ফিলিস্তিনের শিশু: ফুলগুলো কোথায় গেল?

গাজায় চলমান এই গণহত্যা এবার বিশ্বব্যাপী বড়দিন উদযাপনেও দুঃখ ও হতাশার ছায়া ফেলেছে। ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে সংহতি জানিয়ে ও গণত্যার প্রতিবাদে আগেই বড়দিনের উৎসব বাতিল করেছে যিশুর জন্মস্থান অধিকৃত পশ্চিম তীরের বেথেলহামের গির্জাগুলো।
ফিলিস্তিনের শিশু
ইলাস্ট্রেশন: আনোয়ার সোহেল/স্টার

হাজার বছর ধরে প্রভু যিশুর জন্মদিনে শিশুদের জন্য উপহারের ঝোলা কাঁধে ছুটে বেড়ানো সান্তাবুড়ো এমন বিপদে আগে পড়েননি কখনো। বরাবরের মতো এবারও হরিণটানা স্লেজে চড়ে বড়দিনের আগের রাতে পুরো দুনিয়া ঘুরে বাচ্চাদের ঘরের দুয়ারে উপহার পৌঁছে দিলেন তিনি। শেষমেষ আসলেন ইসরায়েলের নির্বিচার বোমা হামলায় বিধ্বস্ত ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায়।

কিন্তু রক্তস্নাত এই জনপদে পা রেখে বিমূঢ় সান্তা দেখতে পেলেন, তার উপহার বুঝে নেওয়ার জন্য কোনো শিশু বেঁচে নেই সেখানে। বরং, ভেঙে পড়া দালানকোঠার ফাঁকফোকরে আটকে থাকা নিহত শিশুদের কয়েকটি ধূসর পুতুল আচমকা তাকেই প্রশ্ন করে বসল—'আমাদের কিছু শিশু উপহার দিতে পারো?'

গোটা পৃথিবীর ভেতর সম্ভবত গাজাই এখন একমাত্র জনপদ, যেখানে মাতৃগর্ভেই হত্যার শিকার হচ্ছে শিশুরা। অথবা জন্মের পর পর মরছে গুলি-বোমার আঘাতে। যারা এখনো মরেনি, তাদের মারতেও কোনো আয়োজন বাকি রাখেনি ইসরায়েল। হাসপাতাল-স্কুলসহ অপেক্ষাকৃত নিরাপদ বলে বিবেচিত শরণার্থী শিবিরগুলোতেও চলেছে বাছবিচারহীন হামলা। অকার্যকর করে দেওয়া হয়েছে হাসপাতালের বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও অক্সিজেন সরবরাহ ব্যবস্থা। বন্ধ করে রাখা হয়েছে অবরুদ্ধ উপত্যকায় খাদ্য-পানীয় প্রবেশের সব উপায়।

ফিলিস্তিনের শিশু
বেথেলহামের ইভানজেলিকাল লুথেরান ক্রিসমাস চার্চের নেটিভিটির দৃশ্যে ধ্বংসস্তূপের ভেতর জন্ম নেওয়া যিশুর গায়ে ফিলিস্তিনের কেফিয়াহ। ছবি: এএফপি

গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও জাতিসংঘের তথ্য অনুসারে, গত ৭ অক্টোবর থেকে গাজায় ইসরায়েলি বোমা ও গোলাবর্ষণে ২০ হাজারেরও বেশি ফিলিস্থিনি নিহত হয়েছেন। তাদের মধ্যে অন্তত আট হাজার শিশু। এ ছাড়াও, অধিকৃত পশ্চিম তীরে ইসরায়েলি সেনা ও অবৈধ ইহুদি বসতি স্থাপনকারীদের হাতে আরও অন্তত ৩০০ ফিলিস্তিনি নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে।

গাজায় চলমান এই গণহত্যা এবার বিশ্বব্যাপী বড়দিন উদযাপনেও দুঃখ ও হতাশার ছায়া ফেলেছে। ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে সংহতি জানিয়ে ও গণত্যার প্রতিবাদে আগেই বড়দিনের উৎসব বাতিল করেছে যিশুর জন্মস্থান অধিকৃত পশ্চিম তীরের বেথেলহামের গির্জাগুলো।

এর পাশাপাশি পশ্চিমা গণমাধ্যমের বর্ণবাদী পক্ষপাত ও সামাজিক মাধ্যমের অ্যারগরিদমে আড়াল হওয়া এই গণহত্যার বাস্তবতা এবং নিজ দেশের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাসীনদের চোখ রাঙানি এড়িয়ে ইসরাইলবিরোধী প্রতিরোধের অনন্য নজির গড়ে যাচ্ছেন অনেক শুভবোধসম্পন্ন ইহুদি। খণ্ড খণ্ডভাবে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে চলছে প্রতিবাদ। তাতে শামিল হচ্ছেন এই গণহত্যায় প্রত্যক্ষ সমর্থন দেওয়া যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক ও বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন।

