রাসেলসহ আরও অনেকে।

ইনু বলেন, 'আওয়ামী লীগের সঙ্গে জাসদের বিরোধ নেই। সংঘর্ষ বা খুনোখুনি হয়েছে সামাজিক ও গোষ্ঠীগত বিরোধে। নৌকার প্রার্থী হিসেবে যেখানেই যাচ্ছি, আওয়ামী লীগ ও জাসদের নেতারা সঙ্গে থাকছেন।'

এই আসনে বিগত নির্বাচনের পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, শুধু আওয়ামী লীগ কিংবা জাসদের ভোটই জয়-পরাজয় নিশ্চিতে শতভাগ নীতিনির্ধারক নয়। আসনটিতে নির্বাচন বর্জন করা বিএনপিরও ভোটব্যাংকও বিশাল। ভোটার আছে জাতীয় পার্টিরও। সব হিসাবনিকাশ মিলে আসনটিতে জটিল সমীকরণের জন্ম দিচ্ছে।

'গত নির্বাচনেও আওয়ামী লীগের নেতারা শেষ মুহূর্তে মাঠে নেমেছিলেন। এবারও শেষ পর্যন্ত সবাই নৌকাতেই আসবেন। বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সৈনিক কখনো নৌকার বিরুদ্ধে যেতে পারেন না। সেক্ষেত্রে এবারও আমরাই জয়ী হবো বলে আশাবাদী।'

১৯৭৩ সালের নির্বাচনের পর থেকে কখনোই এই আসনে জয় পায়নি আওয়ামী লীগ। ১৯৯১ সালে বিএনপির আবদুর রউফ চৌধুরী এবং ১৯৯৬ ও ২০০১ সালে বিএনপি প্রার্থী শহিদুল ইসলাম এই আসনে জয়ী হন।

১৯৯৬ সালে যে নির্বাচনে জিতে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে, সেই নির্বাচনেও নৌকার প্রার্থী মাহবুব উল আলম হানিফকে দ্বিগুণেরও বেশি ভোটে পরাজিত করেন শহিদুল ইসলাম। সেবার জয়ী প্রার্থীর ৬৪ হাজার ৩৮৯ ভোটের বিপরীতে ২৮ হাজার ৫৪৪ ভোট পেয়ে হানিফ চতুর্থ ও ২৬ হাজার ৩২৭ ভোটে পেয়ে হাসানুল হক ইনু পঞ্চম স্থান অধিকার করেন। আর ৪০ হাজার ১০৬ ভোট পেয়ে দ্বিতীয় হন জাতীয় পার্টির আহসান হাবিব লিঙ্কন। তৃতীয় স্থানে ছিলেন জামায়াতে ইসলামীর আব্দুল ওয়াহেদ।

২০০১ সালের ভোটে বিএনপির সঙ্গে ব্যবধান অনেকটাই কমে আসে আওয়ামী লীগের। শহীদুল ইসলামের এক লাখ ৫৪৪ ভোটের বিপরীতে প্রায় ৮৮ হাজার ভোট পান মাহবুব উল আলম হানিফ। প্রায় ২০ ভাগ ভোট বৃদ্ধি পায় আওয়ামী লীগের। প্রায় ৩৯ হাজার ভোট পেয়ে তৃতীয় স্থানে উঠে আসেন হাসানুল হক ইনু।

২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের জোটসঙ্গী হয়ে প্রথমবারের মতো সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন জাসদ সভাপতি ইনু। সেই নির্বাচনে তার প্রাপ্ত ভোট এক লাখ ৬৫ হাজার ৯৫২, যা জাসদ ও আওয়ামী লীগের সম্মিলিত ভোটও বলা যায়। পরাজিত শহীদুল ইসলাম ২০০৮ সালেও টেনে নেন এক লাখ সাত হাজার ভোট। ২০১৪ সালে বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় দ্বিতীয়বারের মতো নির্বাচিত হন হাসানুল হক ইনু।

ভোটের হিসাব বলছে, বর্তমান নির্বাচনে এই আসনে জয়-পরাজয় নির্ধারণে অনেকটাই মুখ্য ভূমিকা রাখবে বিএনপি-জামায়াতের ভোটাররাও। সেক্ষেত্রে কার পক্ষে যাবে সেই ভোট, ট্রাক না নৌকা, তাই এখন প্রশ্ন।