গত ২২ ডিসেম্বর মানবাধিকার সংগঠন আমেরিকান হিউম্যান রাইটস কাউন্সিলের (এএইচআরসি) এক বিবৃতিতে অবিলম্বে এই গণহত্যা বন্ধ ও স্থায়ী যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানিয়ে বলা হয়, 'যুক্তরাষ্ট্রের পূর্ণ সমর্থন নিয়ে গাজার ২২ লাখ মানুষ যখন ইসরায়েলি গণহত্যার মুখোমুখি হচ্ছে, তখন বড়দিন উদযাপনের বিষয়টি অসংবেদনশীল।'

ফিলিস্তিনের শিশু
দক্ষিণ গাজার খান ইউনিসে সাময়িক যুদ্ধবিরতির মধ্যে এক বাড়ির ধ্বংসস্তূপের সামনে আগুন পোহাচ্ছে দুই ফিলিস্তিনি শিশু। ছবি: রয়টার্স

গাজাকে এই মুহূর্তে পৃথিবীর 'সবচেয়ে বিধ্বস্ত' এলাকা হিসেবে অভিহিত করে বিবৃতিতে সংগঠনটির নির্বাহী পরিচালক ইমাদ হামাদ বলেন, 'আমরা আশা হারাতে পারি না। গাজায় স্থায়ী যুদ্ধবিরতি এবং যিশু খ্রিষ্টের জন্মভূমিতে শান্তি ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য চাপ অব্যাহত রাখতে সব শুভবোধসম্পন্ন মানুষের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি আমরা।'

ওয়েবসাইটে এই বিবৃতির সঙ্গে যে ইলাস্ট্রেশন ব্যবহার করেছে এএইচআরসি, তাতে এক হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়েছে। দেখা গেছে, বোমায় বিদীর্ণ এক ভবনের ভেতর নতমুখে দাঁড়িয়ে আছেন লাল পোশাকের সান্তাবুড়ো। শিশুদের জন্য আনা উপহার ভরা ঝোলাটি নিচে ফেলে রাখা। পাশে লেখা, 'হোয়্যার আর দ্য কিডস?'

ভারতের গণমাধ্যম টাইমস অব ইনডিয়া'য় প্রকাশিত এমন আরেকটি কার্টুনে দেখা যায়, ধ্বংসস্তূপের ভেতর পড়ে থাকা একটি টেডিবিয়ার সান্তা ক্লজকে বলছে, 'ক্যান ইউ গিফট আস সাম কিডস?'

এদিকে চলমান যুদ্ধের কারণে যিশুর জন্মস্থান বলে পরিচিত বেথেলহামে বড়দিন উদযাপনের কোনো আড়ম্বর নেই বলে জানিয়েছে আল জাজিরা। রোববার '"নো জয় ইন আওয়ার হার্টস": বেথেলহেমস ক্রিশ্চিয়ানস ফেস হার্টব্রেক অ্যাট ক্রিসমাস' শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়, 'বড়দিন উদযাপন বাতিলের এই সিদ্ধান্তটি হালকাভাবে নেওয়া হয়নি। গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলি বোমাবর্ষণ এবং সম্পূর্ণ অবরোধের মুখোমুখি ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে সংহতি প্রকাশের জন্য এখানকার গির্জা এবং বেথেলহামবাসী ঐক্যবদ্ধ।'

ফিলিস্তিনের শিশু
গাজার ধ্বংসস্তূপের ভেতর সান্তা। ছবি: মিডলইস্ট আই থেকে নেওয়া

২২ লাখ জনগোষ্ঠীর গাজা উপত্যকায় প্রায় দুই হাজার খ্রিষ্টানদের বাস। ব্যতিক্রম বাদে প্রায় প্রতি বছর বড়দিনে বেথেলহামে তীর্থযাত্রা করার সুযোগ পেতেন তারা। শহরটির অবস্থান পশ্চিম তীরের জেরুজালেম থেকে ছয় মাইল দক্ষিণে। এখানেই আছে খ্রিষ্টধর্মের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র চার্চ অব দ্য ন্যাটিভিটি।

আল জাজিজার প্রতিবেদনে বলা হয়, এই যুদ্ধ বেথলেহামের পর্যটনকেও স্থবির করে তুলেছে, যা এর অর্থনীতির ভিত্তি। ক্রিসমাসের সময় সারা বিশ্ব থেকে দর্শনার্থীরা বেথেলহামের বাজারগুলোতে ভিড় করেন। এ বছর এখানকার রাস্তাগুলো ফাঁকা। আর বেথলেহামের বাসিন্দাদের মধ্যেও কোনো উৎসবের আমেজ নেই। কারণ তাদের অনেকের স্বজন গাজার মৃত্যুকূপে আটকা পড়েছেন।

বেথেলহামের ৮৭ বছর বয়সী খ্রিষ্টান নারী উম শাদির দুই ভাইবোন গাজায় ইসরায়েলি হামলায় নিহত হয়েছেন। আরেকজন বিমান হামলায় গুরুতর আহত হয়েছেন। তিনি আল জাজিরাকে বলেন, 'এই গণহত্যার মধ্যে আমরা কীভাবে ক্রিসমাস উদযাপন করব? যেখানে গাজার বাসিন্দারা এক বেলা খাবার পেতে লড়াই করছে।'