বিষয়টি নিয়ে প্রার্থীরা সরাসরি কথা না বললেও সাধারণ মানুষ বলছেন—বিএনপির ভোটাররা কখনোই নৌকায় ভোট দেবেন না। সেক্ষেত্রে ট্রাকের বড় ভোট ব্যাংক হতে পারে বিএনপি-জামায়াতের সাধারণ ভোটাররা, যদি তারা শেষপর্যন্ত ভোটের মাঠে উপস্থিত হন।

মিরপুর উপজেলার স্বরূপদহের খাঁ পাড়ার ভোটার রুহুল আলী মণ্ডল ডেইলি স্টারকে বলেন, 'বর্তমান সরকারের ১৫ বছরে এলাকায় অনেক উন্নয়ন হয়েছে। মানুষের জানমালের নিরাপত্তা বেড়েছে। এজন্য নৌকা ও জাসদের ভোট অনেকটাই বেড়েছে। তারপরও এখানে বিএনপির প্রচুর সংখ্যক ভোটার আছেন, তারা কখনোই নৌকায় ভোট দেবেন না।'

বিএনপির নেতাকর্মীরা নৌকার বিরুদ্ধে কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে কামারুল আরেফিন বলেন, 'আমি সাড়ে নয় বছর উপজেলা চেয়ারম্যান ছিলাম। কখনো মানুষের ক্ষতি করিনি। এলাকার ছেলে হিসেবে তারা আমাকে ভোট দিতে পারেন। তবে বিএনপির কোনো নেতার সঙ্গে আমার যোগাযোগ হয়নি।'

'মিরপুরের আড়াই লাখের বেশি ভোটার ঈদের নামাজের মতো আমাকে ভোট দেওয়ার জন্য এক কাতারে সামিল হয়েছেন। সেখানে সব দলের ভোটারই থাকতে পারে', যোগ করেন তিনি।

অঞ্চলভিত্তিক এই মেরুকরণের বিষয়ে মত দেন সেখানকার প্রবীণ ভোটার জলিল মণ্ডলও। তিনি বলেন, 'ভেড়ামারার লোকজন বারবার এমপি পেয়েছে। এবার আমরা চাই, আমাদের ঘরের ছেলে সংসদে যাক।'

'আওয়ামী লীগের শতভাগ নেতাকর্মী নৌকার পক্ষে মাঠে না নামলে ইনুর জয়ী হওয়া কতটা কঠিন হবে,' উল্লেখ করে জাসদের কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক ও কুষ্টিয়া জেলা জাসদের সেক্রেটারি আব্দুল আলীম স্বপন বলেন, 'গত নির্বাচনেও আওয়ামী লীগের নেতারা শেষ মুহূর্তে মাঠে নেমেছিলেন। এবারও শেষ পর্যন্ত সবাই নৌকাতেই আসবেন। বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সৈনিক কখনো নৌকার বিরুদ্ধে যেতে পারেন না। সেক্ষেত্রে এবারও আমরাই জয়ী হবো বলে আশাবাদী।'

এ বিষয়ে মিরপুর পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি ও পৌর মেয়র এনামুল হক ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমি প্রতীক বরাদ্দের পর থেকে নৌকার পক্ষেই আছি। আওয়ামী লীগের যারা ট্রাকের পক্ষে ছিলেন, তারাও এখন চুপি চুপি নৌকার দিকে চলে আসছেন। নৌকার জয় সুনিশ্চিত।'

ভেড়ামারা উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও মাহবুব উল আলম হানিফের ভাই রফিকুল আলম চুন্নুকে স্বতন্ত্র প্রার্থী কামারুল আরেফিনের সঙ্গে দেখা গেলেও তিনি বিষয়টি অস্বীকার করে ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমি ভেড়ামারা-মিরপুরে নির্বাচন প্রচারণায় অংশ নিচ্ছি না। আমি কুষ্টিয়া-৩ আসনে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফের নির্বাচনী প্রচারে আছি।'

এ বিষয়ে জানতে মিরপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সামিউল ইসলাম সানাকে ফোন করলে তিনি নির্বাচনী জনসভায় আছেন বলে ফোন কেটে দেন। আবার ফোন করে কার জনসভায় আছেন? জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'ট্রাক প্রতীক পাওয়া স্বতন্ত্র প্রার্থী কামারুলের জনসভায় আছি।'

Comments

The Daily Star  | English
compensation for uprising martyrs families

Each martyr family to get Tk 30 lakh: Prof Yunus

Vows to rehabilitate them; govt to bear all expenses of uprising injured

7h ago