আবার বেথলেহেমের লুথেরান ইভানজেলিকাল গির্জায় এবাং যিশুর জন্মদৃশ্যটি ফুটিয়ে তোলা হয়েছে অন্যভাবে। সেখানে খড়ভর্তি খাটের পরিবর্তে সদ্য জন্ম নেওয়া প্রভু যিশু শুয়ে আছেন ধ্বংসস্তূপের ভেতর। তার গায়ে জড়ানো ফিলিস্তিনিদের প্রতিরোধ সংগ্রামের প্রতীক হয়ে ওঠা বিখ্যাত কালো-সাদা কেফিয়া।

লুথেরান গির্জার যাজক মুনথার আইজ্যাক দ্য গার্ডিয়ানকে বলেন, 'ফিলিস্তিনি শিশুদের জন্য এটাই বড়দিনের বাস্তবতা। যিশু যদি এখন জন্ম নিতেন তাহলে তিনি গাজার ধ্বংসস্তূপের নিচেই থাকতেন।'

ফিলিস্তিনি শিশুদের জন্য যে 'ঘুমপাড়ানি গান' লিখেছিলেন উর্দু কবি ফয়েজ আহমদ ফয়েজ, সেখানে মায়ের কোলে শুয়ে থাকা বাচ্চার কপালে চুমু দেওয়ার জন্য চাঁদের খোঁজ পাওয়া যায়নি। কারণ চাঁদ ব্যস্ত ছিল ওই মৃত্যু উপত্যকার বাসিন্দাদের সমাহিত করার কাজে।

ফিলিস্তিনের শিশু
আমেরিকান হিউম্যান রাইটস কাউন্সিলের (এএইচআরসি) বিবৃতিতে ব্যবহার করা ইলাস্ট্রেশন। ছবি: সংগৃহীত

তাই সেখানকার বেঁচে থাকা শিশুদের সান্ত্বনা দিতে ফয়েজকে বলতে শোনা যায়, 'না বাছা, কেঁদো না!/তোমার বাসভূমে/মৃতদের গোসল দিয়েছে সূর্য/চাঁদ দিয়েছে কবর।'

এরও অনেক আগে ফিলিস্তিনি জাতিসত্তার কবি মাহমুদ দারবিশ লিখে যান, 'আজকের দিনটি আগামী দিনের থেকে হয়তো ভালো,/কেবল মৃত্যুগুলোই আজ নতুন/প্রতিদিনই জন্ম নেয় যে নতুন শিশুরা/তারা ঘুমোতে যাওয়ার আগেই ঘুমিয়ে পড়ে, মৃত্যুতে।/তাদের গণনা করা মূল্যহীন।'

গত সাত দশক ধরে ফিলিস্তিনে দখলদার ইসরায়েলিদের বন্দুক-বোমার প্রধান লক্ষ্যবস্তু হয়ে আছে এই শিশুরা। এই উপত্যকায় শিশুদের বয়স পরিমাপ করা হয় তারা কতগুলো ইসরায়েলি হামলার শিকার হয়েছে তার ওপর ভিত্তি করে। এখানকার ২৩ লাখ জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেকের বয়স ১৮ বছরের কম।

লন্ডনভিত্তিক গণমাধ্যম-পর্যবেক্ষণ প্রতিষ্ঠান মিডল ইস্ট মনিটরের রামোনা ওয়াদি মনে করেন, খুব পরিকল্পিতভাবেই ফিলিস্তিনি শিশু হত্যা বা জখম করার মাধ্যমে প্রজন্মকে পঙ্গু করে দেওয়া হচ্ছে, যাদের মধ্যে উপনিবেশবিরোধী লড়াই চালু রাখার সম্ভাবনা আছে।

সর্বশেষ হিসাব অনুসারে, এবারের আড়াই মাসের হামলাতেও নিহত ফিলিস্তিনেদের মধ্যে নারী-শিশুর হার ৭০ শতাংশের বেশি।

গান দিয়ে পৃথিবী বদলে দিতে চাওয়া প্রতিবাদী পিট সিগার যুদ্ধক্ষেত্রে নিহত নারী-শিশুদের নিয়ে গেয়েছিলেন, 'ফুলগুলো সব কোথায় গেল? সে কবেকার কথা/ফুলগুলো সব কোথায় গেল? কত আগের কথা।/মেয়েরা সব তুলে নিয়েছে।'

এখন ২০২৩ সালে গাজার বাস্তবতায় কার্টুনে আঁকা বুড়ো সান্তা যেন বুঝে উঠতে পারছেন না- শিশুগুলো কোথায় গেল? কে তাদের তুলে নিয়েছে?

 

Comments

The Daily Star  | English

Political parties want road map to polls

Leaders of major political parties yesterday asked Chief Adviser Professor Muhammad Yunus for a road map to the reforms and the next general election.

2h ago